‘গরিব মানুষের কথা বলছ তোমরাই’

 

সারা রাজ্য জুড়ে চলছে নির্বাচনী প্রচার। একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সহ নামকরা সবনেতারা শত শত কোটি টাকা খরচ করে চার্টার্ড প্লেন, হেলিকপ্টার, রথে পরিবর্তিত অত্যাধুনিক বাস ইত্যাদি হাঁকিয়ে প্রায় রোজ পশ্চিমবঙ্গ চষে ফেলছেন। তাঁদের জৌলুস আর হাঁক ডাকে চারিদিক সরগরম। অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও রোজই কোনও না কোনও জেলায় গিয়ে চোখা চোখা বাণী দিচ্ছেন। এদের সকলের প্রতিটি সভার খুঁটিনাটি তুলে ধরতে সংবাদমাধ্যমের ব্যস্ততার শেষ নেই।

এই প্রচারের প্রবল জাঁকজমক,জৌলুস আর হাঁকডাকের বিপরীতে নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেই চলছে আর একটি ধারা। যে ধারার কথা করপোরেট মালিকদের টাকায় চলা বৃহৎ সংবাদমাধ্যম পারতপক্ষে মুখে আনতে চায় না। অথচ এই ধারাটাই টানে গরিব-মধ্যবিত্ত-খেটে খাওয়া মানুষকে। পায়ে হেঁটে, ঘরে ঘরে গিয়ে, কখনও বা পথসভা, কখনও বা সাইকেলে লাগানো মাইকের ভরসায় এই ধারার কর্মীরা জিতে নেন মানুষের মন। পেয়ে যান গরিব-মধ্যবিত্ত-খেটেখাওয়া মানুষের হৃদয়, মানুষের উজাড় করা শ্রদ্ধা, ভালবাসা। এই ধারার প্রতিনিধি হলেন এস ইউ সি আই (সি) কর্মী এবং দলের প্রার্থীরা।

যেমন দেখা গেল নদীয়া জেলার শান্তিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী তাঁতশিল্পী কমরেড নদীয়াচাঁদ বিশ্বাসের প্রচারে। শান্তিপুরের নীলকুঠি গ্রামে সংগঠনের কর্মীরা প্রচারে গিয়ে অনুভব করলেন, একটা অদ্ভূত স্বতঃস্ফূর্ততা মানুষের মধ্যে। অন্য দলগুলি ভোটের সময় টাকা ছড়ায়, চায় গরিব মানুষের অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের ভোট কিনতে। আর এস ইউ সি আই (সি) গরিব মহল্লায় গিয়ে ভোটের প্রচারের সাথে সাথে টাকা চাইছে! বলছে, যে যেমন পারেন দিন। এই তিল তিল করে গড়ে তোলা তহবিলেই চলে এ দলের ভোটের প্রচার। শান্তিপুরের এই গ্রামেও দেখা গেল বড় কষ্টের রোজগার থেকে একটু একটু টাকা মানুষ তুলে দিচ্ছেন দলের কর্মীদের হাতে। ঠিক যেন নিজের সন্তানকে বড় করার জন্য পিতা-মাতার কর্তব্য বোধের টানের মতোই এ দান।

ঘুরতে ঘুরতে কর্মীরা দাঁড়ালেন এক দরিদ্র বিধবা মহিলার ঘরের দরজায়। সংসারে তিনি একা। তাঁতের কাজ করে নিজের পেট চালান। নিজের ছেলে তাঁকে দেখে না। দলের কর্মীরা ভোট চাইবার পর অনুরোধ করলেন, ‘১০টা টাকা সাহায্য দিতে পারেন’! তিনি বার করে আনলেন ২০ টাকা। দারিদ্রের ছাপ তাঁর ঘরের সর্বত্র। যা দেখে এক কর্মী বলেই ফেললেন, আপনি ১০ টাকাই দিন, না হলে হয়ত আপনার অসুবিধা হবে’! একটু হেসে বললেন সেই বৃদ্ধা ‘আমি একা থাকি। টাকার কষ্ট আমার আছেই, তবুও তোমাদের কিছু দিতে পেরে নিজেই খুশি হলাম। তোমরাই গরিব মানুষের কথা বলছ। আর যদি মদ বন্ধ করতে পার খুবই ভাল হয়।’ সে ঘর থেকে ফিরতে ফিরতে সকলে বাকরুদ্ধ। শোনা গেল এক কর্মীর স্বগোতক্তি, ‘কত বড় আশা শুধু আমাদের নিয়ে! এর দাম আমাদের দিতেই হবে’।

কলকাতার বেলেঘাটা কেন্দে্র এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী অধ্যাপক তরুণ কুমার দাসের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন সাধারণ মানুষ। এক সময়কার সিপিএম সমর্থক এক তরুণ, পেশায় গৃহশিক্ষক। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না সিপিএম-কংগ্রেস-আব্বাসের জোটকে। তাঁর বাড়িতেই একদিন ডেকেছিলেন নিজের কিছু উঁচু ক্লাসের ছাত্র ও এক বন্ধুকে। ব্যবস্থা করেছিলেন, এস ইউ সি আই (সি) দলের বক্তব্য তাদের শোনাতে। ৩ এপ্রিল ফুলবাগান মোড়ে যখন বক্তব্য রাখছেন দলের প্রার্থী, দেখা হল সঞ্জয় বাবুর সঙ্গে। অনেক দিন সিপিএম করেছেন, কিন্তু বামপন্থার প্রতি যে আকর্ষণ থেকে ওই দলে গিয়েছিলেন, আজ বুঝছেন বামপন্থাকে বিসর্জন দিয়েছে তারা। এস ইউ সি আই (সি) আঞ্চলিক অফিসের ঠিকানা নিয়ে গেলেন। নতুন করে রাজনীতিকে চিনতে চাইছেন তিনি। ওই এলাকারই সাগ্নিক, সুপ্রতীক বামপন্থী বলতে পরিবার থেকে এতদিন চিনেছেন সিপিএমকেই। আজ ধাক্কা খেয়েছে তাঁদের স্বপ্ন। পথ খুঁজতে গিয়ে পেয়েছেন এস ইউ সি আই (সি)-র রাজনীতির সন্ধান। চাইছেন আরও ভাল করে বুঝতে।

এই কেন্দ্রেরই ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের চার নম্বর বস্তিতে, প্রচারের সময় দুটি পরিবারে প্রায় একই অভিজ্ঞতা। বলেছেন তাঁরা, তোমরাই আমাদের ভোটার স্লিপ দিয়ে যাবে, অন্যদেরটা নেব না। বই এবং কাগজ চেয়ে নিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এবার ভোটে আমাদের সমর্থন তোমাদের দিকেই।