70 Year 29 Issue 9 March 2018
এবার কয়লাখনি লুটের পাকাপাকি ব্যবস্থা করল মোদি সরকার৷ দেশে বাণিজ্যিকভাবে কয়লার উৎপাদন ও তা বাজারে বিক্রি করার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলিকে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা৷ এতদিন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খননের একচেটিয়া অধিকার ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কোল ইন্ডিয়ার হাতে৷ তাতে কয়লা উত্তোলন, বিক্রির উপর সরকারের কিছুটা হলেও রাশ ছিল৷ মন্ত্রীসভার এই সিদ্ধান্তে বেসরকারি মালিকরা বাড়তি সুবিধাপেলেন৷
কয়লা ক্ষেত্রকে একচেটিয়া মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি কী? সরকারের বক্তব্য– প্রথমত, কয়লা খনন ও কয়লা উৎপাদনের প্রতিযোগিতা অনেক বাড়বে৷ কয়লা উৎপাদনের খরচ কমবে৷ বাজারে কয়লার দাম কমলে বিদ্যুতের দামও কমবে৷ দ্বিতীয়ত, এই পদক্ষেপের ফলে দেশে প্রচুর লগ্নি আসবে, কয়েক লক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে৷
এতদিন শর্ত ছিল, বণ্টিত খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা ব্যবহার করা যাবে একমাত্র ক্যাপটিভ প্রয়োজনে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সিমেন্ট, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় নিজস্ব ব্যবহারের প্রয়োজনে কয়লা তুলতে পারত বেসরকারি সংস্থা৷ খোলা বাজারে সেই কয়লা নিয়ে ব্যবসা করা যেত না৷ এখন দেশি–বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিপতিরা তাও পারবে৷ কয়লার মূল্য নির্ধারণ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ায় এমনিতেই মূল্যবৃদ্ধিতে ন্যুব্জ সাধারণ মানুষের বোঝা বহুগুণ বাড়বে৷
কয়লাখনি বেসরকারিকরণে সরকারের বক্তব্যের মধ্যে কি আদৌ কোনও সত্য আছে? বিদ্যুতের দাম কমার গল্প এ রাজ্যের মানুষের আগেই শোনা৷ ধনকুবের গোয়েঙ্কার হাতে বিদ্যুৎ কোম্পানি তুলে দেওয়ার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু রাজ্যের সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে, গোয়েঙ্কার হাতে বিদ্যুৎ দপ্তর তুলে দিলে কর্পোরেট শিল্পগোষ্ঠীর পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় বিদ্যুতের দাম কমে যাবে৷ কিন্তু মানুষ জানেন, বিদ্যুতের দাম তো কমেইনি, উল্টে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে৷ আর কয়লার দাম কমলে বিদ্যুতের দাম কমবে, এটাই প্রত্যাশিত৷ কিন্তু সরকার কি তা কমায়? বর্তমানে কয়লার দাম ৫০ শতাংশ কমে গেলেও এবং বিদ্যুৎগ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকা দাম কমানোর দাবিতে বারবার আন্দোলন করলেও বিদ্যুতের দাম কমায়নি সরকার৷ ফলে কয়লাখনি বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়৷
কয়লাখনি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিলে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হবে— এ কথার ভিত্তি কী? বাস্তবে এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যাতে বিপুল কর্মসংস্থান হচ্ছে৷ এমনকী উৎপাদন ক্ষেত্র, তথ্যপ্রযুক্তি– এ সমস্ত ক্ষেত্রেও আগে যেটুকু কর্মসংস্থান হত, এখন তাও পুঁজিবাদের বাজার সংকটের কারণে হচ্ছে না৷ তথ্য বলছে, উৎপাদন ও পরিবহণ ক্ষেত্রে ২০১৬–১৭ অর্থবর্ষেই ছাঁটাই হয়েছে ৯০ হাজার কর্মী (লেবার ব্যুরোর রিপোর্ট)৷ কোথায় তাহলে বিপুল কর্মসংস্থান হচ্ছে?
কয়লাখনির মালিকদের স্বার্থেই সরকার বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তা গ্রহণযোগ্য করতে সাধারণ মানুষের স্বার্থের ধুয়ো তুলছে৷ এটা সব শাসকেরই দস্তুর৷ কংগ্রেসের আমলে কয়লাখনি বেসরকারিকরণের কাজ শুরু হয়েছিল৷ তখন বিজেপি সংসদে বিরোধী থাকায় তা নিয়ে ‘সোচ্চার’ হয়েছিল৷ ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সরকার ২০১৫ সালে পুরনো আইন সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং সেই প্রক্রিয়ায় অবশেষে দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে বেচে দিচ্ছে৷
দেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বহুল ব্যবহূত জ্বালানি কয়লা৷ পূর্ব ও মধ্য ভারতের আকরিক কয়লা সমৃদ্ধ রাজ্যগুলির পরিবেশবিদ, ভূবিজ্ঞানী, সরকার, সাধারণ মানুষ কারও মত না নিয়েই কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নিল কারণ, কংগ্রেস কিংবা বিজেপি সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থেই পরিচালিত হচ্ছে৷ কয়লাখনি বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত তার অন্যতম উদাহরণ৷ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যাতে পুঁজিপতিদের আর্শীবাদ ধন্য হয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়া যায় সেজন্য তাদের অবাধ লুটতরাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে বিজেপি৷