উন্নয়ন চলিতেছে
প্রদীপ পট্টনায়ক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা প্রত্যেকে অবগত রহিয়াছি যে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা মন্থর থাকে নাই৷ তাই আমরা উন্নত যুগে পদার্পণ করিয়া উন্নত হইতে সর্বোন্নত হওয়ার সংগ্রামে রত রহিয়াছি৷ তবুও বিস্ময় পিছু ছাড়ে নাই৷ ইতিহাস বলিতেছে, কোনও এক স্থানে মহামারী লাগিলে তাহাতে সন্ত্রস্ত হইয়া মানুষ প্রাণের তাগিদে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইতে বাধ্য থাকিত৷ কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান তখনও দুর্গম গিরি জয় করিতে পারে নাই৷ অদ্য সে বিজয়মাল্যের দাবিদার৷ কিন্তু অতীতস্মৃতি পুনরায় ভাস্বর হইয়া উঠিয়াছে৷ ডেঙ্গু অদ্য প্রতিকূল পরিবেশ বুঝিয়া মাহামারীর জাল বিন্যাস করিয়াছে৷ শুধু কি তাহাই, এক এক করিয়া প্রাণের অপচয় চলিতেছে৷ বিস্মিত হইতে হয় প্রতিষেধক নাই ইহা সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে পারিলে যে অন্তত মহামারীর সহিত বর্তমান প্রজন্মকে পরিচিতি লাভ করিতে হইত না, তাহা আর বলিবার অপেক্ষা কি৷ শাসকেরা ক্ষমতার মদিরা পান করিয়া মানুষদিগকে পশুর অধম ভাবিতে থাকে৷ কেবলমাত্র ভোট নামক যজ্ঞের আগমন ঘটিলে সাধারণ মানুষদিগকে রত্নতুল্য মনে করিতে থাকে৷ সত্যিই কি শাসকেরা ডেঙ্গু লইয়া চিন্তিত তাহা তাহাদের আচরণে প্রকাশ পাইতেছে না৷ তাই দেখিলাম স্বকৃত ব্যর্থতা ঢাকিতে নানা প্রকার সাহসী পদক্ষেপ লইলেন৷ শাসক ক্ষমতা ফলাইলেন– ডেঙ্গুর পরিণামে মৃত্যু, চিকিৎসক ইহা লিখিতে পারিবেন না৷ যদি লিখেন তাহা হইলে তিনি রাজরোষে পড়িবেন৷ ডেঙ্গুর স্থলে ‘অজানা জ্বর’ নামক ব্যাধির উল্লেখ করাই আবশ্যক৷ ‘অজানা জ্বর’ ছাপ মারা ব্যাধিটি জনগণের মাঝে আতঙ্ক বাড়াইল কারণ উহার গোত্র–পরিচয় জানা যায় নাই৷ সাধারণ মানুষ ব্যতিব্যস্ত হইল৷ ব্যতিব্যস্ত হইবার আরও কারণ রহিয়াছে, তাহা হইল সত্য উদঘাটনে অপারগতা৷ বিষয় আদালত পর্যন্ত যাইল এবং আদালতেও সঠিক তথ্য প্রেরণ করা হয় নাই৷ সত্যকে যাহারা ভয় পাইয়া সংকুচিত হইয়া যায়, তাহারা জনসমাজকে কী শিক্ষা দিবে, কী–ই বা গ্রহণ করিবে সম্বিত ফিরাইবার জন্য উচ্চবাচ্য করিলে শাসকের আখ্যা– বিরোধীরা রাজনীতি করিতেছেন৷ যাহাই হউক, অদ্ভুত কমেডি প্রত্যক্ষ করিলাম যে, শাসক উৎসব লইয়া যতখানি ব্যস্ত, ডেঙ্গু লইয়া তাহার একাংশও নন৷ যদি তাঁরা জোর কণ্ঠে বলিয়া থাকেন – ‘ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছি’৷ বলিতে হইবে সেই ব্যবস্থার মধ্যপথে মৃত্যুমিছিল চলিতেছে৷ সাধারণ মানুষ সন্ত্রস্ত হইয়া দিন অতিবাহিত করিতেছে৷ এই সন্ধিক্ষণে শাসকের কতটুকু মানবিকতার পরিচয় পাওয়া যাইল অথচ ‘উন্নয়ন’ নাকি বিপুল বেগে চলিতেছে দেশে এবং রাজ্যে৷ বুঝিলাম উন্নয়ন নামক বস্তুটি বাক্যামৃত সুলভ৷ তাহা সাধারণ মানুষদিগের মস্তকের উপর বোধ হয় ক্ষণিক মৃদু হাওয়া দিয়া মিলাইয়া যাইল৷ ইহার পরে দগদগে কাটা ঘায়ের উপর কিঞ্চিত লবণ যোগ করিলে কেমন হইবে দিনান্তে শাসকের নির্দেশে তাহার প্রশাসনিক কর্মীবৃন্দ মশক বংশের গৃহ সন্ধান করিতেছে এবং লুপ্তপ্রায় করিবার তরে ব্লিচিং ছড়াইতেছে৷ মনে হইতেছে মৃত্যুমিছিলের শবদেহে শাসক ব্লিচিং ছড়াইতেছে, যাহাতে শাসকের নাসারন্ধ্রে দুর্গন্ধ না যাইতে পারে৷ ইহা জলের ন্যায় পরিষ্কার হইতেছে যে, এক্সরশ্মি পড়িবামাত্র শাসকের কঙ্কাল দেখা যাইতেছে৷ বুঝিবার বিষয় হইল, সাধারণ মানুষের প্রাণ পুঁজিবাদী সভ্যতার ক্রোড়ে কখনওই নিরাপদ নহে ইহাই সত্য৷ এই সভ্যতা মানুষদিগকে মানুষরূপে গণ্য করে না, বাজারের ক্রেতা ব্যতীত তাহার আর কোনও পরিচয় নাই৷ সভ্যতার বাহকদিগকে মূল্যহীনের মতো করিয়া সমাজের নিম্নস্তরে থাকতে হয়৷ কেবল ব্যবহার করিয়া ছুঁড়িয়া দেওয়া হয়৷ শাসক আননে হাসি ফুটাইয়া সাধারণ মানুষদিগের ‘পাকা ধানে মই’ দিয়া থাকে৷ তাহারই একটি উদাহরণ হইতেছে ডেঙ্গুর অবিরত মৃত্যুমিছিল৷
গুজরাটে টাটার ন্যানো কারখানাও ধুঁকছে
কিংকর অধিকারী, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুব়
সিঙ্গুর আন্দোলন গোটা ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল৷ আন্দোলনের চাপে ২০০৮ সালে টাটারা পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গুজরাটের সানন্দে৷ কারখানা নিয়ে যাওয়ার জন্য টাটাদের ৩০ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ এতবড় একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও তারা যে তাদের কারখানা বাঁচিয়ে রাখতে পারছে না– সম্প্রতি সংবাদপত্র থেকে তা জেনে বিস্মিত হলাম৷ এ বছরের (২০১৭) মার্চে ২০০–এর কম ন্যানো গাড়ি বিক্রি করেছিল টাটা মোটর্স৷ সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ন্যানো গাড়ির ক্রমহ্রাসমান চাহিদার কারণে বর্তমানে দিনে মাত্র ২টি করে ন্যানো উৎপাদন করছে টাটা মোটর্স৷ এখন ন্যানো গাড়ি রাস্তায় দেখাই যায় না৷ অথচ সেই ন্যানো কারখানার জন্যই টাটাদের বিপুল সুযোগ–সুবিধা দিয়ে গুজরাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলেছেন, সেই টাকায় অনায়াসে কৃষক ঋণ মাফ করা যেত৷ পশ্চিমবঙ্গেও তৎকালীন সরকার বিপুল অর্থ সাহায্য করেছিল৷ সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা হয়নি বলে আমরা যারা আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলাম তাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে, সত্যি যদি এখানে ন্যানো কারখানা হত তা হলে কি এর থেকে ভাল কিছু হত?
ক্যাম্পে নতুন অভিজ্ঞতা হল
গৌরাঙ্গ মাইতি, সল্টলেক, কলকাতা
১৭ নভেম্বর এস ইউ সি আই (সি)–এর আহ্বানে মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবার্ষিকী সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ধর্মতলার রানি রাসমণি রোডে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে যে বিশাল সমাবেশ হয়েছিল তার স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে আমি একটি ধর্মশালায় নিযুক্ত ছিলাম৷ সেখানে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা ভাষায় সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই৷ তবুও কয়েকটি দিক উল্লেখ না করে পারলাম না৷ সেখানে নানা রাজ্য থেকে বহু মানুষ এসেছিলেন৷ তাদের যে শৃঙ্খলাবোধ দেখেছিলাম তাতে আমার মনে হয়, মহান নেতা, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা ছাড়া এই শৃঙ্খলা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়৷ সব থেকে বেশি আমাকে মুগ্ধ করেছিল– প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও সভার শেষে ক্যাম্পে ফিরে আসার পর তাঁদের মধ্যে কোনও ক্লান্তি ছিল না, যা সাধারণত ঘটে থাকে৷ দেখলাম অত পরিশ্রমের পরেও সুশৃঙ্খলভাবে সামান্য টিফিন করে বিভিন্ন রাজ্যের কমরেডরা পরের দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন৷ নিজ নিজ ভাষায় সঙ্গীত ও আবৃত্তি পরিবেশন করছেন, বিপ্লবের জয়গান করছেন৷ তার মধ্য দিয়ে যে আবেগ ও উন্নত সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না৷ আমি এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না, আমরা সকলে বিপ্লবের সাথী – এ কথাটার অর্থ কী? আমার সঙ্গে যে সব স্বেচ্ছাসেবকের পরিচয় হল তাঁদের সঙ্গে আগে আমার পরিচয় ছিল না৷ তাঁরা কেউ এসেছেন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ থেকে, কেউ কলকাতার কমরেড৷ সকলে মিলে এক সঙ্গে কাজ করার যে কী আনন্দ তা বুঝতে পারলাম৷ সকলের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল৷ সব শেষে বলতে পারি, ক্যাম্পে বিভিন্ন মানুষের যে একতা, নিষ্ঠা, উদার মানসিকতা ও পরস্পর সহযোগিতার ভাব দেখলাম তা আর কোথাও গিয়ে অর্জন করতে পারব না৷ আমি চেষ্টা করব আমার নেতৃস্থানীয় ও বন্ধুস্থানীয় কর্মীদের সহযোগিতায় আমার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও বিপ্লবী সংগ্রামকে গ্রহণ করতে৷