রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, ভিয়েতনাম বিপ্লব সহ বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে জোয়ার একদিন বিশ্বে উঠেছিল, শোধনবাদী আক্রমণে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর তা আজ নিদারুণ ভাটায় পরিণত৷ কিন্তু, পুঁজিবাদী শোষণ, সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন আছেই এবং বাড়ছেই৷ তাই দেশে দেশে শোষিত, মেহনতি মানুষের মনে শোষণহীন সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন আজও কাজ করে৷ পুঁজিবাদের দুঃসহ যন্ত্রণা, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও ধ্বংস মানুষকে সমাজ বদলের আকাঙক্ষায় তোলপাড় করে দেয়৷ সুস্থ ও বৈষম্যহীন সমাজের কথা ভাবায়৷ একেই এ যুগের বামপন্থা বলে বুঝতে হবে৷
কথাগুলি আবার বলতে হল, সিপিএমের ব্রিগেড সমাবেশকে কেন্দ্র করে বামফ্রন্ট নেতাদের ও মিডিয়ার প্রচার দেখে৷ সিপিএম দল ও মিডিয়ার প্রচারে বার বার বলা হয়েছে ‘বামপন্থীদের ডাকা ব্রিগেড সমাবেশ’৷ কিন্তু যে সমাবেশ হয়ে গেল, যা দেখে বামফ্রন্ট নেতারা উল্লসিত হয়েছেন, সেখান থেকে বামপন্থার কী পাওয়া গেল?
সিপিএম দলের মুখপত্রে প্রকাশিত নেতাদের বক্তৃতায় সমাজ বদলের স্বপ্নের ছিটেফোঁটাও পাওয়া গেল না৷ শুধু আছে ভোট ও আগামী লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের শক্তি বাড়ানোর ডাক৷ ‘বামেরাই বিকল্প দেখাতে পারবে’– এই সব আছে স্লোগানের মতো করে অনেক নেতার ভাষণে৷ কিন্তু বিকল্পটা কী? কংগ্রেস, বিজেপি বা তৃণমূলের মতো দলগুলি যেমন বলে, তারা ভোটে জিতলে ‘এই দেবে’, ‘ওই দেবে’, সিপিএম নেতাদের বক্তব্য তার থেকে আলাদা কিছু ছিল না৷ ইউ পি এ সরকারের সময় কীভাবে সিপিএম–এর চাপেই কিছু প্রকল্প চালু হয়েছিল সে কথা স্মরণ করিয়ে নেতারা বলেছেন, লোকসভায় শক্তি বাড়ালে আবার ‘সেই সব প্রকল্প’ এবং সুবিধা দেওয়াই বামপন্থী বিকল্প আরও একটি গুরুতর প্রশ্ন ওঠে– দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় বামফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকার চালিয়েছে৷ রাজনীতি–অর্থনীতি–সমাজ-সংস্কৃতি কোন ক্ষেত্রে কী বিকল্পের তারা চর্চা করেছিলেন? পশ্চিমবঙ্গকে কোন বিকল্পের সন্ধান তাঁরা দিয়েছিলেন? এখন যদি তারা সরকার গঠনের আওয়াজ তুলে বিকল্পের কথা বলেন, তবে তো প্রশ্ন উঠবেই– কোন বিকল্পের কথা বলছেন কমরেড? ৩৪ বছরের শাসনে তো বামপন্থাকে প্রায় কবরে পাঠানো হয়েছিল৷ আজও সাধারণ মানুষ সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলতে পারেনি৷ আজ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সর্বক্ষেত্রে যে ধ্বংসাত্মক নীতি নিয়ে চলছে, তার গোড়াপত্তন তো হয়েছিল বামফ্রন্টের শাসনেই৷ রাজনৈতিক ও সামাজিক নৈতিকতার ভরাডুবি ঘটানো হয়েছিল ৩৪ বছরে৷ তবুও নেতারা বলেছিলেন ‘সব ঠিক হ্যায়, গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বামফ্রন্ট শাসন নাকি বিশ্বের বামপন্থীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে৷’ এখন এ রাজ্যে মানুষ হিসাব করে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কে এগিয়ে– বামফ্রন্ট না তৃণমূল? কূকর্মে কে কম বা কে বেশি?
২০০৬ সালে বামফ্রন্ট স্লোগান তুলেছিল, ‘বামফ্রন্টের বিকল্প উন্নততর বামফ্রন্ট’৷ প্রচুর আসন জিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ফিরেছিল৷ পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ২০১১ সালে সেই উন্নততর বামফ্রন্টের পতন কেন ঘটল তার বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ সিপিএম নেতারা কী করেছেন জানা নেই৷ ওই পর্বেই সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের জমি চাষির রক্তে ভিজেছিল৷
সিপিএম ও তার শরিকদলগুলি কি ১৯৭৭ সালে সরকারে যাওয়ার পর বামপন্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল? না, বিচ্যুতি তাদের শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারে যাওয়ার পর থেকেই৷ ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনে যৌথভাবে বামপন্থী দলগুলি লড়াকু ভূমিকা নিয়েছিল৷ ১৯৬৭ ও পরে ১৯৬৯ সালে দু’বার যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ার পর সিপিএম–এর রাজনীতির অভিমুখ লড়াই–আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে ভোট ও সরকার হয়ে দাঁড়ায়৷ ১৯৭৭ সালে তারা বুর্জোয়া শ্রেণির আশীর্বাদ নিয়ে সরকারে বসে ও বারবার ভোটে জয়ী হয়ে এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে যায় যে, তারা সরকারে চিরস্থায়ী হবে৷ সেই আশা ভঙ্গ হতেই দল প্রায় ছত্রভঙ্গ৷ এখন লোকসভা নির্বাচনে যদি আসন ধরে রাখার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির ঝান্ডা হাতে তুলে নিতে হয়– কোনও সমস্যা নেই৷ এই হিসাবটাই সিপিএম–এর নেতাকর্মীরা সর্বদা করে চলেছেন৷ এতেই বোঝা যায় সিপিএম নেতা–কর্মীরা কেমন জাতের বামপন্থার চর্চা করেছেন ও করিয়েছেন৷ ক্ষমতাসীন এক সরকারকে হঠিয়ে বামপন্থীরা বেশি আসন দখল করলেই বামপন্থার জয়? এই রাজনীতির চর্চা করে বামপন্থার অনেক সর্বনাশ করেছেন কমরেড, এবার থামুন৷ ভোটসর্বস্ব রাজনীতি করছেন করুন– দোহাই, তাকে বামপন্থা বলবেন না৷