গত ২৫ মে কোবরাপোস্ট নামে একটি ওয়েব পোর্টাল ‘অপারেশন ১৩৬’ নামে একটি ভিডিও প্রকাশ করে৷ প্রকাশের সাথে সাথেই দেশজুড়ে সাড়া পড়ে যায়৷ ওই ভিডিও–প্রচার আটকাতে কয়েকটি মিডিয়া সঙ্গে সঙ্গে কোর্টে যায়৷ মিডিয়ার মুখ বন্ধ করতে মিডিয়াকেই অতি সক্রিয় হয়ে কোর্টে যেতে হল কী এমন রয়েছে ওই ভিডিও ক্লিপিংসগুলিতে?
গোপন ক্যামেরার সাহায্যে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা এদেশে আগেও হয়েছে৷ বহু অপরাধ ধরাও পড়েছে৷ একে বলা হয় স্টিং অপারেশন৷ ‘অপারেশন ১৩৬’ কোবরাপোস্টের এরকমই একটি স্টিং অপারেশন৷ এই ভিডিওয় দেখা গেছে ভারতের তাবড় মিডিয়া হাউসের বড়কর্তারা কথা বলছেন কোবরাপোস্টের এক সাংবাদিকের সঙ্গে, যিনি ভিডিওতে নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘শ্রীমদভগবৎগীতা প্রচার সমিতি’র‘আচার্য অটল’ হিসেবে৷ বলা বাহুল্য, এই প্রচার সমিতি ও তার আচার্য সবটাই ভুয়ো৷ ভিডিওটিতে দেখা গেছে, ‘আচার্য অটল’ এইসব মিডিয়া হাউসের বড়কর্তাদের সংঘ পরিবারের হয়ে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার জমি তৈরির জন্য বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রূপ প্রচারের পাশাপাশি নরম হিন্দুত্বের প্রসারের জন্য অনুরোধ করছেন৷ দেখা গেছে, মোটা টাকা পাওয়ার বিনিময়ে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের কর্তা সে অনুরোধে রাজিও হচ্ছেন৷
অর্থের বিনিময়ে খবর তৈরির অপচেষ্টা নতুন কিছু নয়৷ কংগ্রেস, বিজেপি, আঞ্চলিক নানা দল, এমনকী বাম নামধারী দলগুলির হয়েও আঞ্চলিক বা জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি যথেষ্ট তৎপরতায় কাজ করে থাকে৷ সংসদীয় দলগুলির নানাভাবে প্রশস্তি করা, জনস্বার্থে লড়া সত্যিকারের বিপ্লবী দলগুলির প্রচার না দেওয়া, বিজ্ঞাপনের লোভে পাতায় পাতায় গুরুত্ব দিয়ে সরকারি দলের খবর ছাপা, চ্যানেলের স্লট বিক্রি, হিন্দুত্ববাদী দলগুলির হয়ে ধর্মীয় অন্ধতা–কুসংস্কারের ব্যাপক প্রসার সবই তারা করে চলেছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে৷ এভাবেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা–বিশ্বাসযোগ্যতা-নৈতিকতা আজ প্রায় বিকিয়ে যেতে বসেছে৷
এখন সংবাদমাধ্যমের মালিক হয়ে বসেছে কর্পোরেট পুঁজিপতিরা৷ যাদের বলা হয় মিডিয়া ব্যারন৷ তৈরি হয়েছে কর্পোরেট পুঁজি–মিডিয়া–রাষ্ট্রশক্তির অশুভ আঁতাত৷ তাই একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে, একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাস সরকারি দলের স্বার্থে, সর্বোপরি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রশক্তির সামগ্রিক স্বার্থে, সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতাকেও বিক্রয়যোগ্য পণ্য করা হচ্ছে৷
অথচ সত্য উদঘাটন, ন্যায়ের পক্ষে জনমত গঠন, সরকার বা রাষ্ট্রের অন্যায় নীতির সমালোচনা করে সমাজমনন তৈরির ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা সুবিদিত৷ প্রশ্ন–পাল্টা প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের সুদৃঢ় ভিত রচনা করতে ও প্রয়োজনে জনবিরোধী শাসকের অন্যায় শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম৷ একসময় অর্থবল, রাজনৈতিক প্রতিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে সমাজের চোখের সামনে সত্য প্রতিষ্ঠা করার আকাঙক্ষা থেকেই গঠিত হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের গণতন্ত্র–নৈতিকতা– ভিত্তি৷ আজও সৎ সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রশক্তির হাতে, কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক ধর্মবাদী–জাতিবাদী গুণ্ডা ও খুনে বাহিনীর হাতে অবিরত আক্রান্ত ও নির্যাতিত হতে হচ্ছে৷ এই সংগ্রামী ধারাকেই শক্তিশালী করতে হবে জনতার আপন স্বার্থে, গণকণ্ঠকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে৷
(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)