পুঁজি মালিকদের টাকার থলিই যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক–সেই সত্য বহুদিন আগেই মার্কসবাদীরা তুলে ধরলেও, একদল বুদ্ধিজীবী তা মানতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু এ সত্য আজ এতটাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে যে গণতন্ত্রের তথাকথিত পীঠস্থান আমেরিকার সমাজ বিজ্ঞানীরাও আর তা অস্বীকার করতে পারছেন না।
তাঁদের কথাতেই উঠে এসেছে ‘রগ বিলিওনেয়ার’ বা গুণ্ডা ধনকুবের শব্দটা! হ্যাঁ, আমেরিকান বিলিওনেয়ারদের এখন এই নামেই অভিহিত করছেন সে দেশেরই সমাজবিদ্যা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা। বর্তমান ধনতান্ত্রিক বিশ্বে আমেরিকা এবং আরও অনেকগুলো পুঁজিবাদী রাষ্টে্রর যে সব ধনকুবের অর্থের জোরে সমাজনীতি, অর্থনীতি সমস্ত কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদেরই এই নামে অভিহিত করছেন তাঁরা। অর্থের জোরে এরা পছন্দের রাজনৈতিক দলের পেছনে যথেচ্ছ টাকা ঢেলে তাদের নির্বাচনে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসাচ্ছে এবং তার মাধ্যমে গোটা অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে তারা নিজেদের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসছে। এমনকি এর জোরেই ন্যায়-অন্যায় বোধ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিচারবুদ্ধিকেও তারা গুলিয়ে দিতে সক্ষম। এজন্যই তাদের অর্থবলকে বলা হচ্ছে–স্রেফ গুণ্ডামি।
কানাডার রাষ্ট্রনীতিবিদ টমাস হোমার ডিক্সন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রনীতিবিদ থেডকা স্কোকপল প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানী এর নাম দিয়েছেন ‘ডার্টি মানি’ বা ‘নোংরা টাকা’। অর্থাৎ যে টাকার জোরে দিনকে রাত করা হচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা এই ‘নোংরা টাকা’-র জোরে আমেরিকার গোটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার টিকে থাকা খোলসটারও মৃত্যুঘন্টা বাজতে চলেছে অচিরেই। এই ‘নোংরা টাকা’র মালিকদের প্রবল শক্তিশালী দাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমাজবিদরা আমেরিকান ধনকুবের ‘কোচ ব্রাদার্স’এর কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এখন বলছেন, এই গোষ্ঠীর টাকার দাপটে একসময় চালু থাকা অবাধ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সমাজবিদরা অবাক হয়ে দেখছেন, এইসব ধনকুবেররা টাকা ঢেলে নানা রকম পেটোয়া সামাজিক সংস্থা খুলে রেখেছে। যারা সুকৌশলে সমাজে এমন সব চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দিচ্ছে যার ফলে সাধারণ আমেরিকানরা ন্যায় অন্যায় কিছুই আর বুঝতে চাইছে না। অধিকাংশ সাধারণ আমেরিকানই এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, কালো টাকা, সাদা টাকা সবই সমান। ডিক্সন, স্কোকপল প্রমুখ রাষ্ট্র-বিজ্ঞানীরা দেখাচ্ছেন, এই গুণ্ডা ধনকুবেররা এমন একটা বিশ্ব সমাজব্যবস্থা চায়, যেখানে নিয়ম শৃঙ্খলা বলে কিছুই থাকবে না। জনসাধারণ বিজ্ঞান, আবহাওয়ার পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসুরক্ষা কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করবে না। এমন একটা নৈরাজ্যবাদী সমাজভাবনার প্রসারের জন্য তারা অজস্র অর্থ ঢালছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রম, গবেষণার বিষয়বস্তু সমস্ত কিছুকে এমনভাবে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হচ্ছে যাতে পুঁজিপতিশ্রেণির অবাধ শোষণ টিকিয়ে রাখার পরিপূরক চিন্তাধারার প্রসার সমাজে ঘটানো যায়। সেই উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন ফাউন্ডেশন তৈরি করে তাদের মাধ্যমে মোটা অর্থ সাহায্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও কিনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরা অনুগত অধ্যাপক, গবেষক, বৈজ্ঞানিকদের বিভিন্ন সম্মেলনে পাঠাচ্ছে, যাঁরা প্রচার করছেন যে, বিশ্ব উষiরায়ন, বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং তার ফলে গ্রিন হাউস এফেক্ট, আবহাওয়ার পরিবর্তন এসব নাকি কোনও গুরুতর সমস্যাই নয়। এইসব তত্ত্বের উদগাতাদের বিপুল টাকা দিয়ে পুষছে ধনকুবেররা। নিজেদের অনুগত দল রিপাবলিকান পার্টিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য গত চার দশক ধরে কোচ ব্রাদার্স খরচ করেছে প্রায় ১৫০০ কোটি ডলার এবং তার মধ্যে ২০১৬-র নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ রিপাবলিকানদের জেতাতে খরচ হয়েছে ৯০০ কোটি ডলার। ডিক্সন প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ২০৩০ বা তার আগেই হয়তো দেখা যাবে আমেরিকার এককালের ভুবনবিখ্যাত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুরোপুরি মৃত্যু ঘটেছে এবং দেশ শাসন করছে কোনও চরম দক্ষিণপন্থী একনায়ক। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পৃথিবীর আরও অনেক গণতান্ত্রিক দেশেরই সাধের পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার একই হাল বলে তাঁরা দেখাচ্ছেন।
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন উদারমনের বুর্জোয়া মানবতাবাদী তাত্ত্বিকরা অনেকেই আজও এই বিশ্বাস নিয়ে চলেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও কোনও মানবকল্যাণকামী, সৎ রাষ্ট্রনায়ক এবং দলকে যদি ভোটে জেতানো যায় তা হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। তাতে বিশ্বজোড়া এই শোষণ, অসাম্য, অনাহার, দারিদ্র, যুদ্ধ ইত্যাদি অভিশাপকে দূর করা সম্ভব। হেনরি ডিক্সন প্রমুখের মন্তব্য প্রমাণ করছে, এঁদেরও বর্তমানে তথাকথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং তার স্বনিযুক্ত অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে মোহভঙ্গ হচ্ছে।
মরণোন্মুখ অবক্ষয়ী একচেটিয়া পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদ কায়েম করার উদগ্র আকাঙক্ষায় সমাজজীবনের সর্বত্র যেভাবে তার টাকার দাপট খোলাখুলিভাবে প্রয়োগ করছে তাতে তাঁরা গণতন্তে্রর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এই সমাজবিদরা এরকমও মনে করছেন যে, আমেরিকায় সামাজিক হিংসা এমনই উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে, সে দেশে যে কোনও সময়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনই বলেছেন, আমেরিকায় হিংসা একটা সামাজিক নিয়মে পরিণত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে আমেরিকায় প্রতি ১০০ জন নাগরিকের হাতে আছে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রতিদিন ৩০ জনেরওবেশি নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। সব মিলিয়ে সাধারণ বন্দুকবাজ গুণ্ডা ও গুণ্ডা ধনকুবেরদের দাপটে আমেরিকার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, অবাধ প্রতিযোগিতার স্বর্গরাজ্যের আজ যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, শান্তি আন্দোলনের নেতা জন স্কেলস আভেরির মতে, ‘আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এখন আর জনগণের মধ্য থেকে, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য গঠিত নয়। বরং জনগণের ওপর চেপে বসা, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক এবং একচেটিয়া ধনকুবেরদের দ্বারা পরিচালিত সরকার।’ যদিও বুর্জোয়া গণতন্তে্রর এই রূপ একশো বছর আগেই তুলে ধরেছেন, মহান লেনিন, তিনি বলছেন, ‘‘তোমরা বল তোমাদের রাষ্ট্রে স্বাধীনতা অবাধ, কিন্তু … এই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রটি যতই স্বাধীনতার বড়াই করুক তা শ্রমিকদের দমনের জন্য পুঁজিপতিদের হাতে হাতিয়ার, তার আপাত চেহারাটি যত অবাধ, ততই তার দমনমূলক চরিত্রটি প্রকট। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হল ইউরোপে সুইজারল্যান্ড আর আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। … এখানে শ্রমিক যদি তার জীবনমানের সামান্য উন্নতি ঘটানোর দাবি করে তা হলেই গৃহযুদ্ধ চাপানো হয়। … মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা সুইজারল্যান্ডে যত নির্মমভাবে শ্রমিক আন্দোলন দমন করা হয় তেমনভাবে দুনিয়ায় আর কোথাও হয় না। আবার এখানকার সংসদে পুঁজির প্রভাব যত তীব্র তেমনটি দুনিয়ায় আর কোথাও নেই। পুঁজি এখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, শেয়ারবাজার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সংসদ, নির্বাচন এ সবই তাদের হাতের পুতুল।” (ভি আই লেনিন, ১৯১৯ সালের ১১ জুলাই, শার্দলভ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ)
তবে শুধু আমেরিকা নয়, ভারত সহ সব বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছবিটা একই রকম। ভারতে কী ভাবে কেন্দ্র রাজ্য সব সরকারই খোলাখুলিভাবে একচেটিয়া মালিকদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে চলছে, কোন দল সরকার গড়বে, কে কে মন্ত্রী হবে, এ সবই যে ধনকুবের গোষ্ঠীগুলি ঠিক করে দেয়– ভারতে এটা কোনও অজানা তথ্য নয়। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির যতদিন শক্তিশালী ছিল ততদিন তবু পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের কর্তারা কিছুটা গণতন্ত্রের ভেক রাখার দায় অনুভব করতেন। এখন সমাজতান্ত্রিক শিবির না থাকায় তারা একেবারে বেপরোয়া। লেনিনের সুযোগ্য ছাত্র বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, আজকের দিনে ‘‘উন্নত ও অনুন্নত উভয় পুঁজিবাদী দেশই …ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করছে।” তিনি আরও দেখিয়েছেন, ‘‘… যখন প্রচলিত স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সংগঠন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনযন্ত্র পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে যায়, যখন বাজারের কোনও রকম স্থায়িত্ব রক্ষা করা ও সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, যখন সংকটের ফলে জীবনে অনিশ্চয়তার কঠিন আঘাতে জনসাধারণ বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকে– তখন এই পরিস্থিতিতে বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের মৌলিক নিয়মকে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে বজায় রাখার জন্য, সংসদীয় গণতন্ত্রের আলখাল্লা পরিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্বকে আড়াল করার যাবতীয় প্রকরণকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
এই সব ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ফ্যাসিবাদের মধ্যে কয়েকটি সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়, … প্রধানত অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা সর্বাধিক কেন্দ্রীভূত করা এবং প্রশাসনে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক দৃঢ়তা (রিজিড ফার্মনেস) এইগুলি বেশি বেশি করে রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের একাত্মতা গড়ে তোলে…” (রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড, সময়ের আহ্বান)।” তিনি আরও দেখিয়েছিলেন, ধনকুবেরদের টাকার জোরে মিডিয়া পাওয়ার, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার নির্ধারণ করে ভোটে কে জিতবে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে কেউ না মানতে পারেন, কিন্তু বাস্তবকে অস্বীকার করার উপায় আছে কি? মার্কসবাদী বিজ্ঞান যে সত্যকে তুলে ধরেছে তাকে বাস্তব সত্যের আলোয় দেখে মানতে বাধ্য হচ্ছেন মার্কিন সমাজবিদরা।