সম্প্রতি দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সমীক্ষা সংস্থা অক্সফ্যামের পেশ করা রিপোর্টে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তা এক কথায় ভয়ঙ্কর বললে কম বলা হয়। গত কয়েক দশক ধরে সারা বিশ্ব তথা ভারতবর্ষে নিরন্ন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছিল। কলকারখানায় লকআউট, ছাঁটাইয়ের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মচ্যুত হচ্ছিল। বিনা চিকিৎসায় মরছিল হাজারে হাজারে অসহায় মানুষ। করোনা অতিমারির আগেই বেকারত্ব এমন পর্যায়ে পৌছায় যেখানে সামান্য ডোমের একটি চাকরির জন্য উচ্চ শিক্ষিত এমনকি পিএইচডি হোল্ডাররা পর্যন্ত কয়েক হাজার শিক্ষিত যুবক লাইনে দাঁড়াচ্ছিলেন। করোনা ঝড়ে এই দুবছরেই সেই করুণ চিত্রটাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, এই দুবছরে সারা বিশ্বে ৯৯ শতাংশ মানুষের রোজগার কমেছে। ১৬ কোটির উপরে মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। ভারতবর্ষেও কোটি কোটি অসংগঠিত ও সংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে। করোনা কালে দেশে দশ হাজার চুরানব্বই জন শিশু বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার ন’শো দশ জন শিশু বাবা কিংবা মা-কে হারিয়েছে। পরিবারের সাথে রাস্তায় থাকে ৫৪০১ জন শিশু এবং ৪১৪৮ জন শিশু একাই সারাদিন রাস্তায় কাটায়। কী ভয়ঙ্কর এই চিত্র। অক্সফ্যামের রিপোর্টে এই চিত্র উঠে এসেছে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা এর চেয়েও আরও বেশি শিশু এই মুহূর্তে রাস্তায় থাকে। করোনার প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ঢেউ এভাবেই এদেশের দারিদ্রকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। এ তথ্যও আজ উঠে আসছে, করোনাকালে অসংখ্য মানুষ করোনা এবং করোনা বর্হিভূত কারণে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। সরকার সংক্রমণ এবং সে কারণে মৃত্যুর তথ্য চেপে দেওয়ার পরেও সিভিল রেজিস্টে্রশনের রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায় করোনার আগের বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, ২০২০ সালে সেই মৃত্যুপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে কম করে পাঁচ গুণ বেশি মানুষের সংখ্যা।
অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে করোনা কালে ভারত সরকার স্বাস্থ্য বাজেট কমিয়েছে দশ শতাংশ । স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় পর্যাপ্ত খরচ না করা এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বেসরকারিকরণের জন্যই করোনা অতিমারির মধ্যে দরিদ্র মানুষের পক্ষে বড়সড়ো ব্যাধির মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কার্যত অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে না তোলা এবং কর্পোরেটমুখী ও বিমামুখী স্বাস্থ্যনীতির জন্যই সারা দেশ জুড়ে করোনা আক্রান্ত মানুষ বিনা অক্সিজেনে, বিনা চিকিৎসায় হাজারে হাজারে মারা গেছে। গণচিতা জ্বলেছে রাজ্যে রাজ্যে। লাশ ভেসে গেছে নদীর জলে।
আবার পাশাপাশি এই রিপোর্টই বলছে, করোনাকালে ভারতে বিলিয়ন ডলারের (অন্তত ৭৪০০ কোটি টাকা) মালিকের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪২। তাদের সম্পদ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ৫৩ লক্ষ কোটি টাকা। সম্পদের নিরিখে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৪৫ শতাংশ। আর নিচুতলার ৫০ শতাংশের় হাতে রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ।
কেন এই ব্যবধান আরও বাড়ল? সারা বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষেও ধনী গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছিল। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছিল। কাজ থাকলেও তাদের রোজগার ক্রমশ কমছিল। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছিল। ছোট বড় ব্যবসা-কলকারখানায় একের পর এক লালবাতি জ্বলছিল। করোনাকালে লকডাউন আধা লকডাউনে মানুষের অসহায়তার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী তাদের মুনাফা বহুগুণে বাড়িয়েছে। একধরনের ওষুধ কোম্পানি, ভ্যাক্সিন কোম্পানি, নেট দুনিয়া, মিডিয়া ব্যবসায়ীরা সরকারি সহযোগিতায় কার্যত অবাধ লুন্ঠন চালিয়েছে। ওষুধ বাজারের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই।
সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ করে রেখে সকলকে অনলাইন পড়াশুনায় বাধ্য করা হয়েছে। করোনার সুযোগ নিয়ে নানা জনবিরোধী আইন পাশ করে যথেচ্ছভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অধিকার মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে কার্যত এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের মুনাফার পাহাড় গড়তে সাহায্য করেছে। তাই দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষের রোজগার কমলেও ১ শতাংশ মানুষের রোজগার বেড়েছে বহুগুণে। আগে মানুষের যতটুকু বেঁচে থাকার সুযোগ ছিল, করোনাকালে মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির নরখাদক কর্পোরেট ব্যবসায়ী সে সুযোগটুকুও মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিল নরখাদকরা, যাতে ডুবন্ত মানুষগুলির মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে পারে। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সেই ব্যবস্থাকেই পাকাপোক্ত করল।
ডাঃ সজল বিশ্বাস
আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগণা