প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীরা যখন সাত ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির ধুয়া তুলে এ বারের ভোটটা পার করে দেওয়ার খোয়াব দেখছেন ঠিক সেই সময়ে ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব’-এর একটি ভয়ঙ্কর রিপোর্ট তিরের মতো এসে ফুটো করে দিয়েছে প্রচারের সেই ঢাউস ফানুস।
প্যারিসের খ্যাতনামা এই সংস্থা, টমাস পিকেটির মতো বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ যার সঙ্গে যুক্ত, তার এই রিপোর্ট দেখাচ্ছে, গত একশো বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির শাসনকালেই দেশের আর্থিক বৈষম্য সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। ভারতের মোট আয়ের ২২.৬ শতাংশ এবং মোট সম্পদের ৪০ শতাংশেরও বেশি জমা হয়েছে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে। আর দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে পড়ে আছে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। এই ১ শতাংশের বাৎসরিক আয় গড়ে ৫৩ লক্ষ টাকা, যা বাকি ৯৯ শতাংশ ভারতবাসীর গড় আয়ের ২৩ গুণ। অবশ্য এতেও পুরোটা বোঝা যায় না। এই ১ শতাংশের মধ্যে প্রথম কয়েকজনের আয় আবার ঘন্টায় কয়েকশো কোটি টাকা। রিপোর্টটি আরও দেখিয়েছে, গত শতকের ৮০-র দশকের পর থেকে বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছিল ভারতে। ধীরে ধীরে সেই বৃদ্ধির হার দ্রুততর হচ্ছিল। অবশেষে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩-এর মধ্যে, অর্থাৎ কেন্দ্রে বিজেপি সরকারে আসার পর থেকে ধনী-গরিবে আর্থিক বৈষম্য চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।
ভারতের মতো একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে অর্থব্যবস্থার নিজস্ব নিয়মেই ধনী-গরিবে আর্থিক বৈষম্য থাকার কথা। ফলে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও স্বাধীন ভারতে আর্থিক বৈষম্য ঘোচেনি। কিন্তু পৃথিবীর বড় একটি অংশে যতদিন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অস্তিত্ব ছিল, মানুষের মধ্যে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আকাঙ্খা প্রশমিত করে রাখতে ভারতের সরকারগুলি সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়মে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা লুটে নিজেদের ভাণ্ডার ভরালেও সেই সময় নানা সরকারি বিধিনিষেধের কারণে পুঁজিমালিকরা শ্রমজীবী মানুষকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে খানিকটা বাধ্য হত।
’৯০-এর দশকের গোড়ায় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর থেকে একমেরু পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে পুঁজির শোষণ লাগামছাড়া হতে শুরু করে। ভারতেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিপতিদের শোষণের মাত্রা তীব্রতর হয়ে উঠতে শুরু করে। পাশাপাশি ক্রমাগত কমতে থাকে সমাজকল্যাণে বাজেট-বরাদ্দ। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বাড়তে থাকে পুঁজিমালিকদের দখলদারি। কার্যত সরকারগুলির একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায় বৃহৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফা-লুটের ব্যবস্থা করে দেওয়া। কংগ্রেসের পথ ধরে হেঁটে সেই কাজে বর্তমান বিজেপি সরকার আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে গোটা দেশের প্রায় সমস্ত সম্পদ হাতের মুঠোয় পুরেছে আদানি-আম্বানিদের মতো হাতে-গোনা কয়েকজন বৃহৎ পুঁজিপতি।
তাই ক্রমাগত নিঃস্ব, সর্বস্বহারা হয়ে চলেছেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষ। মানুষে মানুষে আর্থিক বৈষম্য ক্রমশ আরও বীভৎস রূপ নিচ্ছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় পুঁজিমালিকের মুনাফার দৌলতে টাকার অঙ্কে ভারতীয় অর্থনীতি যত ট্রিলিয়ন ডলারেই পৌঁছক, দেশের খেটে-খাওয়া বেশিরভাগ মানুষকে সেই বিপুল সম্পদের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েই জীবন কাটাতে হবে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই তাদের কাছে আরও কঠিন হতে থাকবে। অশিক্ষায় ডুবে থাকা আর বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে থাকাই হবে তাদের ভবিতব্য। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিণতি এমনই। সেই সত্যই উঠে এসেছে ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব’-এর সাম্প্রতিক এই রিপোর্টে।