গণহত্যাকারী ইজরায়েলের পাশে ভারত সরকার

ভারত সরকার নাকি গাজার মানবিক সঙ্কটে গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন! রাষ্ট্রসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি পি হরিশ অন্তত তেমনই জানিয়েছেন। অথচ প্যালেস্টাইনের গাজায় ইজরায়েলের বর্বর হামলা রুখতে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় ১২ জুন সংঘর্ষবিরতির যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেখানে ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪৯টি দেশই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও ভারত ভোট দিল না। সাম্রাজ্যবাদী নির্মমতার বলি গাজার হাজার হাজার অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতির তুলনায় হত্যাকারী ইজরায়েল ও তার মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের দাম যে ভারতের শাসকদের কাছে অনেক বেশি– এই ঘটনায় আবারও তা পরিষ্কার হল।

প্যালেস্টাইনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চায় উগ্র ইহুদিবাদী ইজরায়েল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক সমর্থন ও সাহায্য নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে নির্মম বোমাবর্ষণ করে তারা প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি শিশু। সীমান্তে অবরোধ জারি করে খাবার, ওষুধ, পানীয় জল সহ বেঁচে থাকার জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পর্যন্ত গত কয়েক মাস ধরে গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে না ইজরায়েল। অবিরাম বোমাবর্ষণে প্রাণহানি, পঙ্গুত্ব, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণের দায়ে ক্রমাগত এক ত্রাণশিবির থেকে অন্য ত্রাণশিবিরের দিকে ছুটে চলার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র অনাহার ও ওষুধের অভাবে গাজার আরব বাসিন্দাদের জীবন আজ চরম বিপর্যস্ত।

সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সমস্যা মেটানোর লক্ষে্য ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর পরিবেশ তৈরি করতে রাষ্ট্রসংঘে ১৭-২০ জুন ফ্রান্স ও সৌদি আরবের উদ্যোগে যে সম্মেলন হতে চলেছে, ভারত তাতে যোগ দেবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। এদিকে, মার্কিন প্রচারমাধ্যম থেকে ফাঁস হওয়া খবরে জানা গেছে, সেখানকার ট্রাম্প-প্রশাসন হুঁশিয়ারি দিয়েছে যাতে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ দেশগুলি এই সম্মেলনে যোগ না দেয় বা প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি না দেয়। ট্রাম্প সাহেবের এই হুঁশিয়ারির পরিণামেই কি ভারতের এ হেন আচরণ? প্রশ্ন উঠছে।

অথচ অতীতে ভারত প্যালেস্টাইনের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৮ সালে প্যালেস্টাইনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। এর আগে ১৯৭৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কেও স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত সরকার। পরের বছর এমনকি দিল্লিতে পিএলও-কে অফিস খোলারও অনুমতি দিয়েছিল ভারত সরকার। ১৯৮৩ সালে দিল্লিতে সপ্তম জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ভারতের সাধারণ মানুষ দীর্ঘকাল ধরেই প্যালেস্টাইনের ওপর ইজরায়েলের হামলার তীব্র বিরোধী। আজও গাজায় ইজরায়েলের বর্বর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা বার বারই তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। অথচ তাদেরই ভোটে জিতে সরকারে বসে দেশের বিজেপি সরকার রাষ্ট্রসংঘে গণহত্যার বিরুদ্ধে মুখ খোলা দূর অস্ত্, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে একটা ভোট পর্যন্ত দিল না। জনমতকে অগ্রাহ্য করে চলার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!

কিন্তু কেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই আচরণ? গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় সরকারে আসার পর থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ক্রমাগত ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। গত এক দশকে ইজরায়েলের কাছ থেকে ভারত শুধু সামরিক সরঞ্জামই কিনেছে ২৯০ কোটি ডলারের। ভারত এখন অস্ত্র আমদানিতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম এবং রাশিয়ার পরে ইজরায়েলের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে ভারত। অন্যদিকে ভারতের বেশ কিছু কোম্পানি ইজরায়েলে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম রপ্তানি করে। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া ২০২৩-’২৪ সালে ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। এ দেশের প্রথম সারির দুই একচেটিয়া ধনকুবের, যাঁরা মোদিজির অতি ঘনিষ্ঠ, সেই আম্বানি ও আদানিরা ইজরায়েলের সঙ্গে নানা ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছেন। বেশ কয়েকটি ব্যবসায় মুকেশ আম্বানির রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ইজরায়েলের ডেল্টা গালিল কোম্পানির অংশীদারিত্ব আছে। ইজরায়েলের হাইফা বন্দরের ৭০ শতাংশ শেয়ারের দখল রয়েছে আদানি গ্রুপের হাতে। এর চেয়েও বড় কথা, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বড়কর্তা আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ স্যাঙাত দেশটির নাম হল ইজরায়েল। গাজায় তাদের বর্বর আগ্রাসনের পিছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুরোদস্তুর মদত। আবার ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে তার কৌশলগত সম্পর্ক এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক হয়ে বসে থাকা পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার মোদি সরকার তার প্রভুদের মুনাফার স্বার্থে আমেরিকা-ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকছে। সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেওয়া, ভারতের উপর মার্কিন প্রভাব কতখানি তা স্পষ্ট করে দেয়। সম্প্রতি ইরান আক্রমণের বিষয়ে সমর্থন জোগাড় করার আশায় ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী যে কয়েকটি দেশের কর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁদের অন্যতম। স্পষ্ট হয়ে যায়, গণহত্যাকারী দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ইজরায়েলের সঙ্গে পুঁজিবাদী ভারত রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা কোন মাত্রায়় পৌঁছেছে।

পাশাপাশি, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের পর আজকের একমেরু দুনিয়ায় বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের বড়কর্তার নাম আমেরিকা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কায়েম করার রাজনৈতিক আকাঙক্ষা থেকেই ভারত সরকার সর্বান্তঃকরণে সেই আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতা চায়। ফলে আমেরিকাকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি হওয়া সাম্রাজ্যবাদী চক্র– যার অন্যতম অংশ ইজরায়েল– তার বিপক্ষে অবস্থান নিতে আজ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী অংশীদার ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি রাজি নয়। রাষ্ট্রসংঘের সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবে ভারতের ভোট না দেওয়ার পিছনে এটাও বড় কারণ।

রাষ্ট্রসংঘে সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবে ভোট না দিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ঐতিহ্যকে দু-পায়ে ঠেলেছেন এবং দেশের মানুষের আবেগের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। পাশাপাশি গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের ভাবমূর্তিতে কালি লেপেছেন। এর বিরুদ্ধে দেশের যুদ্ধবিরোধী, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা  ২০ – ২৬ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত