খয়রাতি কোনও সমাধান নয়

এখন চারিদিকে মাইকের গমগম আওয়াজে শুধুই– ‘আমাদের’  ভোট দিন। তারস্বরে গলার শির ফুলিয়ে বলে চলেছেন বক্তার পর বক্তা– আমরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিয়েছি, ভোট দিন। আর একজন বলছেন, আমরা জিতলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে বাড়তি ১০০ টাকা। কেউ বলছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা দ্বিগুণ করে দেব। কেউ বলছেন, ওদের থেকে বেশি চাল দেব, অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা দেব– ভোট প্রচারের হইহই-তে বিজেপি-কংগ্রেস-তৃণমূল কিংবা সিপিএমের যে কোনও একটা প্রচার সভার কথা শুনলে এর থেকে আলাদা কিছু পাচ্ছেন নাকি? অবশ্য পাবেনই বা কী করে? একটা অচল টাকার দুই পিঠই যে অচল! কেন এ কথা বলছি? বিচার করুন–

যে দেশে বাঁচার মতো মজুরির কাজ একেবারেই বিরল, যে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে রোজগার মেলা করে পুরনো সরকারি চাকরিগুলিকেই আর একবার বিলি করে কর্মসংস্থান প্রমাণ করতে হয়, যখন দেশে বেকারত্বের হার অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে যায়– তখন নামী-দামি নেতা-মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর দল কিছু খয়রাতি ছাড়া জনগণকে আর দেবেটাই বা কী? তাই তো নরেন্দ্র মোদি তাঁর খয়রাতি সাহায্যের প্রতি ব্যঙ্গ করে বলা ‘রেউড়ি’ সংস্কৃতি কথাটা গিলে ফেলে ৮০ কোটি রেশন গ্রহীতার জন্য বিনামূল্যে চালের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, চালের ব্যাগে যাতে তাঁর ছবি ছাপা হয় তার জন্যও ব্যবস্থা করেছেন। চাল যে তিনি দিচ্ছেন, সে ঘোষণা বেশ জোরদার করে না জানাতে পারলে তাঁর উদ্দেশ্যটাই মাটি যে! তাঁর দোসর অমিত শাহ আবার পশ্চিমবঙ্গে এসে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ১০০ টাকা করে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ দিকে তৃণমূল কংগ্রেসের দেওয়াল লিখনে, প্রচারে এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাঁড়ের ছবিই মূলত ফুটে উঠছে। বত্তৃতাও এই নিয়েই চলছে। কংগ্রেস গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে ক্ষমতায় এলে তারা এই সরকারি সাহায্যে দিনযাপনকে আইনি স্বীকৃতি দেবে। সিপিএম রাজ্যের খয়রাতিকে ভিক্ষা ইত্যাদি বলে অনেক ব্যঙ্গ করার পর ভোটের প্রতিশ্রুতিতে সেই পথেই ফিরেছে। তাঁদের কোনও কোনও প্রার্থীও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা দ্বিগুণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে এই দলগুলো একটা জিনিস নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছে, এ দেশের মানুষের আজ এমন অবস্থা যে সামান্য কিছু খয়রাতি সাহায্যই তাদের কাছে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো বিষয়! মনে রাখা ভাল, দেশটা স্বাধীনতার পর ৭৬টা বছর কাটিয়ে ফেলেছে এবং এই সব দলগুলো সকলেই কোনও না কোনও সময় কেন্দ্রীয় গদিতে বসেছে, না হলে তার শরিক হিসাবে থেকেছে। সকলেই বিকাশ, উন্নয়ন ইত্যাদি গালভরা স্লোগান দিয়েছে। বাস্তবে সে সবই ফাঁকা আওয়াজ। তাই হাঁ করে গিলতে আসা অভাবের করাল গ্রাসের সামনে মানুষ এটুকু পেলেই নিজেকে ধন্য মনে করছে!

নরেন্দ্র মোদিজি বছরে দু’কোটি চাকরির কথা আর ভুলেও বলেন না। এখন বলেন, কর্মসংস্থানই যদি না হয়ে থাকে তা হলে এত কাজ সৃষ্টি হচ্ছে কী করে? অথচ বাস্তব বলছে, সরকারি বেসরকারি কোনও স্তরেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মসংসস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়াটা এখন আকাশকুসুম। পরিসংখ্যানে নানা কারচুপি করেও সরকার ঢেকে রাখতে পারছে না যে, এ দেশে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট ৪৭ থেকে ৪৯ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম মানুষের অর্ধেকের বেশি জনের কোনও কর্মসংস্থান নেই। ২০২২-২৩-এর পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে দেখিয়েছে, মজুরিহীন পারিবারিক শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কর্মরত বলে কথিতদের ১৮.৩ শতাংশ পরিবারগত ভাবে নানা উৎপাদনে শ্রম দিলেও কোনও মজুরি পায় না। ২০১৭-১৮-তেও এই সংখ্যা ছিল ১৩ শতাংশের আশেপাশে। যারা মজুরি পায় তাদের মাত্র ২০.৯ শতাংশের নিয়মিত বেতন আছে (হিন্দুস্তান টাইমস, ২৬.১২.২৩)। এ দেশে কর্মীদের অধিকাংশের গড় বেতন মাসে ৩৯০০ টাকা থেকে ১০,৩৬৫ টাকার মধ্যে। অথচ মুষ্টিমেয় এক দলের গড় বেতন মাসে ৮০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে (ফোর্বস অ্যাডভাইসার, ২.০১.২৪)। কর্পোরেট কোম্পানির শীর্ষকর্তা, মন্ত্রী, আমলা এমপি-এমএলএ দের বেতন তো আরও অনেক ওপরে।

এই পরিস্থিতিতে বিরোধী সংসদীয় দলগুলি কী বলছে? তাঁরা বেকারত্ব নিয়ে বিজেপি সরকারের সমালোচনা করছেন। ভোটের সময় তাঁদের এটা করতেই হবে। প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে ক্ষমতায় এলে আমরা বেকারত্ব দূর করে দেব। যেমন মোদি সাহেবকেও প্রতিশ্রুতি দিতেই হবে আরও আরও বেশি করে কর্মসংস্থানের। কিন্তু কেউই বলছেন না, এই কর্মসংস্থান হবে কী করে? কিছুদিন আগে নরেন্দ্র মোদি কর্মসংস্থান হিসাবে পকোড়া ভাজার নিদান দিয়েছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো দিয়েছিলেন চপ ভাজার উপদেশ। এর আগে সিপিএম রাজত্বে সিঙ্গুরের চাষিদের সিপিএম নেতারা উপদেশ দিয়েছিলেন, টাটার কারখানায় মাত্র তিনশো লোকের চাকরি হবে তো কি! তোমরা ওদের ঘরের রান্না-বাসন মাজার লোক হতে পারবে, মালি হতে পারবে, চায়ের দোকান খুলে রোজগার করতে পারবে। এগুলোকেই তাঁরা কর্মসংস্থান বলেছিলেন। এরা সকলেই এই রকম কর্মসংস্থানের খোয়াব দেখায়। মিথ্যা শিল্পায়নের আকাশকুসুম দেখায়। যখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মে দেশে একটা নতুন কারখানা হলে পঞ্চাশটা পুরনো কারখানা বন্ধ হয়, সে সময় একটা কারখানা খোলা মানেই যে শিল্পায়ন নয়, এ সত্যকে ওরা ভুলিয়ে দিতে চায়। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম আবার বেকারত্বের সমস্যাকে উপেক্ষা করতে না পেরে সরকারকে উপদেশ দেয় ‘শিল্পপতিদের শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা’ দেওয়া হোক। এতেই কর্মসংস্থানে গতি আসবে। তারাও বলে না, এই প্রণোদনা তো সরকারগুলো দিয়েই চলেছে! কোভিডের সময় বিজেপি সরকার এই অজুহাতেই শিল্পপতিদের জন্য ঢালাও সাহায্য দিয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে প্রায় বিনা পয়সায় জমি পাইয়ে দিয়ে, বিনা সুদে ঋণের নামে কোটি কোটি টাকা অনুদান দিয়ে, জল-বিদ্যুৎ-সমস্ত ধরনের করের টাকা মকুব করে শিল্প স্থাপনের ঢাক অনেক বাজানো হয়েছে। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সকলেই একই কাজ করেছে। সিপিএম সিঙ্গুরে একই অজুহাতে চাষিকে মেরে, রক্ত ঝরিয়ে টাটাদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিল। বিজেপি সেই কারখানাকে একই কায়দায় গুজরাটে নিয়ে গিয়েছিল। গুজরাটে সেই ন্যানো কারখানাও চলেনি, চাষিও জমি ফিরে পায়নি। সুস্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য দরকার শ্রম নিবিড় শিল্প, আর আজকের দিনের পুঁজিপতিরা সেই ধরনের শিল্প গড়ে তুলতে একেবারেই রাজি নয়। তারা যে দু’চারটি কারখানা গড়ছে সেগুলি প্রযুক্তি নির্ভর, পুঁজি নির্ভর শিল্প, যেখানে শ্রমিকের প্রয়োজন একেবারেই ন্যূনতম। ফলে এখন হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের গল্প শোনালেও তাতে কর্মসংস্থান হয় না। ভোটবাজ রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বৃহৎ সংবাদমাধ্যম কেউই এই তথ্যটা বলে না। তারা বলে না– শিল্প-কারখানা চালাতে গেলে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ৭৬ বছরের স্বাধীন দেশে মানুষের কেনার ক্ষমতা এমনই তলানিতে নেমেছে যে নানা সমীক্ষা সংস্থা বারবার বলছে গ্রামাঞ্চলে তো বটেই শহরেও সাবান, শ্যাম্পু মাথার় তেলের মতো অতি সাধারণ ভোগ্যপণ্যের বিক্রিও কমছে। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সমীক্ষা দেখিয়েছে এ দেশের একেবারে নিচুতলার শ্রমিক-কর্মচারীর ঘরে দু-বেলা একজনের নিরামিষ খাবার জোগাড় করতেই আয়ের ২০ শতাংশ চলে যায়। চার-পাঁচ জনের সংসারে যখন একজন রোজগেরে মানুষ থাকে তাদের অবস্থা কেমন হয় তা বুঝতে কোনও তত্ত্ব ঘাঁটতে হয় না। আজ নিছক কাজের অধিকারের স্লোগান, কিংবা বিজেপি সরকারের সর্বনাশা শ্রম আইন নিয়ে শুকনো কিছু বিবৃতিতে কর্মসংস্থান হতে পারে না। সে জন্য বিজেপি বিরোধী কোনও দলই সে কংগ্রেসই হোক, কিংবা তৃণমূল বা সিপিএম কেউই নির্দিষ্টভাবে বলছে না– শ্রম নিবিড় শিল্প গড়ব, সরকারি উদ্যোগে নতুন শিল্প গড়ব, সরকারি কাজ-স্থায়ী কাজকে চুক্তি ভিত্তিক হতে দেব না।

আসলে এই দলগুলি শাসক হিসাবে পুঁজিপতিদের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের সরকার মানে পুজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার সরকার। তাই বিরোধী আসনে তারা যখন থাকে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ভোট পাওয়ার জন্য বেকারির বিরুদ্ধে গরম গরম স্লোগান তোলে। কার্যত সে স্লোগান ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছু নয়। এ দিকে পুঁজিবাদের সামগ্রিক স্বার্থেই তাদেরও দরকার হয় জনগণকে অন্তত প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা। তাই জনগণের ট্যাক্সের পয়সা থেকে তারা যেমন পুঁজিপতিদের তথাকথিত প্রণোদনা অঢেল দেয়, তেমনই জনগণের দিকেও কিছু কিছু খয়রাতি ছুঁড়ে দেয়। এই দলগুলির কেউই সমস্ত মানুষের কর্মসংস্থান তথা বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এমনিতেই এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তা সম্ভবও নয়। তার জন্য চাই নতুন সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা। কিন্তু এর মধ্যেও যতটুকু সমাধান করা যায় তা করতেও এরা অপারগ। তাতে তথাকথিত উদারিকরণের পথ থেকে সরে যেতে হবে। আর্থিক সংস্কারের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকের কাজ, কাজের সময়, সঠিক বেতন ইত্যাদি অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। আবার এই কাজগুলি করলে পুঁজিপতিদের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। নির্বাচনী বন্ড, কর্পোরেট চাঁদা কিছুই পাওয়া যায় না। বড় সংবাদমাধ্যম কাব্যিক ঢঙে ভোট প্রার্থীদের প্রচারের বিবরণ দিয়ে দলকে তুলে ধরবে না। ভোটের প্রতিশ্রুতি মানেই যে ‘জুমলা’ তা সাধারণ মানুষ এতদিনে একেবারে বোঝেননি তা নয়, তবু রাজনৈতিক চেতনার অভাবে এই চক্করে তাঁরা বারবার ফেঁসে যান। এর থেকে স্পষ্ট যে, মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের কোনও উপায় বর্তমান ব্যবস্থায় নেই। তার জন্য দরকার এসইউসিআই(সি) দীর্ঘদিন ধরে যা বলে আসছে–এই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। তার জন্য দরকার এই বিপ্লবী দলকে শক্তিশালী করা, দলের প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়ী করা।