১৫ আগস্ট প্রথামাফিক দিল্লির লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবসের মহৎ তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ স্বাধীনতা? কীসের ও কাদের স্বাধীনতা? কোনও সাম্রাজ্যবাদী দেশের অধীনে ভারতবর্ষ নেই৷ রাজনৈতিকভাবে আজ দেশ স্বাধীন৷ কিন্তু ক্ষুদিরাম থেকে শুরু করে ১৯৪২–এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, নৌবিদ্রোহ সহ অসংখ্য লড়াইয়ে অগণিত শহিদের আত্মবলিদান যা চেয়েছিল– তা কি এই স্বাধীনতা? এ কথাটাই আজ সব চেয়ে বেশি ধাক্কা দিচ্ছে৷ এই মুহূর্তে যখন স্বাধীনতার ৭২ বার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে তখন দেশজুড়ে মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করে পুঁজিপতিদের লুঠের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে এবং লুঠেরাদের প্রত্যক্ষ স্যাঙাতের কাজ করছে শাসক দল সহ সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি৷ ইউএপিএ আইনের মারাত্মক সংশোধনের মধ্য দিয়ে সরকারের যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে৷ যদিও কাকে সন্ত্রাসবাদী বলা হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না৷ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহরা যাকে সন্ত্রাসবাদী মনে করবেন তিনিই সন্ত্রাসবাদী প্রতিপন্ন হবেন৷ পাশাপাশি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)–র হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে৷ যার জোরে তারা যে কোনও রাজ্যে গিয়ে সেখানকার সরকারকে অন্ধকারে রেখেও অভিযোগের তদন্ত করতে পারবে ও অভিযোগ তৈরি করবে৷ এ–ও এক স্বৈরাচারী সংশোধন৷
গত সত্তর বছরের পুঁজিবাদী আর্থিক নীতির ফল হিসাবে দেশ জুড়ে যে চরম আর্থিক সঙ্কট নেমে এসেছে তার সমস্ত বোঝা শ্রমজীবী মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে শ্রম আইন আমূল বদলে ফেলে মালিকদের হাতে শ্রমিক শোষণকে আরও তীব্র করার, আরও নির্মম করার অধিকার তুলে দিচ্ছে এই সরকার৷ বেকারি গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে৷ দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে৷ অর্থনীতিতে মন্দা এত ব্যাপক রূপ নিয়েছে যে শুধু গাড়ি শিল্পেই ১০ লক্ষ কর্মী ছাঁটাইয়ের মুখে৷ কাশ্মীরের জনগণের মতামতের কোনও তোয়াক্কা না করে চরম স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় সেখানে ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে৷ এর বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণের প্রতিবাদকে আড়াল করতে কার্ফু জারি করে, মিলিটারি নামিয়ে, ফোন–ইন্টারনেট বন্ধ করে গোটা কাশ্মীর জুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে৷ এই রকম পরিস্থিতিতে ১৫ আগস্ট দেশের মানুষের কাছে কী তাৎপর্য নিয়ে এল?
স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকা
স্বাধীনতার পাঁচ বছর আগে ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশজোড়া যে ধারাবাহিক সংগ্রামের সূচনা হয়, তা আজাদ হিন্দ সেনাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের নামে প্রহসনের প্রক্রিয়া এবং তারই প্রভাবে নৌসেনাদের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ইংরেজকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করে৷ সেই ইতিহাস আর একবার দেখে নেওয়া যাক৷
১৯৩৯ সালে ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷ ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে৷ পরের বছর জাপান সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুন দখল করে নেয়৷ এই অবস্থায় আমেরিকা ব্রিটেনের উপর চাপ দেয় ভারতীয়দের সাথে রফা করে নিতে, যাতে যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য পাওয়া যায়৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠান কতকগুলি প্রস্তাব নিয়ে৷ যুদ্ধ শেষে স্বায়ত্ত শাসন দেওয়া হবে, এই টোপ দিয়ে ভারতীয়দের এই যুদ্ধে ব্রিটিশের পক্ষে কাজে লাগানোই ছিল ক্রিপস মিশনের উদ্দেশ্য৷ রাসবিহারী বসু জাপান থেকে এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র জার্মানি থেকে এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করলেন৷ বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি, যুদ্ধে জাপানের অগ্রগতি, যুদ্ধের সময়ে বিদেশে রাসবিহারী বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি দেশত্যাগের আগে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সংগ্রামের প্রস্তুতির যে আবেদন সুভাষচন্দ্র সারা দেশে সহস্রাধিক জনসভায় জানিয়েছিলেন, জনমনে তার প্রভাব এবং দেশের অভ্যন্তরে জনসাধারণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী ধূমায়িত প্রবল অসন্তোষ– সমগ্র পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তুলেছিল৷ কংগ্রেসের নিচের তলায় সাধারণ কর্মী–সমর্থকদের মধ্যেও এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির প্রভাব লক্ষ করে কংগ্রেস ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হল৷ স্বাধীনতার দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া ছাড়া কংগ্রেস নেতাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকল না৷ ১৯৪২ সালে বোম্বাইতে এআইসিসি অধিবেশনে বিপুল ভোটাধিক্যে ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হয়৷ অথচ কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র এই প্রস্তাব উত্থাপন করলে দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল৷
পরিস্থিতির চাপে কংগ্রেস নেতারা সংগ্রামের ডাক দিলেন বটে কিন্তু সংগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিলেন না৷ ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালানোর জন্য জনতাকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে প্রস্তুত করার দরকার ছিল, তা তাঁরা করলেন না৷ নেতারাও গ্রেপ্তার এড়িয়ে দীর্ঘদিন সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন না৷ ৯ আগস্ট ভোর রাতেই অধিকাংশ নেতা গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে দেশজুড়ে উত্তাল হয়ে উঠল আন্দোলন৷ মহারাষ্ট্র, গুজরাট, বিহার, বাংলা, আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যের জেলায় জেলায় আন্দোলন ব্যাপক রূপ নিল৷ কিছু দিনের মধ্যেই এই সংগ্রাম সশস্ত্র গণসংগ্রামের রূপ নিল৷ বাংলার তমলুক, ওড়িশার বাসুদেবপুর, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, বিহারের ভাগলপুরে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হল৷ ব্রিটিশ সরকারের আক্রমণ মোকাবিলা করে কয়েক মাস সেই সরকারগুলি টিকিয়ে রাখল মানুষ৷ জনতা সারা দেশে পোস্ট অফিস, সরকারি বাড়ি, অফিস হয় দখল করে নিল অথবা পুড়িয়ে দিল৷ রাস্তা কেটে, রেললাইন উপড়ে, টেলিগ্রাফের তার কেটে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করল দেশের মানুষ৷ পুলিশ–মিলিটারির সশস্ত্র প্রহরাকে উপেক্ষা করেই নিরস্ত্র জনসাধারণ থানা, সরকারি অফিস, আদালত দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযান চালাল৷ ধেয়ে এল পুলিশী অত্যাচার৷ নির্বিচারে চলল লাঠি–গুলি৷ সরকারি উর্দিপরা বাহিনী চালাল ব্যাপক লুঠতরাজ, অসংখ্য মা–বোনকে ধর্ষণ করে এক কলঙ্কময় ইতিহাস রচনা করল৷ ৯ আগস্ট থেকে পাঁচ মাসে ৬০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হল, সাজা দেওয়া হল ২৬ হাজার জনকে৷ বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা হল ১৮ হাজার জনকে৷ পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন ২৫ হাজার মানুষ৷ বিদেশ থেকে সুভাষচন্দ্র আন্দোলনকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তীব্রতর করার কথা বললেন৷ কিন্তু এত রক্ত ঢেলেও দেশবাসী দেশের ভেতরে আপসকামী গান্ধীবাদী নেতাদের মন পেল না৷
গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতৃত্ব ভারতীয় পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থে প্রথম থেকেই বিপ্লবী সংগ্রামের বিরোধী ছিল৷ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন হিংসাত্মক হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য জেলের মধ্যে গান্ধীজি ২১ দিন অনশন করলেন৷ জহরলাল ও আবুল কালাম আজাদ আন্দোলনে জনগণের এই সক্রিয় ভূমিকাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করলেন৷
স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীদের ভূমিকা
অন্য দিকে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যা দিয়েছিল৷ তারাও এই আন্দোলনের বিরোধিতা করল৷ স্বতঃস্ফূর্ত ও যৌবনোদ্দীপ্ত এই বিদ্রোহকে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বললেন, ‘‘আমি মনে করি না যে, গত তিন মাসের মধ্যে যে সব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা এবং নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে, তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভে সহায়তা হবে’’ (রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায় –শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)৷ মর্যাদায় ভাস্বর এই বিদ্রোহকে শুধু ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তিকে অর্থাৎ ব্রিটিশকে সহযোগিতা করার কথাও তিনি বলেছেন৷ তাঁর ভাষায়– ‘‘এখন যুদ্ধকালীন অবস্থায় ভারতবর্ষের … জাতীয় গভর্নমেন্ট এমন ভাবে গঠিত হবে, যাতে মিত্রপক্ষের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতায় যুদ্ধ করা সম্ভব হয়৷’’ শুধু শ্যামাপ্রসাদই নন, হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরও বিয়াল্লিশ সালের আন্দোলনের সময় ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ও মুসলিম বিরোধী প্রচারকে তীব্র করতে বলেছিলেন৷ তাই মহাসভার সদস্যদের স্থানীয় সংস্থায়, আইনসভায়, চাকরিতে যে যেখানে ছিলেন, তাঁদের নিজ নিজ পদ থেকে না সরে নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করতে নির্দেশ দিলেন৷ তাঁর যুদ্ধকালীন স্লোগান ছিল ‘রাজনীতির হিন্দুকরণ’ এবং ‘হিন্দুত্বের সামরিকীকরণ’৷ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়ে তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু জাগরণ’৷ কিন্তু মানুষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী চেতনা সেদিন এতই প্রখর হয়ে উঠেছিল যে তারা হিন্দু মহাসভার নেতাদের এই ফাঁদে পা দেয়নি৷
অবিভক্ত সিপিআইয়ের ভূমিকা
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অবিভক্ত সিপিআই–এর (যা ভেঙে পরে সিপিএম এবং নকশালবাদীদের জন্ম) ভূমিকাও ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসাবে চিহ্ণিত হয়ে আছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির শরিক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি থাকার কারণ দেখিয়ে সিপিআই এ সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করে এবং যুদ্ধে তাদের সব রকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সিপিআই একটি যথার্থ মার্কসবাদী দল হিসাবে গড়ে উঠতে না পারার কারণে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির সাথে পরাধীন জাতির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রণকৌশলকে নেতারা গুলিয়ে ফেলেন৷ এই প্রশ্নে মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ সুস্পষ্ট ভাবে দেখান, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বকারী পার্টি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিকতাবাদী দায়িত্ব–কর্তব্য একে অপরের পরিপূরক হলেও কখনোই এক নয়৷ সাম্যবাদী বিচারধারা আয়ত্ত না করতে পারার ফলে সিপিআই নেতৃত্ব এই পার্থক্য ধরতে পারেননি৷ এভাবে সিপিআই একটি মার্কসবাদ বিরোধী ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে৷ জনমানসে কমিউনিজম সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরিতে সহায়তা করে৷ ১৯৫২ সালে মহান স্টালিন জাতীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর নীতির তীব্র সমালোচনা করেন৷
ইতিমধ্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আইএনএ বাহিনীর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের সংবাদ এ দেশে এসে পোঁছায়৷ যার প্রভাবে পুনরায় একটা বিপ্লবী মানসিকতা তৈরি হয়৷ কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আইএনএ–র এই দেশপ্রেমী সংগ্রামের বিরুদ্ধতা করে সিপিআই, কংগ্রেস এবং আরএসএস৷ তারা সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেয়৷
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোসিমায় এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে আমেরিকা পরমাণু বোমা ফেলায় জাপান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়৷ এর ফলে আইএনএ–ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়৷ আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের গ্রেপ্তার করে দিল্লিতে আনা হয়৷ সাথে সাথে নেতাজির নেতৃত্বে আইএনএ–র সমস্ত কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে৷ দেশজুড়ে জনসাধারণ নেতাজি ও আইএনএ–র প্রতি ভালবাসায় ও আবেগে আপ্লুত হয়৷ ব্রিটিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে ভারতীয় সৈনিকদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে৷ ৫ নভেম্বর সারা দেশ আজাদ হিন্দ পতাকা দিবস পালন করে৷ সেনাদের বিচার শুরু হওয়ার পর সারা দেশে গণবিক্ষোভ উত্তাল হয়ে ওঠে৷ তা এতখানি তীব্র হয় যে সরকার শুনানি স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়৷ গণবিক্ষোভের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায় জনমনে কংগ্রেস সম্পর্কে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল তা প্রশমিত করতে কংগ্রেস নেতারা আইএনএ সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য পাল্টে ফেলেন৷ যে জহরলাল একদিন নেতাজিকে যুদ্ধ–পরাধী হিসাবে বিচার করার কথা বলেছিলেন, তিনিই আইএনএ–র পক্ষে দাঁড়িয়ে যান৷
এরই প্রভাবে ১৯৪৫ সালে মুম্বইয়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে৷ কিন্তু শেষপর্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ যুক্তভাবে নৌবিদ্রোহ নিরস্ত করতে ঘৃণ্য ভূমিকা নেয়৷ কংগ্রেস নেতৃত্বের দ্বারা প্রতারিত হয়ে নৌসেনারা বিদ্রোহ তুলে নিলে ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহী সেনাদের গুলি করে হত্যা করে৷ সমগ্র দেশে এ নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়৷ ইতিমধ্যে মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করে এবং মহান মাও সে তুং–এর নেতৃত্বে চীনের মুক্তিবাহিনীর বিপুল জয়ের সংবাদ এ দেশের জনমনে কমিউনিজমের প্রতি প্রবল আবেগ সৃষ্টি করে৷ এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় পুঁজিবাদ, জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ দ্রুত ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করে৷ স্বাধীন ভারতে সরকারে বসে কংগ্রেস৷
দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে শ্রমিক–কৃষক সহ সাধারণ মানুষের স্বার্থকে তারা পদদলিত করেছে৷ কংগ্রেস সরকারের নীতিতে একদিকে পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ তীব্রতর করারব্যবস্থা পাকা হয়েছে, অন্য দিকে একের পর এক কালা আইন জারি করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির সাথে আপস করা হয়েছে৷ আমলাতন্ত্র গেড়ে বসেছে৷ সরকার এবং প্রশাসন দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছে৷ এই ভাবে কংগ্রেস দেশে ফ্যাসিবাদের যে জমি প্রস্তুত করেছে তার সুযোগেই আজ বিজেপির মতো একটি চরম সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে এবং জনগণের উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে আরও তীব্র করে তুলেছে৷ নামেমাত্র যতটুকু গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যাক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল তা সবই আজ কেড়ে নিচ্ছে৷
ফলে একথা আজ পরিষ্কার, পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এদেশের সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েরা হাজারে হাজারে প্রাণ দিয়ে জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে, কারা রুদ্ধ হয়ে, অসহ্য দুঃখ–যন্ত্রণা সহ্য করে স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখেছিল তা অর্জিত হয়নি৷ সত্যিকারের গণমুক্তি আসেনি৷ এ কথাও আজ স্পষ্ট, পুঁজিপতি শ্রেণিরই রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা কংগ্রেস–বিজেপির মতো বুর্জোয়া দলগুলির শাসনে সত্যিকারের গণমুক্তি আসতে পারে না৷ আজ তার জন্য প্রয়োজন একটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুঁজিবাদী এই শাসনের বিরুদ্ধে সেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মতো করে জনগণের সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তোলা৷ তার জন্য একদিকে প্রয়োজন নেতৃত্বদানে যোগ্য সেই যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টিকে চিনে নেওয়া, অন্য দিকে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা, উন্নত নীতি নৈতিকতার ভিত্তিতে সংগ্রামী চরিত্র গড়ে তোলা৷ ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং ১৫ আগস্ট গণমুক্তি সঙ্কল্প দিবস সেই আহ্বান নিয়েই আজ দেশের মানুষের সামনে উপস্থিত হয়েছে৷