Breaking News

গণআন্দোলনের দাবি নিয়ে তিন রাজ্যে নির্বাচনে লড়ছে এস ইউ সি আই (সি)

সাম্প্রতিক মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং তেলেঙ্গানায়  বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে কয়েক দফায়৷ এই রাজ্যগুলিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলের যে সাংগঠনিক ভিত গড়ে উঠেছে, তার জোরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছে এস ইউ সি আই  (সি)৷

মধ্যপ্রদেশ

এই রাজ্যে এস ইউ সি আই (সি) ৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷ কংগ্রেস ও বিজেপির দীর্ঘ জনবিরোধী শাসন ও তীব্র পুঁজিবাদী শোষণে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ৷ এই রাজ্যের শিওপুর জেলা ‘ভারতের ইথিওপিয়া’ নামে পরিচিত৷ এখানে ২০১৬ সালের সেপ্ঢেম্বরে ১১৬ জন মানুষ অপুষ্টিতে মারা গেছেন৷ শিশুমৃত্যুতে এই রাজ্য শীর্ষস্থানে, প্রসূতি মৃত্যুতে দ্বিতীয়৷  চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া৷ ২৫ হাজার জনসংখ্যা পিছু মাত্র একজন ডাক্তার এবং ২ লাখ জনসংখ্যা পিছু মাত্র একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র৷ বেকার সমস্যাও ভয়াবহ৷ সরকারি হিসাবেই ২০১৭ সালে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৩৩৪ জন৷ অর্থনৈতিক  অনিশ্চয়তায় যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে৷ পাঁচ বছরে ৬,০১৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে৷ শাসক দল ও পুলিশের যোগসাজশে দুর্নীতিগ্রস্ত মাফিয়া চক্র অবাধে লুটছে খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, নদীর বালি–পাথর৷ নর্মদা বাঁধের জন্য যে ৪০ হাজার পরিবারকে সরকার উচ্ছেদ করেছে, আজও তাদের উপযুক্ত পুনর্বাসন হয়নি৷

৬০ হাজার শিক্ষক পদ শূন্য৷ শিক্ষার মান অত্যন্ত শোচনীয়৷ পঞ্চম শ্রেণির এক–তৃতীয়াংশ ছাত্র দ্বিতীয় শ্রেণির বই ঠিকমতো পড়তে পারে না৷ অর্থসংকটের অজুহাতে সরকার ১ লাখ ৮ হাজার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে৷ বাস্তবে এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসার সিংহদুয়ার খুলে দেওয়া হয়েছে যেখানে হাজার হাজার টাকা দিয়ে পড়তে হয়৷ ৪০টি ডিপার্টমেন্ট এবং বোর্ডের নিয়োগকারী সংস্থা ‘ব্যপম’এ কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতে শাসক দলের বহু রাঘববোয়াল অভিযুক্ত৷ বিজেপির ১৫ বছরের শাসনে রাজ্যে বাস্তবে জনবিরোধী শাসনের রামরাজত্ব কায়েম হয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্যে বিক্ষোভের  বারুদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে৷ বিক্ষোভ বিস্ফোরণে ফেটেও পড়ছে৷ ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে ২০১৭ সালের ৬ জুন কৃষকরা মান্দসোরে ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়েন৷ বিজেপি সরকার তাঁদের দাবি মানার পরিবর্তে গুলি চালায়, তাতে ৬ জন কৃষক নিহত হন৷

কৃষক হত্যার প্রতিবাদে এবং ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছে  এস ইউ সি আই (সি)  এবং  কৃষক সংগঠন এ আই কে কে এম এস৷ মদ নিষিদ্ধ করার দাবিতে দলের মহিলা, যুব ও ছাত্র শাখার পক্ষ থেকে ‘শরাব–বন্দি যাত্রা’ সংগঠিত করা  হয়৷ ১৬টি জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে৷ ‘সেমেস্টার হঠাও’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ে৷ শূন্যপদে নিয়োগ, স্থায়ী নিয়োগ প্রভৃতি দাবিতে দলের শ্রমিক শাখা আন্দোলন গড়ে তোলে৷ এ সবের মধ্য দিয়ে এস ইউ সি আই (সি) দলের পক্ষে জনসমর্থন বেড়ে চলেছে৷

নির্বাচন, সরকার পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে শোষণের অবসান ঘটে না, এর জন্য যে অবশ্য প্রয়োজন একটি বিপ্লবী দলের যথোপযুক্ত শক্তিবৃদ্ধি এবং একের পর এক গণআন্দোলন– সেই শিক্ষাই নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে নিয়ে যাচ্ছে এস ইউ সি আই (সি)৷

ছত্তিশগড়

খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্য ছত্তিশগড়৷ কিন্তু এই সম্পদ লুঠ করছে বহুজাতিক পুঁজি মালিকরা৷ ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এক এক করে প্রায় সব খনি তুলে দিয়েছে তাদের হাতে৷ সরকারি মালিকানাধীন  শিল্পগুলিও বেসরকারি মালিকানায় দেওয়া হয়েছে৷ পুঁজিবাদী শোষণের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বিভিন্ন শিল্প সংস্থা বন্ধ হচ্ছে৷ বেকারত্ব–দারিদ্র ভয়াবহ৷ রাজধানী রায়পুরে শিল্প শ্রমিকরা দৈনিক ১০০–১২৫ টাকা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় মূলত ঠিকা শ্রমিকরা নামমাত্র মজুরিতে বেগার খাটছে৷ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দুই লক্ষাধিক পদ শূন্য৷ ১৫ বছর আগে চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসকে পরাজিত করে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল৷ একইভাবে বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরাও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত৷ রেশন দুর্নীতি, কয়লা দুর্নীতি, অগুস্তা ওয়েটল্যান্ড হেলিকপ্ঢার দুর্নীতি ইত্যাদিতে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং অভিযুক্ত৷ মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র বিজেপি সাংসদ অভিষেক সিং–এর নাম কুখ্যাত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে যুক্ত৷

ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হওয়ায় বিজেপি পুঁজিপতিদের দেওয়া টাকার থলি নিয়ে ভোট কিনতে নেমেছে৷ ৫০ হাজার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন যুবকদের মধ্যে বিলি করেছে তারা৷ অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতাবাদ আঞ্চলিকতাবাদ খুঁচিয়ে তুলছে৷ যে সমস্ত সংবাদ মাধ্যম বিজেপির কুকীর্তি প্রকাশ করার সাহস দেখাচ্ছে তাদের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে৷

তথাকথিত মাওবাদী তৎপরতাকে সামনে রেখে বিজেপি সরকার মার্কসবাদ এবং বামপন্থার বিরুদ্ধে মারাত্মক মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের সামনে জরুরি কর্তব্য ছিল বামপন্থার মহত্ত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে পাল্টা প্রচারাভিযান৷ কিন্তু সিপিএম–সিপিআই সে পথে এল না৷ তাদের বরাবরেরই অবস্থান হল যে কোনও মূল্যে কিছু আসন জেতা৷ এবং সেই লক্ষ্যে নানা দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে জোটবন্ধন৷ ২০০৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম তার শ্রমিক সংগঠন ‘সিটু’র মাধ্যমে লিফলেট বিলি করে ভিলাই বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসকে ভোট দিতে বলে৷ ৷ যদিও সেখানে সিপিআই–এর প্রার্থী ছিল৷ ২০১৩ সালে সিপিএম–সিপিআই বিজেপির এক প্রাক্তন সাংসদের গড়া দলের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করে৷ এ বছর তারা প্রকাশ্যেই বলছে বিজেপিকে হারাতে কংগ্রেসকে ভোট দেবে৷ তারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের চেষ্টা চালায়৷ এদিকে সিপিআই হঠাৎ কংগ্রেসের পূর্বতন দুর্নীতিগ্রস্ত  মুখ্যমন্ত্রীর  গড়া একটি আঞ্চলিক দল এবং বিএসপি–র সঙ্গে জোট করে৷ সিপিএমও বামঐক্য থেকে সরে দাঁড়ায়৷ ফলে এস ইউ সি আই (সি), সিপিআই, সিপিআই(এম), সিপিআইএমএল–লিবারে প্রভৃতি বাম দলের যৌথভাবে ২৫টি আসনে লড়ার সিদ্ধান্ত ভেস্তে যায়

এই অবস্থায় এস ইউ সি আই (সি) একক ভাবে দু’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷ ছত্তিশগড়ে এস ইউ সি আই (সি) জনজীবনের সমস্যা নিয়ে নানা আন্দোলন গড়ে তুলছে৷ রাজ্যে মদ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলনে কিছুদিন আগে দলের দুই নেতা গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷ গণআন্দোলন শক্তিশালী করার জন্য এস ইউ সি আই  (সি) কর্মীরা ভোট চাইছেন৷ যেখানে দলের প্রার্থী নেই সেখানে অন্যান্য বামপন্থী দলের প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে৷

তেলেঙ্গানা

তেলেঙ্গানা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর৷ খৈরতাবাদ এবং পাথানচেরু কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এস ইউ সি আই  (সি)৷ ২০১৪ সালে অন্ধ্র ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী হন আঞ্চলিক বুর্জোয়া দল টি আর এস (তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি)–র কে চন্দ্রশেখর রাও৷ সাড়ে চার বছর বাদে নবগঠিত এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে৷ তেলেঙ্গানার একটা বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে এবং এখানে বামপন্থীদের, বিশেষ করে সিপিএম–সিপিআই–এর শক্ত ঘাঁটি ছিল৷ সেই ঘাঁটি আজ চূর্ণ–বিচূর্ণ৷ এর মূল কারণ গণআন্দোলনের পথ থেকে তাদের সরে আসা এবং নানা বুর্জোয়া দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়ে তোলা৷ সিপিআই(এম–এল)ও তার গণভিত্তি হারায় ভুল রণনীতি ও রণকৌশলের জন্য৷

এই রাজ্যে ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ নেয় এস ইউ সি আই (সি)৷ লাগাতার চেষ্টার মধ্য দিয়ে ৯ দলীয় একটি বামজোট গড়ে তোলা হয়৷ এই জোটের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলনও হয়েছে৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে লক্ষনীয়, যখনই নির্বাচন এসেছে তখনই সিপিএম–সিপিআই বামজোট ছেড়ে বুর্জোয়াদের জোটে সামিল হয়েছে৷ এবারের নির্বাচনেও সিপিআই বৃহৎ বুর্জোয়াদের দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছে৷ সিপিএম এবং এমসিপিআই জাতিবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে জোট করে গঠন করেছে বহুজন লেফট ফ্রন্ট (বিএলএফ)৷ একটা দুটো আসন জেতার জন্য দক্ষিণপন্থী নানা দলের সঙ্গে এই জোটবন্ধন বাস্তবে জনসাধারণের চোখে বাম আন্দোলনের স্বতন্ত্র গুরুত্বকে লঘু করেছে৷

বুর্জোয়া শোষণমূলক ব্যবস্থায় পৃথক রাজ্য গঠনের দ্বারা যে জনজীবনের মূল সমস্যার বিন্দুমাত্র সমাধান করা যায় না–তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতাও তাই৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনে এবং তার আগে পৃথক রাজ্য গঠনের সময় শাসক দলগুলির চটকদারি স্লোগান ছিল সকলকেই জল, আর্থিক সম্পদ এবং চাকরি দেওয়া হবে৷ কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই৷ সরকারি দপ্তরে ২ লাখ শূন্যপদ, নিয়োগ হয়েছে মাত্র ২০ হাজার, এবং তার বেশিরভাগই পুলিশ কনস্টেবল৷ প্রতিশ্রুতি ছিল সর্বস্তরে শিক্ষা হবে অবৈতনিক৷ কিন্তু বাস্তবে সরকার হাজার হাজার স্কুল বন্ধ করে দিয়ে বেসরকারি স্কুলের অনুমোদন দিচ্ছে যেখানে বেতন লাগামছাড়া৷ শিক্ষা চলে যাচ্ছে কেবল ধনীদের কবলে৷ প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি কৃষি ঋণ মকুবেরও৷ ফলে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ ক্রমবর্ধমান৷ বিক্ষোভ যাতে ফেটে না পড়তে পারে তার জন্য মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ করছে সরকার৷ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল যেমন উৎসবের ডামাডোলে মানুষকে ভোলাচ্ছে টি আর এসও তেমনি জনগণের সমস্যা ভোলাতে ‘যোগা’, ‘যজ্ঞ’– এ সবের মধ্যে জনগণকে মাতিয়ে দিচ্ছে৷

কিন্তু পেট বড় বালাই৷ সংকট মানুষকে সমস্যা নিরসনের পথের সন্ধানে ঠেলছে৷ বুর্জোয়া শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে কেবল সরকার পাল্টে যে এই সংকট থেকে মুক্তি নেই এস ইউ সি আই  (সি) নির্বাচনী প্রচারে সে কথাই বলছে৷ এস ইউ সি আই  (সি)–র মধ্যেই মানুষ বিকল্প সংগ্রামী বামপন্থার সন্ধান পাচ্ছে৷

(৭১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা ১৬ – ২২ নভেম্বর, ২০১৮)