ক্ষমতা বড় বালাই

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পা ধুইয়ে দিচ্ছেন৷ কার? কুম্ভ মেলার সাফাই কর্মীদের৷ হ্যাঁ, এমনই একটি ছবি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে৷ আপাত অর্থে মনে হতে পারে দৃশ্যটা কতটা মানবিক! মনে হতে পারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কতটা সহমর্মী

বাস্তবটা কিন্তু অন্য৷ যাদের পায়ের তলায় বসে পা ধুইয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁরা কারা? তাঁরা এই দেশের সেই মানুষ যারা যুগ যুগ ধরে ‘অনগ্রসর’,‘নিম্নবর্গীয়’, ‘দলিত’ ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত৷ ভারতের ইতিহাসে হিন্দুধর্ম ভিত্তিক বর্ণাশ্রম প্রথার সামাজিক বিভাজনে যারা, ‘শূদ্র’ হয়ে উচ্চবর্ণের সেবায় নিয়োজিত ছিল, যাদের সাথে উচ্চবর্ণের সামাজিক সম্পর্ক তো দূরের কথা, যাদের ছায়া মাড়ানোও চিরকাল পাপ, এরা তারাই৷ তা হলে প্রধানমন্ত্রী এদের পা ধুইয়ে দিলেন কেন? মানবতা? মূল্যবোধ? ঔদার্য্য? না ভোট? কোন প্রণোদনায়? এ প্রশ্ন তো থেকেই যায়৷ কারণ এ দেশে এই শ্রেণির মানুষের জীবন–যন্ত্রণা বড় নির্মম৷ বাড়ি বাড়ি নর্দমা ও সেপ্টিক ট্যাঙ্কের আবর্জনা, মল–মূত্র বালতি, ঝুড়ি, কোদাল দিয়ে পরিষ্কার করা এদের জীবিকা৷ নর্দমার গভীরে নামায় মিথেন গ্যাসের বলি হয়ে মারাও যেতে হয় অনেককেই৷ কোনও রকম নিরাপত্তা ছাড়া যুগের পর যুগ এভাবেই কাজ করে চলেছে এরা৷

বিষয়টার ভয়াবহতা লক্ষ করে ১৯৯৩ সালে মানুষকে দিয়ে এই ধরনের কাজ করানোকে আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ ২০১৩ সালে যা সংবিধানভুক্তও হয়েছে৷ তাতে কিন্তু এই জীবিকায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি কমেনি৷ বর্তমানে এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ৮ লাখেরও বেশি মানুষ৷ কিন্তু সরকারগুলির ভূমিকা কী? এদের উন্নতির জন্য কী দায়িত্ব পালন করেছে সরকারগুলি? আরটিআই এর তথ্য অনুযায়ী, এই পেশায় নিযুক্ত মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য স্ব–নিযুক্তি প্রকল্পে অর্থ দেওয়া হয়৷ সেই অর্থ এই শ্রেণির মানুষের পুনর্বাসনের জন্য খরচ করার কথা সরকারের৷ যদিও এনএসকেএফডিসি (ন্যাশনাল সাফাই কর্মচারী ফিনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭–২০১৮ আর্থিক বছরে এই শ্রেণির মানুষের উন্নতির জন্য বরাদ্দ ২৪ কোটি টাকা খরচ না হয়ে পড়ে রয়েছে৷ কেন পড়ে রইল এই টাকা? সমাজের এই শ্রেণির সমস্ত মানুষের পুনর্বাসন ও উন্নতি কি সরকার এত করেছে যে আর খরচ করার জায়গা নেই? না, মোটেই তা নয়৷ চিত্র ঠিক এর বিপরীত৷ আজও সামাজিক সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিগত কয়েক বছরে বিজেপি সরকারের আমলে বেড়েছে দলিতদের উপর অত্যাচার৷ বেড়েছে গণপ্রহার, গুম খুনে মৃত্যুর ঘটনা৷ সরকার কিন্তু এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দেয়নি কোথাও৷ উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট সহ একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্যে গোরক্ষার নামে হত্যা করা হয়েছে দলিত সাধারণ ভারতবাসীকে৷ তখনও নীরবতাই পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তারপর এই পা ধুইয়ে দেওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক নাটক ছাড়া আর কী?

ভোট বড় বালাই৷ তাই ভোটের জন্য সারা বছর মালিকের পদসেবা করা নরেন্দ্র মোদিকেও এসে বসতে হয় সাফাই কর্মীদের পায়ের তলায়৷ ধুইয়ে দিতে হয় পা৷ আর তাই ছবি হয়ে ঘুরতে থাকে সংবাদমাধ্যমে, সোসাল মিডিয়ায়৷ আমরা তাই–ই দেখি আর বৃহত্তম গণতন্ত্রের জয়জয়কার করি উপলব্ধি করি না সংসদীয় ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির নীচতা, কৃত্রিমতা, ভণ্ডামিকে৷ সাফাই কর্মীদের পায়ের তলায় বসে বিজ্ঞাপন দিয়ে নরেন্দ্র মোদি আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার স্বপ্ন দেখছেন৷ যা সস্তা স্টান্টবাজি কৌশল ছাড়া কিছুই না৷ ক্ষমতার লোভই মুখ্য৷ পা ধোয়ানোটা উপলক্ষ মাত্র৷ গালিব যথার্থই বলেছেন…

‘‘উম্র ভর গালিব

এহি ভুল করতা রহা

ধুল চেহেরে পে থি

অউর আইনা সাফ করতা রহা৷’’

– অর্থাৎ নিজের গায়ের নোংরা ঢাকতে আয়না পরিষ্কার করে গেল৷

সুমন দাস

যাদবপুর

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩১ সংখ্যা)