বামপন্থী হয়ে ‘হাত’-এ ভোট দিতে পারব না, ডাক্তার সাবকে দেব
দলের কর্মীরা কলকাতার এন্টালি এলাকায় নির্বাচনের প্রচার করছিলেন। গত মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে একটি বামপন্থী দলের হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তি কর্মীদের বললেন, আমিও একজন কমিউনিস্ট। আমি ডাক্তার সাবকে চিনি। ওনার বক্তব্য শুনেছি। আমি হাতে ভোট দিতে পারব না, ডাক্তার সাবকে দেব। কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের পার্টি জোট করেছে, এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। বামপন্থীদের মধ্যে জোট হলে ভাল হত।’ বললেন, ‘এস ইউ সি আই-এর সমস্ত আন্দোলনকে আমি সমর্থন করি। বামপন্থীদের এই ভাবেই আন্দোলন করা উচিত। বামপন্থীদের আদর্শের সঙ্গে কংগ্রেসের মতো সাম্প্রদায়িক একটা দলের আদর্শ মেলে না, তাই তাদের সঙ্গে কোনও জোট হতেই পারে না।’
* * *
যোগ্য শুধু তোমরা
বেহালার সরসুনায় এক বন্ধুর দোকানে গিয়েছিলেন দলের এক কর্মী। বন্ধুটি তৃণমূলকে সমর্থন করতেন। বর্তমান তৃণমূলের ব্যাপক দুর্নীতি দেখে তিনি প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন, আর তৃণমূলকে সমর্থন করা যায় না। আমি বিজেপিকে ভোট দেব ভাবছি। শুরু হল বিতর্ক। এর মধ্যেই দোকানে আসেন আরেক জন পরিচিত। দলের কর্মীটিকে দেখেই তিনি বলেন, পার্থদা, আমাদের ক্লাবের বন্ধুরা সবাই ঠিক করে নিয়েছি এবার তোমাদের ভোট দেব। বিতর্কে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং দোকানদার বন্ধুকে বোঝাতে থাকেন কেন অন্য কোনও পার্টির ভোট চাওয়ার যোগ্যতা নেই, কেন বিজেপি তৃণমূল সবাই সমান। বলেন, সকলেই কোথাও না কোথাও ক্ষমতায় আছে, ফলে ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে এরা কেমন শাসন দেবে। ধীরে ধীরে আশপাশের দোকানদার এবং ওই দোকানের ক্রেতারাও আলোচনায় যুক্ত হয়ে পড়েন। ওই ভদ্রলোক সকলকে বোঝান কেন এস ইউ সি আই-কেই ভোট দেওয়া উচিত। কর্মীটিকে আর বিশেষ কিছু বলতে হয়নি।
* * *
এই দলটাই থাকবে
বেহালা এলাকায় দলের প্রচার চলছিল। একজন ভদ্রলোককে কর্মীরা দলের জন্য ভোটের কথা বলতেই তিনি বলতে শুরু করে দেন, ৪২টা সিট পশ্চিমবঙ্গে, সারা দেশে ১৫১টা, সর্ববৃহৎ বাম দল– এই তো? কর্মীরা বলেন, কী করে জানলেন? বললেন, সেদিন আপনাদের প্রার্থীর বক্তব্য দাঁড়িয়ে শুনলাম। ভোট আপনাদেরই দেব। ভোটার স্লিপ দেবেন। ভোটার কার্ডের নাম্বার দিয়ে দেব। বলে ফোন নাম্বার দিলেন। বললেন, হোয়াটসঅ্যাপে আমার আর মিসেসের ভোটার কার্ডের ছবি পাঠিয়ে দেব। শেষে বললেন, আমি চাই এমন একটা পরিস্থিতি আসুক যখন বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একমাত্র এস ইউ সি আই-ই থাকবে।
* * *
পরিবারের সব ভোট আপনাদের
মুদির দোকানদার, গণদাবীর নিয়মিত পাঠক। ব্যবসার ব্যস্ততার মাঝে তাঁর সঙ্গে কর্মীটির খুব বেশি কথা হত না। শুধু জানতেন উনি বামপন্থার সমর্থক। দলের ‘বামপন্থীদের প্রতি আবেদন’ বক্তব্যটি ওনাকে দিতেই বললেন, ভোট করো, কিন্তু আন্দোলনের খুব প্রয়োজন। আমি ব্যবসা করি। আমি মানুষের আর্থিক কষ্ট অনেক কাছ থেকে দেখছি। কর্মীটি বলেন, আন্দোলনে আপনাকেও চাই। বললেন, আন্দোলনে আমি নিজে থাকব এবং আরও লোক যাতে থাকে তার চেষ্টা করব। কর্মীটি বলেন, আপনার ভোটটা তো চাই। উত্তরে তিনি বলেন, ভোটার স্লিপ দিয়ে যাবেন। আমাদের পরিবারের চোদ্দটা ভোট আপনারা পাবেন।
পাড়ার পরিচিত এক শিক্ষক দলের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা সব জায়গায় এজেন্ট দিচ্ছেন? কর্মীটি জিজ্ঞেস করলেন, কেন বলুন তো? বললেন, আমাকে যদি বুথে সিপিএমের এজেন্ট দেখেন, অবাক হবেন না। এজেন্ট হলেও আমার ও স্ত্রীর ভোট এবং আমার দুই বন্ধুর ভোট আপনারাই পাবেন।
* * *
কে আমার স্বার্থে লড়ে, ভাবলে এস ইউ সি-র কথাই মনে পড়ে
মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের ভোট যত ঘনিয়ে আসছে ততই আশেপাশে থাকা মানুষগুলোর চোখমুখের ভাষা যেন বদলে যাচ্ছে। মেদিনীপুর শহরে সন্ধ্যাবেলা একজনের বাড়িতে ঢুকতেই এক ভদ্রমহিলা উজ্জ্বল দৃষ্টিতে বলে উঠলেন, তোমার কথাই ভাবছিলাম। ভোটটা এতদিন যাদেরকে দিয়ে এসেছি এবার তাদের কাউকেও দেব না ভেবে বসেছিলাম। তুমি আসতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! ওই স্বাস্থ্যকর্মীর স্বামী একজন সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। এরপর ২০০ টাকা হাতে ধরিয়ে বললেন, এ বার এর বেশি দিতে পারছি না। দিন দিন গরিব হয়ে যাচ্ছি। আমার চাকরিটুকু না থাকলে দুই মেয়েকে নিয়ে সংসারে খাবার জোগাড় করতেই দম বেরিয়ে যেত।
সে দিনই সকালে সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে হঠাৎ কাঁচি-হাতে ছেলেটি বলে উঠল, এবার যে কাকে ভোট দিই? বললাম, যে তোমার প্রকৃত বন্ধু তাকেই খুঁজে দেখো। ছেলেটি অবাক, প্রকৃত বন্ধু! বললাম, তোমার শিক্ষা ও কাজের দাবিতে সারা বছর ধরে যারা প্রাণপাত লড়াই করে তারাই তো তোমার প্রকৃত বন্ধু। ছেলেটি বলল, সে লড়াই তো এসইউসিআই দলকেই করতে দেখি। আমি চুপ করে আছি। ছেলেটি বলতে শুরু করল, ভেবেছিলাম বংশগত ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসব। পড়াশোনা করলাম, কিন্তু চাকরি হল না! এই লড়াইয়ে জয়ী হতে গেলে এই দলটাকেই দরকার।
* * *
দুর্ভাবনা কাটল আপনাদের পেয়ে
বেহালার বড়িশায় এক বৈঠকে ১০ জন ছিলেন যাঁরা প্রথম বার পার্টির কোনও আলোচনা শুনলেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, প্রার্থী আসবেন, তাঁর আলোচনাটা যেন তাঁরা শুনতে আসেন। আলোচনা শোনার পর প্রত্যেকেই বললেন, খুব হতাশ লাগছিল। কোথায় ভোট দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না, আপনাদের আলোচনা শোনার পর ঠিক করলাম, ভোটটা এ বার এসইউসিআই-কেই দেব। সকলেই অন্যদের দেওয়ার জন্য নির্বাচনী প্রচারপত্র সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
আর একটি বৈঠকে আট জন ছিলেন যাঁরা প্রথম বার দলের আলোচনা শুনতে আসেন। তাঁরা বলেন, ভোট দেবই না ভেবেছিলাম। প্রার্থী জুবের রব্বানির আলোচনা শোনার পর মনে হল, ওনাকেই ভোটটা দেওয়া উচিত। তাঁরা দল সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
* * *
সৎ প্রার্থীর পেছনে এখনও সৎ মানুষ রয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন
বেলেঘাটার এক গণদাবী পাঠক দলের এক কর্মীকে বললেন, চলুন দিদি, আপনাদের এক সমর্থকের বাড়িতে নিয়ে যাই। গিয়ে দেখলাম, ৭০ বছর বয়সের এক ভদ্রমহিলা। বললেন, ডাক্তার বিপ্লব চন্দ্রকেই ভোটটা দেব। এখন সমাজের যা অবস্থা তাতে সৎ প্রার্থীর পেছনে সমাজে এখনও সৎ মানুষ আছে, এটা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আমি যদি একটু সুস্থ থাকতাম তা হলে আমি তোমাদের সাথে প্রচারে বেরোতাম। যাদের সাথে আমি মর্নিংওয়াক করি, আমার আত্মীয়, আমার পাড়া-প্রতিবেশী আমি সকলের কাছেই প্রচার করছি তোমাদের ভোট দেওয়ার জন্য।
* * *
কংগ্রেসের হাতে নিহত শহিদদের প্রশ্নে চুপ নেতারা
মৌলালি এলাকায় সিপিএমের স্থানীয় কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন এমন এক ব্যক্তি বললেন, ‘আপনারা তো ভাল প্রচার করছেন। আমাদের দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ঠিক বলে মনে করি না। কিন্তু কী করব, এতদিন এই দল করে এসেছি, এখন তো আর দল বদলাতে পারব না।’ বললেন, নেতৃত্বকে প্রশ্ন করেছি, তা হলে আমরা যখন প্রচারে যাব তখন কংগ্রেসের হাতে নিহত শহিদদের কথা উল্লেখ করব না? আমাদের নেতারা কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
* * *
এই দলটাই করব
পশ্চিম মেদিনীপুরে একটি এলাকায় আদিবাসী পল্লীর বাসিন্দারা এ বারের ভোটে টিএমসি-বিজেপি-সিপিএম কোনও দলকে পোস্টার, পতাকা লাগাতে দেননি। এই পল্লীর সকলে আগে সিপিএম করতেন, আবার টিএমসি-বিজেপি দলের প্রতি তাঁদের কোনও আস্থা ভরসা নেই। দলের উদ্যোগে ওই পল্লীতে একটা বৈঠক করা হয়, ৩০ জন উপস্থিত ছিলেন। নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আলোচনা করার পর এসইউসিআই(সি)-কে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। বলেন, আপনাদের দলই করব। আর একটি আদিবাসী পল্লীর ২৬টি পরিবার শাসক-বিরোধী দলগুলির কাউকে ভোট দেবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। দলের কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাসিন্দারা বলেন, বাপ- ঠাকুরদার আমল থেকে সিপিএম করছি। তাঁরা মার্ক্সবাদের কথা বলতেন। লাল ঝান্ডা নিয়ে চলতেন। আর বলতেন, কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। আজ সিপিএম সেই কংগ্রেসকে নিয়ে চলছে! এ সব দেখে শুনে তাঁরা ভাবছিলেন এদের কাউকে ভোট দেবেন না, নোটায় ভোট দেবেন। নেতৃত্বের আলোচনা শোনার পর তাঁরা এসইউসিআই(সি)-কে ভোট দেবেন বলে স্থির করেন। একজন আদিবাসী গৃহবধূ বলেন, এসইউসিআই(সি)-কে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতে দেখি। আমরা আপনাদের ভোট দেব, আর এই দলটাই করব।
* * *