লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো ঘটনাতেও বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার লজ্জা পেয়েছে এমন উদাহরণ খুঁজে বার করা অসম্ভব। তাই আয়ারল্যান্ড ও জার্মানির দুই আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশ্বজুড়ে চালানো সমীক্ষাতে ভারত ক্ষুধা সূচকে ‘উদ্বেগজনক’ স্থানে দাঁড়ালেও সরকার তথা বিজেপি কোনও লজ্জা বোধ করেনি। শুধু তাই নয়, পুরো সমীক্ষাটাকেই উড়িয়ে দিতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সমীক্ষা দেখিয়েছে ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭ নম্বর স্থানে দাঁড়িয়ে আছে ভারত। মূলত চারটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের ভিত্তিতে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক নির্ণয় করে তারা। চারটি বিষয় হল–মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ সঠিক ক্যালরির খাদ্য থেকে বঞ্চিত, ৫ বছরের মধ্যে কত শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম (চাইল্ডহুড স্টান্টিং), বয়স এবং উচ্চতার অনুপাতে শিশুদের কম ওজন (চাইল্ডহুড ওয়েস্টিং) এবং ৫ বছর বয়সের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার। ভারতের অবস্থান এই সবকটি নিরিখেই বেশ খারাপ। এর মধ্যে চাইল্ডহুড ওয়েস্টিংয়ের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিচে। এই রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে সামগ্রিক জনসংখ্যার জন্য ন্যূনতম পুষ্টি এবং শিশুদের গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির দিক থেকে ক্রমাগত খারাপ অবস্থানে যাচ্ছে।
ভারত রাষ্ট্রসংঘের সুস্থায়ী উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট কর্মসূচির অন্যতম সূত্রগুলি অনুসরণ করেই সমীক্ষকরা বিশ্বের ১২১টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করেন। এই বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের থেকে নিচুতে। একমাত্র আফগানিস্তান ভারতের নিচে থেকে নরেন্দ্র মোদি সাহেবদের কিছুটা মান বাঁচিয়েছে। কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি যথারীতি চক্রান্তের অভিযোগ তুলে বলেছে, নরেন্দ্র মোদির রামরাজ্যের বদনাম করতেই বিদেশিরা এই মিথ্যা ছড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্ন তুলেছে অপুষ্টি মাপার পদ্ধতি এবং শিশুদের অপুষ্টি ও কম ওজনকে অপুষ্টির সামগ্রিক সূচক বলা যায় কি না তা নিয়ে। যদিও দ্য স্কে্রাল, এনডি টিভির মতো সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ, পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মত হল সঠিক পদ্ধতিতে নেওয়া পরিসংখ্যান এবং ভারত সরকারের হাউসহোল্ড ফ্যামিলি সার্ভের তথ্যকেই এই ক্ষুধা সূচক তৈরিতে কাজে লাগানো হয়েছে।
কতটা ভয়াবহ এই পরিস্থিতি? সরকারি-বেসরকারি সমীক্ষা বলছে রেশনে চালগম বিনামূল্যে পাওয়ার পরেও গ্রামে এবং শহরে বিরাট অংশের পরিবার এমনকি তাদের শিশুদের পর্যন্ত পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার কথা ভাবতেই পারছে না। এ দেশে এত বিকাশ হয়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকারকেই মাত্র দু’বছর আগে বলতে হয়েছে ৮০ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যশস্য প্রয়োজন। ১৯.৩ শতাংশ শিশু কম ওজন এবং উচ্চতার সমস্যায় ভুগছে। ২২ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ দুবেলা পেটভরে খাবার পান না। ৫ বছরের কম বয়সী ৭ কোটির বেশি শিশু এবং সন্তানসম্ভবা মায়েরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি থেকে যতটুকু পুষ্টি পেতেন তাতেও ঘাটতি চলছে দীর্ঘ সময়। স্কুলে মিড ডে মিলে সরকারের বরাদ্দ প্রাথমিকে শিশুপ্রতি ৫ টাকারও কম এবং উচ্চ প্রাথমিকে প্রায় ৮ টাকা। এতে পুষ্টিকর খাদ্য তো দূরের কথা পেটভরা খাবার দেওয়াই সমস্যার।
দেশের মাটির সাথে ন্যূনতম যোগ থাকলে কি এই সব তথ্য কেউ অস্বীকার করতে পারে? কিন্তু বিজেপি সরকার গায়ের জোরে সেটাই করছে। তাঁরা যত বিকাশ, আত্মনির্ভরতার কথা বলেছেন, ততই মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের সিন্দুক উপচে পড়েছে অন্য দিকে অধিকাংশ জনগণ সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। অতিমারিজনিত লকডাউনের মধ্যে ভারতে নতুন করে ৪০ জন ধনকুবেরের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিমালিক গৌতম আদানি বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী হওয়ার গর্বে ভারত সরকারের বুক ফুলে উঠছে। অন্য দিকে গ্রাম শহরের প্রতিটি সাধারণ পরিবারে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। কমেছে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট, অর্থাৎ আগে যত লোক কাজের বাজারে এসে কাজ পেতেন তার সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে। দেশের কর্মক্ষম মানুষের ৫১ শতাংশের বেশির কোনও রোজগার নেই। এদিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে রকেট গতিতে, বেড়েছে জ্বালানির দাম, পরিবহণ ভাড়া ইত্যাদি সব খরচই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য ও কৃষি বিভাগই গম, চাল, ডাল ও তৈলবীজের বিপুল দামবৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্যসুরক্ষা প্রকল্পে রেশনে গম সরবরাহ বন্ধ করেছে উৎপাদনে ঘাটতির কারণ দেখিয়ে। তারাই গম-চালের বাড়তি দামের অজুহাতে মিলেট জাতীয় খাদ্যশস্যের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সওয়াল করছে।
একই সাথে বেসরকারি সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ কাজ করেন, তাতে প্রকৃত বেতন কমেছে। সাবান, শ্যাম্পুর সবচেয়ে ছোট প্যাকের মতো একেবারে অতিসাধারণ ভোগ্যপণ্যের বিক্রিও গ্রামে এমনকি শহরাঞ্চলেও কমছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন কলকারখানা খোলা দূরে থাক চালু সংস্থা বন্ধ হচ্ছে। ২০১৯ সালে সরকার সংসদে জানিয়েছিল দেশে রেজিস্টার্ড কোম্পানির ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬ লক্ষ ৮০ হাজার বন্ধ হয়ে গেছে (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ১৯.০৭.২০১৯)। ২০২১-এ সরকার জানিয়েছে ৭ লক্ষ নতুন কোম্পানি রেজিস্টার্ড হয়েছে গত ৬ বছরে (ইকনমিক টাইমস ২০.১১.২০২১)। যদিও এই সমস্ত কোম্পানির অনেকগুলিই শুধু খাতা কলমে থাকা কোম্পানি, বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। সরকারের হিসাব মেনে নিলেও দেখা যাচ্ছে যত সংস্থা বন্ধ হয়েছে তার ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। লে-অফ, অর্ধেক উৎপাদন, শ্রমিকদের সপ্তাহে দু-তিনদিন কাজ দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আরও অসংখ্য কারখানা। এই সমস্ত কলকারখানার শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের খাদ্য, পুষ্টিকোথা থেকে আসবে? কেন্দ্রীয় সরকার এ নিয়়ে চিন্তা করবে কি, তারা বরং রেশনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ থেকে হাত গুটিয়ে ফেলতে বেশি আগ্রহী। নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের ত্রাতা বলে তাঁর দলের প্রচারের শেষ নেই। সেই ভারতেই বাড়ছে অর্ধভুক্ত মানুষের সংখ্যা। এ দেশটা আসলে কাদের, মুষ্টিমেয় ধনকুবের, না ৯৯ শতাংশ খেটে খাওয়া মানুষের?