২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ক্ষমতায় এলে দেশে ‘আচ্ছে দিন’ আনবেন৷
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ‘আচ্ছে দিন’ এনেছেন, তবে তা সাধারণ মানুষের জন্য নয়, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য৷ কারণ তাঁরাই প্রচার ও বিপুল অর্থ দিয়ে তাঁকে ক্ষমতায় এনেছেন৷ ভারতের সবচেয়ে ধনী ১০০ জনের যে তালিকা সম্প্রতি ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে এঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ২০১৫ সালে যেখানে ছিল ৩৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (ভারতীয় টাকায় প্রায় ২৫. ৫ লক্ষ কোটি), সেখানে ১০.৪ শতাংশ বেড়ে ২০১৭ সালে তা হয়েছে ৩৮১ বিলিয়ন ডলার৷ একমাত্র মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ২২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ ফোর্বস তালিকা অনুযায়ী ২০১৭ সালের বিশ্বের প্রথম ১০০ জন ধনীদের মধ্যে তিন জন ভারতীয়৷ এঁরা হলেন মুকেশ আম্বানি, আজিম প্রেমজি ও দিলীপ সাংভি৷
এইসব তালিকা থেকে দেখা যায় সম্পদের পরিমাণে গুজরাটের ধনকুবেররাই এগিয়ে৷ ভারতের সবচেয়ে ধনী ১০০ জনের যে তালিকা সম্প্রতি ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম পাঁচ জন ভারতীয়ের মধ্যে সবাই গুজরাট প্রদেশের৷ এঁদের মধ্যে প্রথম স্থানে আছেন মুকেশ আম্বানি৷ তিনি পরপর ন’ বছর এই স্থান অধিকার করে আছেন৷ সম্প্রতি প্রকাশিত হুরুন ইন্ডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা৷ গত এক বছরে তাঁর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৫৮ শতাংশ৷ এই রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় ধনীদের মিলিত সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ ১৭ শতাংশ৷
ফোর্বসের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে দিলীপ সাংভি৷ তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছেন যথাক্রমে গৌতম আদানি, আজিম প্রেমজি ও পালনজী মিস্ত্রি৷ এছাড়াও গুজরাট প্রদেশের আরও কয়েকজন এই তালিকায় আছেন৷ যেমন, উদয় কোটাক, পঙ্কজ প্যাটেল, অনিল আম্বানি, রাজেশ মেহতা প্রমুখ৷ গুজরাটে অত্যন্ত সম্পদশালীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার৷
দেখা যাচ্ছে দেশের মধ্যে সম্পদশালীর সংখ্যায় গুজরাট শীর্ষে৷ অথচ সেখানে বিরাট সংখ্যক শিশু অপুষ্টির শিকার৷ ২০১৬ সালের একটি আর্থ–সামাজিক সমীক্ষায় দেখা গেছে গুজরাটে অঙ্গনওয়াড়িগুলিতে মোট ৪৩ লক্ষ শিশুর মধ্যে ১.৪৭ লক্ষ শিশুই গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছে৷ দেখা গেছে, গুজরাটে গুরুতর অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের গড় ৪.৫৬ শতাংশ যা জাতীয় গড়৩.৩৩ শতাংশের চেয়ে বেশি৷ এ থেকে অনুমান করাই যায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা সে রাজ্যে যথেষ্টই বেশি৷ আর একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে৷ ২০১২ সালে পুষ্টির মাপকাঠিতে দেশের মধ্যে গুজরাট ২০ তম স্থানে ছিল৷ অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরাখণ্ডও গুজরাটের থেকে বেশি এগিয়েছে৷
ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলও (সিএজি) বলেছে, গুজরাটে শিশুদের মধ্যে অনেকেই অপুষ্টিতে ভুগছে৷ যদিও সরকার দাবি করেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সরকার এই সব শিশুদের পুষ্টির ব্যবস্থা করেছে৷ কিন্তু তা যে অপুষ্টি দূর করতে পারেনি তা বোঝা যায় সিএজি–র রিপোর্ট থেকে৷ রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন শিশুর ওজন স্বাভাবিকের থেকে কম৷ সেই সঙ্গে তাঁরা বলেছেন, ১.৮৭ কোটি মানুষ আই সি ডি এস প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত৷ রাজ্যে যেখানে ৭৫,৪৮০টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের প্রয়োজন সেখানে মাত্র ৫২, ১৩৭টি অনুমোদিত হয়েছে, তার মধ্যে চলছে মাত্র ৫০,২২৫টি৷ অর্থাৎ ঘাটটি ২৩ শতাংশ৷
গুজরাট সরকারের মহিলা ও শিশুবিকাশ মন্ত্রী বসুবেন ত্রিবেদী বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে লিখিতভাবে জানান, রাজ্যের ১৪টি জেলায় অন্তত ৬.১৩ লক্ষ শিশু অপুষ্টি আক্রান্ত বা গুরুতরভাবে অপুষ্টি আক্রান্ত৷ এর মধ্যে বনসকান্থা পাটন, নভসারি, জুনাগড় ও খেদা জেলার ৪৬টি তালুকে ১.৯৭ লক্ষ শিশু অপুষ্টি আক্রান্ত ও ২৪,৭৬২ জন গুরুতরভাবে অপুষ্টি আক্রান্ত৷ আমেদাবাদ জেলা যাকে রাজ্যের ব্যবসায়িক রাজধানী বলে গণ্য করা হয়, সেখানে ৮৫ হাজারেরও বেশি শিশু অপুষ্টি আক্রান্ত৷ মন্ত্রী বিধানসভায় বলেছেন, শুধুমাত্র আমেদাবাদ শহরে ৫৪,৯৭৫ জন শিশু অপুষ্টি আক্রান্ত এবং ৩, ৮৬০ জন গুরুতরভাবে অপুষ্টি আক্রান্ত৷ তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অপুষ্টি শুধু রাজ্যের কোনও বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়, সারা রাজ্যেই শিশুরা অপুষ্টি আক্রান্ত৷ এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, সে রাজ্যে সাধারণ মানুষের অবস্থা কতটা খারাপ৷ গুজরাটের মতো অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর রাজ্য, যাকে মোদি ও তাঁর কেন্দ্রীয় সরকার, দেশের উন্নয়নের মডেল হিসাবে তুলে ধরেন সেই রাজ্যে শিশুদের এই অপুষ্টির চিত্র প্রমাণ করে তাদের এই প্রচার কতটা অন্তঃসারশূন্য৷ সেখানে শিশুদের এই অপুষ্টি যে রাজ্য সরকারের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন মন্ত্রী বসুবেন ত্রিবেদী৷
২০১৫–১৬ সালে গুজরাটে একটি আর্থ–সামাজিক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মে মাসে গুজরাট সরকার রাজ্যকে অপুষ্টি–মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ কিন্তু উল্লেখিত সমীক্ষাগুলি দেখাচ্ছে, অপুষ্টি দূর করা হয়েছে বলে গুজরাট সরকারের দাবি ঠিক নয়৷ উত্তরে অম্বাজি থেকে দক্ষিণে ডংস পর্যন্ত উপজাতি অঞ্চলগুলিতে ৯৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টি আক্রান্ত৷
নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুগামীরা গর্ব করে গুজরাট মডেলের সাফল্যের কথা বলেন এবং গুজরাটকে উন্নয়নের মডেল হিসাবে তুলে ধরেন৷ গর্ব তিনি করতেই পারেন কারণ সাধারণ মানুষের কথা তো তিনি ভাবেন না, তিনি বৃহৎ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কথাই ভাবেন দেশের উন্নতি বলতে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উন্নতিই বোঝেন৷ তাদের সেই পুঁজিমুখী উন্নয়নের ধারায় গুজরাটে অর্থনৈতিক বৈষম্য অত্যন্ত বেশি৷ সেখানে একদিকে মুষ্টিমেয়ের হাতে সম্পদের প্রাচুর্য, অন্যদিকে সমাজ জুড়ে মানুষের জীবনে মারাত্মক অপুষ্টি৷ এই চিত্র প্রমাণ করে দিচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই বৈষম্য অনিবার্য৷