করোনায় মারা যাব, না হয় না খেতে পেয়ে মরব– বললেন বহরমপুরের মামনি কর্মকার। বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন তিনি। এখন তিন সন্তানকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েছেন। রেশন পাচ্ছেন না, তার জন্য দৌড়াদৌড়িও করতে পারছেন না। প্রতিবেশীদের দেওয়া চাল ডাল সন্তানদের কয়েক দিন দু’মুঠো ফুটিয়ে দিয়েছেন। এখন তাও নেই। উত্তরপ্রদেশের জাহাঙ্গিরবাদ গ্রাম। খেতে দিতে না পেরে পাঁচ সন্তানকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন দিনমজুর মা। কোন অসহায়তায় মা নিজের সন্তানকে এমন মর্মান্তিক ভাবে মারতে পারেন! ঝাড়খন্ডে অর্ধাহার আর অনাহারে থেকে টানা আট দিন লড়াই করে গাড়ওয়া জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামের সোমারিয়া দেবীর অকালমৃত্যু হল, তার স্বামীকে অসহায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে হল সেই মৃত্যু। সংবাদপত্র, টিভি খুললেই প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের নানা প্রকল্পের ঘোষণা, গরিবের জন্য খাদ্য, অর্থ দেওয়ার ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। তাহলে কোনটা ঠিক, মন্ত্রীদের ঘোষণা না এই ঘটনাগুলির মতো অসংখ্য মানুষের জীবনযন্ত্রণা?
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বিনাব্যয়ে মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য ৮০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে সরকার। বাস্তবটা কী? তারাই দাবি করেছে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৫ কোটি মানুষের কাছে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে উজ্জ্বলা প্রকল্পের আওতায় ৮.৩ কোটি দরিদ্র মহিলার জন্য বিনামূল্যে এলপিজি ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি তাদের। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার অধীনে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্যও নাকি এপ্রিল-জুনের মধ্যে ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্যশস্য দেবে সরকার। এ ছাড়া মহিলা, প্রবীণ, দরিদ্র নাগরিক এবং কৃষকদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ সহায়তার কথাও ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। ঘোষণা তো হল, কিন্তু এই প্রান্তিক মানুষদের কাছে তা পৌঁছবে কবে?
সরকারি তথ্যেই পরিষ্কার, দেশের ৮০ কোটি মানুষ গরিব, অতি গরিব। তাদের কিছুই নেই। এই অবস্থায় তারা করবেন কী? মোদিজি কি জানেন, ঝাড়খন্ডের ১৫টি ব্লক চরম খাদ্যাভাবে ধুঁকছে, ২১টি ব্লক এখনও এপ্রিলের রেশন পায়নি। উত্তরপ্রদেশের বান্দা জেলার কচ্ছবান্ধিয়া গ্রামের ৭০টি পরিবার এই মুহূর্তে প্রায় অনাহারে। সরকার কোনও খাদ্যশস্য দিচ্ছে না। কারণ তাদের রেশন কার্ড নেই। ঝাড়খন্ডে ৭ লক্ষ গ্রাহক আজও রেশন কার্ড পাননি। তাদের খাবার জুটবে কীভাবে সরকার ভেবে দেখেছে কি? একই চিত্র মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, বিহার সর্বত্র। এর দায় কার? লকডাউনে যে সাধারণ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে পড়বে তা কি জানতেন না প্রধানমন্ত্রী? তাহলে আগেই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলেন না কেন? গোটা কয়েক প্রতিশ্রুতি দিয়েই সরকারের প্রধানের দায়িত্ব শেষ হয় গেল!
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কী? রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে খাদ্য সংকট যাতে না হয় তার জন্য আগামী ছয় মাস বিনামূল্যে (আর এস ওয়াই এ-২ ক্যাটাগরি বাদ দিয়ে) সকলকে রেশন সামগ্রী দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, একটিও পরিবার যাতে খাদ্যসামগ্রী থেকে বঞ্চিত না হয় তা দেখার জন্য প্রস্তুত সরকার। টিভিতে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবের মিল কতটুকু? ডিলাররা বলছেন, তাদের কাছে এমন সার্কুলার আসেনি। রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে গ্রাহক বিক্ষোভ আজ প্রতিদিনের খবর। কেন্দ্র-রাজ্য তরজাতেই কি তাদের দায়িত্ব শেষ হয়? গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে আসা বহু মানুষ লকডাউনের ফলে গাদাগাদি করে বস্তিতে আছেন। তাঁদের অনেকেরই রেশন কার্ড আছে গ্রামে। ফলে মাঝে মাঝে কিছু ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া সামান্য খাদ্যে তাঁরা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। এগুলি দেখবে কে?
লকডাউনে বহু মানুষের আয় শূন্যে নেমে গেছে। খাদ্যের জন্য হাহাকার চলছে। বাক্যবাগীশ নেতারা যাই বলুন, সংবাদমাধ্যমের জেলাওয়ারি রিপোর্ট কিন্তু নেতাদের প্রচারের সাথে একেবারেই মিলছে না। সাগরদিঘীর আদিবাসী অধ্যুষিত চাঁদপারা, ওলাহার, পলন্দা, টোকরডাঙা, ইটোর, আতুরফেলা ইত্যাদি গ্রামে চলছে প্রায় অনাহার। চাল শেষ, আটা নেই– কাহাতি সোরেন তিন নাবালক ছেলে-মেয়েকে রাতে ফুটানো এক বাটি বাসি ভাতের সঙ্গে নুন আর দুটো সেদ্ধ আলু মেখে খাইয়েছেন, আর নিজে খেয়েছেন ভাতের মাড়টুকু। সেটাও এখন দুষ্প্রাপ্য। বললেন ১১ দিন কোনওরকমে চলেছে। আজ আর বাড়িতে এক মুঠো চাল নেই। উপোস করা ছাড়া কোনও গতি নেই। মেয়েকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলেন মা টগরি হাঁসদা। বাসি ভাত সাথে এক দলা শাক। কান্নাভেজা গলায় বললেন, সকাল থেকে মেয়েকে কিছু খেতে দিইনি, এখন কান্নাকাটি করায় দিলাম। দুপুরটা তো মেয়েটা খেল, রাতে কী হবে জানি না। ঘরে ঘরে একই অবস্থা। ডালখোলা বুড়ি মহানন্দার চড়ে বাস করেন কিছু যাযাবর ও বেদে পরিবার। তারা পাচ্ছেন না সরকারি খাদ্যসামগ্রী। পেটের টানে কচু পাতা সেদ্ধ করে খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা। বালুরঘাটের রঘুনাথপুর এলাকায় সবিতা মোহন্ত জানালেন, ডিজিটাল রেশন কার্ড পাননি, ফলে খাদ্যপণ্য পাচ্ছেন না। স্থানীয় বিজেপি ও তৃণমূল একে অপরকে দোষারোপ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে।
কেন্দ্র সরকার বলছে আগামী তিন মাস রেশন দেবে, রাজ্য বলছে ছয় মাস। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেশন কার্ডের জন্য যারা আবেদন করেছেন, অনুমোদন মিলেছে অথচ যারা লকডাউনের আগে পর্যন্ত রেশন কার্ড পাননি, তাদের কুপন দেওয়ার ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। জেলাশাসক বলছেন, যাদের কার্ড আছে ও যাদের নেই তারা প্রত্যেকেই রেশন পাবেন। সপ্তাহের প্রতিদিনই রেশন দোকান খোলা থাকবে। একমাসের রেশন একসাথে দেওয়া হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা কী? রেশন দোকান সপ্তাহে মাত্র দু-তিন দিন খোলা। দু’কেজি চাল ও দু’কেজি গম দেওয়া হচ্ছে। তাতে একজনের় সারা সপ্তাহ চলে? যদিও অনেকে তাও পাচ্ছেন না। বহু জায়গায় রেশন ডিলারের দুর্নীতি, দলবাজি চরমে উঠেছে। শাসকদল ঘনিষ্ঠ লোকেরা রেশন পাচ্ছেন এমন অভিযোগও উঠছে। স্বভাবতই রেশন ডিলারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে অনাহারে থাকা মানুষ। তারা সংগঠিত হচ্ছেন। বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন নানা জায়গায়। এই রেশনে চালানো দুষ্কর বলে বর্ধমানের কাঁকসায়, কুলটিতে বিক্ষোভ দেখান গ্রাহকরা। কোনও কোনও এলাকার মানুষকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে রেশনের জন্য ছুটতে হচ্ছে। কুপনের ভুলের জন্য একজনকে বহু দূরে আরেক জায়গায়রেশন তুলতে যেতে হচ্ছে। বীরভূমের বহু জায়গাতেই এমন ঘটনা ঘটছে। বিলি করা কুপনে বেশ কিছু ভুল থাকায় এই ঘটনা ঘটছে। ফলে সমস্যায় পড়ছেন রেশন গ্রাহকরা। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মথুরাপুরের লালপুরে ১৯ এপ্রিল দীর্ঘক্ষণ রাস্তা অবরোধ করেন স্থানীয় মানুষ। তাদের অভিযোগ, সরকার তাদের খেয়ে বাঁচার মতো কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। তারা দাবি জানান, খাদ্যসামগ্রীর সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা করতে হবে, শুধু খাদ্যসচিব বদল করলেই হবে না। অবশেষে বিডিও এসে যতদিন লকডাউন না ওঠে, ততদিন কমিউনিটি কিচেন চালিয়ে খাবার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে অবরোধ ওঠে।
আসলে খাবার না থাকলে কি অনুভূতি হয়, সন্তানদের খেতে দিতে না পারলে মায়ের মন কেমন আকুলি বিকুলি করে, অসুস্থ পরিজনের চিকিৎসা করাতে না পারলে কি অসহায় লাগে, সে তো কেবলমাত্র গরিব মানুষ নিজেদের জীবন দিয়ে বোঝে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তার মর্ম বুঝবেন কী করে? যদি বুঝতেন তাহলে ১৩০ কোটির দেশে ৫ কোটি মানুষকে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে নিজেদের ঢাক পেটাত না সরকার। বিজ্ঞাপনের পিছনে খরচ করা টাকায় বহু জনের খাদ্যের সংস্থান করত। একটি জনকল্যাণকামী দেশের মানুষের অভিভাবক হিসাবে শাসক দলের নেতারা লজ্জা বোধ করতেন যে, রোগ প্রতিরোধ তো নয়ই, জনসাধারণকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই তারা করে উঠতে পারছেন না! সাধারণ মানুষকে প্রাপ্য রেশনটুকু দিতেও যারা পারে না, তারা শিল্পপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা করছাড় দেন অনায়াসে– এই সরকার কখনও জনদরদি হতে পারে?
সরকার দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে খাবার পৌছতে পারছে না কেন? দেশে কি খাদ্যশস্যের অভাব? বাস্তবে দেশে মজুত আছে বিশাল খাদ্য ভান্ডার। জানা গেছে, ২০২০-র মার্চের মধ্যে এফসিআই এর মজুত করা খাদ্যশস্যের পরিমাণ ৭.৭কোটি টন যা এই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ । এমনকি ওই খাদ্যশস্যের পরিমাণ বাফার স্টক (প্রতি তিন মাস অন্তর যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রাখা হয়) এরও তিনগুণ। এর ওপর রবিশস্য মজুত হলে তার পরিমাণ আরও বাড়বে। ফলে এই জরুরি পরিস্থিতিতে মজুত থাকা খাদ্যশস্য থেকে জনসাধারণকে খাবার দেওয়ার কোনও অসুবিধাই নেই। শুধু দরকার সরকারি সদিচ্ছার। সেটারই অভাব।