বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের মধ্যে ছাত্ররা দল বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলছে একজন মানুষকে– এই ঘটনায় শিউরে উঠেছেন সাধারণ মানুষ। লোকসভা ভোট শেষ হতে না হতেই উত্তর ২৪ পরগণার একাধিক জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা দিয়ে শুরু। পরে অন্যান্য জেলাতেও তা ছড়িয়েছে। মনে হচ্ছে যেন কাউকে অপরাধী মনে হলে তাকে পিটিয়ে গায়ের ঝাল মেটানোই অপরাধ দমনের একমাত্র পথ বলে মানুষ ধরে নিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার ঘটনা। সেখানে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, শাসক দলের এক নেতা ‘সবক’ শেখানোর জন্য প্রকাশ্যে পেটাচ্ছেন দু’জনকে। শহরে গ্রামে মফসসলে শাসক দলের নেতারা বুঝে নিয়েছে তারাই আইন, তারাই প্রশাসন। পুলিশ এবং প্রশাসনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কোন তলানিতে গেলে এমনটা ঘটতে পারে তা সরকারের মাথারা ও পুলিশ কর্তারা ভেবেছেন কি না জানা নেই।
মুখ্যমন্ত্রী বলে চলেছেন তিনি ২০১৯-এ গণপিটুনি প্রতিরোধের আইন করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের নিযুক্ত রাজ্যপাল তাতে সই না করার ফলে গণপিটুনি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। যদিও পুরনো ভারতীয় দণ্ডবিধিতে খুন, মারধর ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে সমস্ত আইন ইতিমধ্যেই আছে সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে পুলিশ এত বছর ধরে গণপিটুনিতে যুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কেন– এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? মুখ্যমন্ত্রী এখন কড়া ব্যবস্থার বার্তা দিচ্ছেন, চোপড়ার ঘটনার পর সালিশির নামে পেটানো বরদাস্ত করা হবে না বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসন কতটা উদাসীন থাকলে বিষয়টা এতদূর গড়াতে পারে তা কি তিনি স্বীকার করবেন?
অন্যদিকে কেন্দ্রের শাসক বিজেপির দাবি, সম্প্রতি চালু হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় গণপিটুনি রোধে কড়া আইনের সংস্থান রয়েছে। ফলে এবার এ সব বন্ধ হবে। কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যেও চলতি আইনি ক্ষমতাকে হাতিয়ার করেই পুলিশ একের পর এক ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কেন, তার উত্তর কে দেবে?
এ রাজ্যের মতোই সারা দেশে গণপিটুনির অধিকাংশ ঘটনাতেই স্থানীয় দাপুটে ক্ষমতাবানদের যোগ অবশ্যম্ভাবী। যারা নিজেরাই এলাকার আইন তথা মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে অবস্থান করেন। এ দেশে, কি রাজ্যে কি কেন্দ্রে শাসকদের হয়ে কাজ করা প্রভাবশালীরা থাকেন একটা অদৃশ্য লক্ষ্মণের গণ্ডির মধ্যে। পুলিশ-প্রশাসনের সাধ্য নেই তা ভেদ করার। তাঁরাই রাখেন, তাঁরাই মারেন। সুবিধা বিতরণও তাঁরাই করেন। ফলে তাঁরা ইচ্ছা করলেই লোক জড়ো করে তাঁদের চোখে সন্দেভাজন যে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও পারেন। তাই বিজেপি রাজত্বে মহম্মদ আখলাক, জুনেইদ, পহেলু খানদের মতো মানুষকে গো-রক্ষার অজুহাতে পিটিয়ে মেরে ফেললে কোনও শাস্তি হয় না। দলিত ও সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী মানুষদের চাপে রাখতে এটাই বিজেপির অস্ত্র বলে পুলিশও বিশেষ কিছু করে না। অবশ্য পুলিশ এবং প্রশাসনও বিজেপি রাজত্বে প্রায় এই গণপিটুনির মনোভাব নিয়েই চলে। সে জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিংবা দলিত অথবা সরকারি দলের সঙ্গে না থাকা যে কোনও মানুষের ঘরবাড়ি নির্বিচারে বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দিয়েও কোনও বেআইনি কাজ হয়েছে বলে উত্তরপ্রদেশে কিংবা মধ্যপ্রদেশের প্রশাসন মনেই করে না।
পশ্চিমবঙ্গে দাপটের রাজনীতি আমদানি করতে গিয়ে তৃণমূল এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে ২০১৪ সালে এনআরএস মেডিকেল কলেজের টিএমসিপি-র বাহুবলীরা হোস্টেলে নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মেরে নিজেদের শক্তি জাহির করেও শাস্তি পায়নি। বরং যে ছাত্ররা ঘটনার বিরোধিতা করেছিল সে দিন তাদেরই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছে। সম্প্রতি উদয়ন হোস্টেলের ঘটনায় একই জিনিস দেখা গেল। সমাজে মেধাবী বলে পরিচিত ছাত্রদেরও এমন নির্বিকার খুনি বানিয়ে দিতে পারে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তা কতটা সর্বনাশা এই দুটি ঘটনাতেই পরিষ্কার নয় কি?
সাধারণ মানুষের ধারণাই হয়ে গেছে এলাকায় কোনও অপরাধ ঘটলে পুলিশের কাছে গিয়ে কিছু হবে না, বিচারের নামে দীর্ঘসূত্রতা চলবে, অপরাধীদের কোনও শাস্তিই হবে না। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক সময় মানুষকে মরিয়া করে তোলে। তারা মনে করে কেউ যখন কিছু করবে না, আইনের শাসন যখন অলীক ব্যাপার আমাদেরই নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে। মানুষের এই অসহায় অবস্থা জানেন বলেই বলিউডের হিরো থেকে রাজনীতি জগতের হিরোরাও চোখা চোখা বাক্যবাণে অপরাধীদের সরাসরি নিকেশ করার নিদান দিয়ে হাততালি কুড়োন। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে বিজেপি তৃণমূল উভয় দলের নেতারাই ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে দেব’, ‘হাত পা কেটে নেব’ এমন কত না হুঙ্কার দিয়েছেন। তাঁদের অনুগামী সহ সমাজের বড় অংশের মানুষের মধ্যে এর বিষময় প্রভাব তো থাকবেই।
এমনিতেই এ দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার আছে। গুজব রটানো, গুজবে বিশ্বাস করানোর কাজটা এতে আরও সহজ হয়ে যায়। গোটা সমাজে যখন যুক্তিহীনতা, অন্ধ বিশ্বাসের বাতাবরণ গভীর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তখন তার বিষে জর্জরিত মানুষগুলিকে গণপ্রহারে সামিল করা অনেকটা সহজ কাজ। এ দেশে বিজেপি, তৃণমূল বা কংগ্রেসের মতো পরিচিত দক্ষিণপন্থী দলগুলো তো বটেই এমনকি সিপিএমের মতো বামপন্থী বলে দাবি করা দলও নিজেদের আখের গোছানোর স্বার্থে নিজেদের প্রভাবে থাকা মানুষের মধ্যে যুক্তিহীন অন্ধত্ব তৈরি করতে চায়। এই অন্ধ চিন্তার বাতাবরণ দলীয় রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাজে প্রভাব ফেলে। এই বাতাবরণে মানুষকে মিথ্যা অভিযোগে ক্ষেপিয়ে তোলার সুযোগ পায় দুষ্ট শক্তি। যে সব নেতারা এই অসুস্থ বাতাবরণ সমাজে তৈরি করার জন্য দায়ী গণপিটুনির দায়ও তাদেরই নিতে হবে তো!
এরই সঙ্গে আজ পশ্চিমবঙ্গে উঠে আসছে শাসক দলের নেতাদের মদতে সালিশি করে সমস্যা মেটানোর নামে মানুষের ওপর অত্যাচারের কথা। চোপড়ার ঘটনা নিয়ে বেশি হইচই হলেও এমন ঘটনা যে সারা রাজ্যেই ছড়িয়ে আছে তা মানুষের জানা। কত মর্মান্তিক মৃত্যুও এর সাথে জড়িয়ে আছে! উত্তরভারতের কুখ্যাত খাপ পঞ্চায়েতের মতোই শাসক দলের নেতারাই নিতান্ত পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিসরেও নাক গলিয়ে এই অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। এখন উঠে আসছে এই সালিশি এবং অত্যাচারের পিছনে থাকা স্তরে স্তরে নেতাদের দুর্নীতি, জমি দখল, অবৈধ নানা কারবারের স্বার্থের কথা। তৃণমূলের ছোট থেকে বড় সব স্তরের নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি মানুষকে এতটাই অতিষ্ঠ করে তুলেছে যে মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত নিজের দলের নেতা-মন্ত্রী-কাউন্সিলার-পঞ্চায়েত কর্তাদের বিরুদ্ধে ‘টাকা খাওয়া’র কথা প্রকাশ্যে বলতে হচ্ছে! যদিও চোপড়ার তৃণমূল নেতা ‘জেসিবি’-র মতো অনেক নেতাই যে বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে তা কি মুখ্যমন্ত্রী অস্বীকার করতে পারবেন? তিনি যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তা বহু আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তাঁর পূর্বসূরী সিপিএম সরকার এ সব কাজ যেখানে শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করে তিনি এর ব্যাপ্তিটা বাড়িয়েছেন। সিপিএম আমলে গ্রামে শহরে পাড়ায় পাড়ায় এই জিনিসই একটু অন্য রূপে ছিল। তখন দেখা যেত শাসক পার্টির স্তরে স্তরে নেতারা দুর্নীতি ও দাপটকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তৃণমূলের আমলে সেটা কিছুটা লাগামহীন। মাত্রা আর ব্যাপ্তির হেরফের ছাড়া বিশেষ তফাত নেই।
প্রশাসন পুলিশ চাইলে এর ওপর কিছুটা হলেও লাগাম পরাতে পারে। কিন্তু নিছক কিছু নতুন আইনেই তা হবে না। প্রয়োজন শাসকদের সদিচ্ছা। সে সদিচ্ছার অভাব এতটাই প্রকট যে তা ফিরিয়ে আনতে একটাই পথ খোলা– সাধারণ মানুষের সচেতন সংঘবদ্ধ ভূমিকা। এই ভূমিকাই একমাত্র প্রশাসনকে বাধ্য করতে পারে কিছুটা হলেও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে যথাযথ ভূমিকা নিতে।