কাশ্মীরের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাজানো, শান্ত ছবির মতো কোনও জায়গা কিংবা দু’দশকের ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে উত্তাল উপত্যকার কোনও ছবি৷ কিন্তু আসলে কাশ্মীর এই দুটো ছবির থেকেই সম্পূর্ণ আলাদা– তা হল উপত্যকার মানুষের প্রতিদিনকার দারিদ্র, ক্ষুধা, প্রশাসনের অসহযোগিতায় দুঃসহ অবস্থায় দিন কাটানোর ছবি৷
কাশ্মীরের গ্রাম ও বস্তিগুলির শিশুদের উপর দু’দশকের রক্তাক্ত লড়াইয়ের প্রভাব কতটা পড়েছে, তা নিয়ে কয়েক বছর আগে ১০ দিন ধরে অনুসন্ধান করেছেন বিশিষ্ট প্রবন্ধকার হর্ষ মান্দার৷ আজকের চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়৷ কাশ্মীরের ৫০টি গ্রামের মানুষের খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবনধারণের নানা পরিকল্পনা রূপায়ণ নিয়ে সমীক্ষা করেন তিনি৷ এই সমীক্ষায় শ্রীনগরের কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সোস্যাল ওয়ার্ক বিভাগের ছাত্র ও প্রাক্তনীরাও সাহায্য করেছেন৷ সমীক্ষকদের দৃষ্টিতে কাশ্মীরের মানুষের সমস্যা কী, তা তুলে ধরার প্রয়াসেই এই নিবন্ধ৷
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কাশ্মীর উপত্যকায় দারিদ্রসীমা নগণ্য৷ প্ল্যানিং কমিশনের রিপোর্ট বলছে, ২০০৪–০৫ সালে ভারতে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা ২৮.৩ শতাংশ মানুষের সাথে তুলনা করলে ওই অর্থবর্ষে জম্মু ও কাশ্মীরের দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৪.৫ শতাংশ৷ কাশ্মীর দেশের মধ্যে এমন একটি জায়গা যেখানে মানুষের সমধিকার ও সম সুযোগ–সুবিধা আছে বলে মনে করে অনেকে৷ ভারতের অন্যান্য অংশের থেকে বেশি ভূমি সংস্কার হয়েছে এখানে৷ স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বৃহৎ খামার অবলুপ্ত হয়, সাথে সাথে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়৷
কিন্তু আবার সরকারি তথ্যসূত্রই বলছে, সমস্ত ভারতের তুলনায় জম্মু ও কাশ্মীরের দারিদ্র অত্যন্ত ভয়াবহ৷ এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি দারিদ্রের নানা সূচকে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে৷ এর প্রায় পুরোটাই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, যেখানে জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল৷ ৯৭ শতাংশই ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চাষি, যারা গড়ে মাত্র ০.৭ হেক্টর জমির মালিক৷ রাজ্যে কৃষি উৎপাদনের হারে চলছে প্রবল মন্দা– খাদ্যশস্য উৎপাদনে ৪৪ শতাংশ, সবজি উৎপাদনে ৩৩ শতাংশ এবং তৈলবীজ উৎপাদনে ৬৯ শতাংশ ঘাটতি৷ ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে এগুলি আমদানি করা হয়৷ জনজীবনের এই সমস্ত সমস্যা–সংকটে দীর্ণ বাসিন্দারা বয়নশিল্প বন্ধ হওয়ায় বাধ্য হয়ে পর্যটন শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে৷ জাতীয় গড় আয়ের দুই–তৃতীয়াংশ এই রাজ্যের গড় আয়– ২৫ হাজার ৯০৭ টাকার মধ্যে ১৭ হাজার ১৭৪ টাকা৷ এর বেকারির হারও বেশি– ৪.২১ শতাংশ, জাতীয় হার যেখানে ৩.০৯ শতাংশ৷
এখানকার বিশিষ্ট সমাজবাদী ও মানবতাবাদী এল সি জৈন সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন৷ যারা হতাশা ও ক্ষোভ থেকে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে পাথর ছোড়া রপ্ত করেছে, সেই যুবকদের জন্য মৃত্যুশয্যাতেও তিনি অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ যদি প্রত্যেক যুবকের হাতে কাজ থাকত, তাহলে তারা পাথর ছুড়ত না– স্বভাবগত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের আলোকে এই ছিল তাঁর উপলব্ধি৷
দু’দশকের লাগাতার সংঘর্ষ স্থানীয় স্তরে সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ যদিও এটাই আবার সরকারি কর্তাদের কাজ না করার অজুহাত হিসাবে কাজ করেছে৷ গত দু’দশক ধরে পঞ্চায়েত ক্ষেত্রে নির্বাচন না করায় নাগরিকদের কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই৷ ফলে প্রতিনিধির কাছে নিত্যদিনের সমস্যা সমাধানের দাবি জানানোর সুযোগ নেই৷ এর ফলে খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবনধারণের নানা কর্মসূচি রূপায়ণ ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ঘাটতি থেকে গেছে৷ স্বভাবতই, ওই অঞ্চলের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা গরিব মানুষের মর্যাদা সহকারে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর৷
সমীক্ষকরা একেকটি গ্রাম থেকে ১০০ দিনের প্রকল্পের মাত্র ৫ জন জবকার্ড হোল্ডার খুঁজে বের করতেই হিমসিম খেয়েছেন৷ এঁরাও সারা বছরে গড়ে সাত দিনের বেশি কাজ পাননি৷ নির্ধারিত মজুরির অর্ধেক দিনে ৭০ টাকা মজুরি বেঁধে দেওয়া এই প্রকল্প বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়ে৷ শীতে যখন খাবার ও কাজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে, সেইসময় এই প্রকল্পের কোনও কাজ দেওয়া হয় না৷ সরকারি অফিসাররা দাবি করেন, উপত্যকায় জনমজুরের কাজের কোনও চাহিদাই নেই৷ কিন্তু মজুরি যখন ১১০ টাকা করা হল, তখন দেখা গেল কাজের চাহিদা আগের থেকে অনেকটাই বেশি৷ অদক্ষ রাজ্য প্রশাসন এখনও সকলের কাজের চাহিদা মেটানোর জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ৷
এখানকার মাত্র ৬ শতাংশ মহিলা মাতৃত্বকালীন সুযোগসুবিধা পান৷ বৃদ্ধদের পেনশনের অবস্থাও তথৈবচ৷ মাত্র ৩৫ শতাংশ প্রবীণ নাগরিক এই সুবিধা পান৷ পেনশনের হার খুব কম এবং অনিয়মিত৷ ওই সমীক্ষক দলের সঙ্গে কথোপকথনে এক প্রবীণ মহিলা জানান, তিনি বছরে মাত্র দু’বার, দু’টো ঈদের সময় পেনশন পান৷ এইভাবে যখন কয়েক মাসের বকেয়া পেনশন জমে যায়, তখন বহু সময়ই সরকারি কর্তারা তা বাতিল ঘোষণা করেন৷
খাদ্য সংকটে ভোগা এই রাজ্যে যে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম বা রেশন ব্যবস্থা রয়েছে তাতে বাসিন্দাদের সংকট মেটে না, খাদ্য নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত হয় না৷ চার শতাংশ মানুষেরও রেশন কার্ড নেই৷ তারা অনেকেই কখনও কখনও ভতুর্কিযুক্ত খাদ্যশস্য পান৷ কিন্তু রেশন দোকান খোলে মাসে এক থেকে দু’দিন৷ ওই দিনগুলিতে নাগরিকরা যদি রেশন তুলতে না পারেন, তাহলে বরাদ্দকৃত দ্রব্য মেলে না, কালো বাজারে বিক্রি করে দেয় রেশন ডিলাররা৷
সমীক্ষায় দেখা গেছে, বহু প্রত্যন্ত এলাকায় আইসিডিএস সেন্টার নেই৷ শিশুদের ওজন অত্যন্ত কম৷ অপুষ্ট শিশুদের চিহ্ণিত করা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই৷ অল্প জায়গাতেই শিশুদের প্রি–স্কুল ক্লাস হয়৷ কিন্তু বহু সেন্টার থেকেই গর্ভবতী মা ও তার গর্ভের সন্তানের পরীক্ষা ও পুষ্টির জন্য যথাযথ পরামর্শ মেলে না৷ ৯৮ শতাংশ শিশু স্কুলে গরম খাবারের কথা মনে করতে পারলেও বহু মাস যাবত তারা কোনও খাবারই পাচ্ছে না৷ দেশের অন্যান্য অংশে মহিলা গ্রুপ–এর হাতে এর দায়িত্ব থাকলেও এখানে শিক্ষকদেরই এই কাজে যুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক৷
এই সমীক্ষা সরকারের বিশাল পরিমাণ পালন না করা দায়িত্বকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়৷ জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনমানের উন্নয়ন, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, তাঁদের বেঁচে থাকা– এই সরকারি প্রকল্পগুলির রূপায়ণ ছাড়া যে সম্ভব নয়, তাই তুলে ধরছে এই রিপোর্ট৷ উপত্যকায় চলতে থাকা জঙ্গি সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাধান একমাত্র হতে পারে সাধারণ মানুষ ও সরকার দু’পক্ষেরই আন্তরিক উদ্যোগে৷ তাহলে গরিব মহিলা, যুবক–যুবতী যারা ওই সুন্দর কিন্তু সমস্যাদীর্ণ এলাকায় রয়েছেন, তারাও মর্যাদার সাথে জীবন কাটাতে পারবেন৷ কিন্তু রাজ্য সরকার মানুষের অধিকার, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার থেকে শতযোজন দূরে রয়েছে৷
গ্রামে গ্রামে ভয়ঙ্কর মৃত্যু, গ্রেপ্তারি, গুম খুন, পুলিশি হেনস্থা, তল্লাশির মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে৷ সমীক্ষক দলের অভিমত, এত কিছুর মধ্যেও মানুষ রেশন কার্ড, স্কুলের মিল, পেনশন এবং আইসিডিএস সেন্টারের জন্য লড়ছে৷ ‘বড়’ লড়াইয়ের মাঝেও তারা তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিনের ‘ছোট’ লড়াই বন্ধ করতে রাজি নয়৷ এখানকার মানুষ আজও তাদের শিশুদের উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য, নিজেদের জন্য মর্যাদার কাজ এবং বয়স্কদের বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে৷ কোনও সরকারেরই তা ভুললে চলবে না৷ কাশ্মীরী জনগণের জীবনের এত ভয়াবহ দারিদ্রের সংবাদ কতজনই বা জানে? কোন সরকার দেশের মানুষ হিসাবে তাদের দায়দায়িত্ব কতটুকু নিয়েছে?