চার বছর আগের কথা ভাবুন৷ প্রচারের বন্যায় দেশকে একেবারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ নরেন্দ্র মোদি ‘বিকাশ পুরুষ’, তাঁর নেতৃত্বে দেশে ‘আচ্ছে দিন’ আসছে, তাঁর শাসনে দেশের কালো টাকার মালিকরা থরথর করে কাঁপবে৷ বিদেশ থেকে সব কালো টাকা উদ্ধার করে সবার অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা করে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, বছরে চাকরি পাবে দুই কোটি বেকার, কৃষকের ঘরে সুদিন ফিরবে, শ্রমিকের অন্ধকার ঘরে আশার আলো জ্বলবে, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ভারতে মানুষ প্রাণভরে নির্মল বায়ু সেবন করতে পারবে৷ বলা হয়েছিল – ‘এ রাজত্বে নাহি রবে হিংসা–ত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা’
উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল গুজরাট মডেলের কথা৷ নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রীত্বে সেখানে নাকি প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে নানা ভাষায়, ৮৪৩ টা টিভি চ্যানেল বছরভর এই ধরনের প্রচার চালানো হয়েছিল৷ শোনা যায়, এই প্রচারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি খরচ করেছিল এক লক্ষ কোটি টাকা৷ মোদিজিও সেদিন বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, ঘুষ খাব না, কাউকে খেতেও দেব না৷ বলেছিলেন, ‘৬০ দিনেই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করব’– এই রকম আরও কত কী সংকটদীর্ণ মানুষ ভেবেছিল– হবেও বা ভেবেছিল হয়তো মোদিজির রাজত্বে সুদিনের দেখা মিলবে৷ কর্পোরেট হাউস নিয়ন্ত্রিত ‘মোদি বন্দনা’ দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত আশার জন্ম দিয়েছিল৷ এবং সবচেয়ে বড় কথা হল মিডিয়ার এই সর্বগ্রাসী প্রচারের বন্যায় বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশও তখন বিভ্রান্ত হয়েছিলেন৷
আমরা গণদাবীর পাতায় তখনই বলেছিলাম–‘ঢাক–ঢোল যতই বাজানো হোক, নরেন্দ্র মোদি বা মোদির বিজেপি, আর্থিক নীতির প্রশ্নে কংগ্রেস বা অন্য কোনও বুর্জোয়া দলের থেকে আলাদা বা বিকল্প নয়৷ সেই বিশ্বায়ন, সেই উদারনীতি–সবই এক, শুধু বলবার ঢং ও বুলি একটু আলাদা’ (৬৬ বর্ষ, ৪১ সংখ্যা, ৩০মে–৫ জুন,২০১৪)৷ সেই দিনই আমরা বলেছিলাম, নরেন্দ্র মোদি বা তাঁর সরকার গরিবদের স্বার্থে কাজ করতে পারে না, সে ক্ষমতা তাঁর নেই, তাঁকে কাজ করতে হবে, পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের মতোই এ দেশের বৃহৎ বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থে৷ বলেছিলাম – নরেন্দ্র মোদি এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির জীবন্ত স্বার্থরক্ষক৷ এ দেশের সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদকে রক্ষা করার চেষ্টায় তাঁকে নানা ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করতে হবে৷ আর সেই পথে যত তিনি পা বাড়াবেন ততই তাঁকে জনগণের ঘাড়ের উপর আরও সংকটের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে৷ ফলে নরেন্দ্র মোদি যাই বলুন না কেন, তাঁর রাজত্বে দেশের শিল্পের বিকাশ হবে না, বেকারির সমস্যা সমাধান তো দূরের কথা, তা আরও তীব্রতর হবে, কালো টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে, দুর্নীতি হবে আকাশছোঁয়া, মূল্যবৃদ্ধি সীমা ছাড়িয়ে যাবে, গরিবি ও দারিদ্র বাড়তেই থাকবে৷ এ সব কথা আমরা শুধু বিরোধিতার জন্য বলিনি৷ বলেছিলাম, দেশের আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থাকে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ করে৷ আমাদের সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে৷
বছরে দুই কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মোদিজি দিয়েছিলেন তার কথাই ধরা যাক৷ সরকারি হিসাবই বলছে, ২০১১ সালে যেখানে ৯.৩০ লক্ষ নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছিল সেখানে ২০১৬ সালে তৈরি হয়েছিল ২.৩১ লক্ষ৷ ২০১৭ সালে দুই লক্ষ নতুন কাজের সুযোগও তৈরি হয়নি৷ অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা উত্তরপ্রদেশের একটা ঘটনা থেকেই বোঝা যায়৷ সেখানে সরকারি অফিসে ৩৬৬টি পিওনের পদে আবেদন জমা পড়েছে ২৩ লক্ষ৷ এর মধ্যে ২৫৫ জন পিএইচডি, ২ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ৷ এই রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়৷
এটাই স্বাভাবিক৷ বহুদিন আগেই মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন, বর্তমানে বিশ্ব পুঁজিবাদী বাজারের তৃতীয় তীব্র সাধারণ সংকটের যুগে শিল্পের অপ্রতিহত বিকাশ ঘটিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান করা পুঁজিবাদের পক্ষে অসম্ভব৷ বেকারদের কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সংকটের এই ভয়াবহ চেহারাই আমরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছি৷ মোদিজি সরকারি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিদের ঢালাও সুযোগের বন্দোবস্ত করে দিতে পারেন, তাদের বিনা পয়সায় জমি, জল, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া ঋণ মকুব করে দিতে পারেন, ওরাও খুশি হয়ে তাঁকে ‘শিল্পবান্ধব’, ‘বিকাশ পুরুষ’ খেতাব দিতে পারে– কিন্তু এর ফলে তো সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়বে না৷ সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা না বাড়লে শিল্পজাত দ্রব্য কিনবে কে? আর শিল্পজাত দ্রব্য যদি বিক্রি না হয় তবে শিল্পপতিরাই বা নতুন নতুন কল–কারখানা খুলবে কেন? আর নতুন নতুন কল–কারখানা যদি না খোলে তবে বেকাররাই বা কাজ পাবে কোথায়? ঠিক এই ঘটনাই ঘটছে আমাদের দেশে৷ তাই আমরা দেখছি, এ দেশে ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ আর বিদেশি বিনিয়োগও যতটুকু আসছে তা নতুন কল–কারখানা খোলার জন্য নয়, তা আসছে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংস্থার অংশীদারিত্বের হাত বদলের জন্য৷ ফলে নতুন কল–কারখানা খুলছে না, বরং পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য পুরনো কল–কারখানা৷ ফলে লক্ষ লক্ষ কর্মরত শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে মোদিজির রাজত্বে যতটুকু নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার তুলনায় সাধারণ মানুষ কাজ হারাচ্ছে অনেক গুণ বেশি৷ ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে এবং এই সংখ্যা এভাবে বাড়তেই থাকবে৷
মানুষের সংকুচিত ক্রয়ক্ষমতাকে মোদিজির চার বছরের শাসন আরও সংকুচিত করেছে৷ পেট্রল, ডিজেলের দামের কথাই ভাবুন– ২০১৪ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ক্রমাগত কমছে৷ সরকার যদি জনগণের কথা একটুও ভাবত তা হলে দাম কমার এই সুবিধা সে জনগণকে দিত– পেট্রল ও ডিজেলের দাম কমাতো৷ কিন্তু মোদিজির সরকার হাঁটলেন ঠিক উল্টো পথেই৷ ওঁরা এই সুযোগ সরকারি তহবিল পূরণের কাজে ব্যবহার করলেন৷ পেট্রলের উপর সেন্ট্রাল এক্সাইজ ট্যাক্স বাড়ালেন ২০০ শতাংশ আর ডিজেলের উপর বাড়ালেন ৪০০ শতাংশ৷ এর ফলে পেট্রল, ডিজেলের দাম হয়ে গেল ইতিহাসে সর্বোচ্চ–সরকার জনগণের ঘাড় ভেঙে আদায় করল দশ লক্ষ কোটি টাকার উপর৷শুধু পেট্রল–ডিজেলের দাম বাড়ল না, দাম বাড়ল চাল–ডাল–তেল–নুন সহ সমস্ত জিনিসপত্রের৷ পরিবহণের ভাড়া বাড়ল, জনগণের জীবনে সংকট আরও ঘনীভূত হল৷
আর এই নিয়ন্ত্রণহীন, মুনাফাবাজির ফলে সবথেকে লাভবান হচ্ছে কারা? কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী– ২০১৪ সালে দেশে ৫১ হাজার পেট্রল পাম্প ছিল যার মধ্যে বেসরকারি কোম্পানির (মূলত রিলায়েন্স)পাম্প ছিল ৩ হাজারের কম৷ মোদিজির চার বছরের রাজত্বে এই বেসরকারি কোম্পানির পেট্রল পাম্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজারের কাছাকাছি৷ এখন দেশের তেল বাজারের প্রায় ৮ শতাংশ এদের দখলে৷ অর্থাৎ তেলের দামের বিনিয়ন্ত্রণের ফলে সব থেকে বেশি লাভবান হচ্ছে দেশি ও বিদেশি তেল কোম্পানিগুলি৷ কেরোসিনের দাম হয়েছে এই সময়ে দ্বিগুণ, আর সিলিন্ডার প্রতি ভর্তুকি যুক্ত রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে ৮০ টাকা৷ সব মিলিয়ে মানুষের একেবারে প্রাণান্তকর দশা৷
মোদিজির এই চার বছরের রাজত্বে সমস্ত ক্ষেত্রের মধ্যে বেশি সংকটের ধাক্কা পড়েছে কৃষক জীবনে৷ সার–বীজ–তেল সহ কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দ্রব্যসামগ্রীর দাম যেমন বেড়েছে ভয়ঙ্কর গতিতে, তেমনি কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম পাওয়ার কোনও ব্যবস্থাই করতে পারেনি এই সরকার৷ ক্ষমতায় যাওয়ার আগে মোদিজি বলেছিলেন, কৃষিপণ্য উৎপাদনের খরচের উপর ৫০ শতাংশ লাভ পাওয়ার ব্যবস্থা সরকার করবে৷ কিন্তু তা করা তো দূরের কথা সরকার সমস্ত সংগ্রহ ব্যবস্থাকেই কার্যত ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে৷ ফলে দেশের কোটি কোটি মধ্য–নিম্ন–প্রান্তিক কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের ফসল জলের দরে বিক্রি করে দিতে৷ ফলে উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি ও ফসলের দাম না পাওয়া – এই দুইয়ের ফলে কৃষক হয়ে পড়ছে ঋণগ্রস্ত ৷ আর এই ঋণের চাপে তাঁরা আত্মহত্যার বেদনাদায়ক পথ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন৷ কংগ্রেস আমলেও দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন৷ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা নানা সরকারি তথ্য ঘেঁটে এক প্রতিবেদনে বলেছে– মোদি সরকারের আমলে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ৷ দেশের যত লোক আত্মহত্যা করেন তার ৭০ শতাংশই কৃষক৷ ‘আচ্ছে দিন’ কোনও সন্দেহ নেই!
মোদি সরকারের ফসল বিমা ঘোষণা কৃষক প্রতারণার আর এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷ এই বিমা সরকার কার্যকর করবে না, করবে কতকগুলি প্রাইভেট কোম্পানি৷ এই কোম্পানির মালিকদের মধ্যে মুকেশ আম্বানিও আছেন৷ এরা প্রিমিয়াম আদায় করবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করবে৷ এর ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে৷ দেখা গেছে যত টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে আদায় হয়েছে, তার ৩ শতাংশ মাত্র এরা ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিয়েছে৷ বাদবাকি ৯৭ শতাংশ গিয়েছে এই সব বিমা কোম্পানির ঘরে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের সর্বনাশ হওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা নিয়েও মুনাফা করার কী সুন্দর আয়োজন৷
এ বার একশো দিনের কাজের প্রকল্পের কথাই ধরুন৷ কর্মহীন গ্রামীণ জীবনে এই প্রকল্প সামান্য হলেও যতটুকু কাজের ব্যবস্থা করতে পারত নরেন্দ্র মোদিজি চার বছরেই তার মূলোচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন৷ এই প্রকল্প তিনি বাতিল করতে পারেননি৷ কিন্তু একে দুর্বল করে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই তাঁর সরকার বাকি রাখেনি৷ প্রকল্পের অর্ধেক টাকাই জমা আছে সরকারের ঘরে৷ কাজ করার পর সরকারি টাকা পেতে গ্রামীণ যুবকদের লেগে যাচ্ছে মাসের পর মাস৷ নানা প্রশাসনিক জটিলতায় ক্রমশই একে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ লক্ষ্য হল– সাধারণ মানুষ যাতে এই প্রকল্পের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে৷ এবং এইভাবে হয়তো একদিন বলা হবে– মানুষ চাইছে না, তাই একে তুলে দেওয়া হল৷ জনদরদই বটে!
এই মুহূর্তে বেসরকারি হিসাব মতে দেশে খরা কবলিত মানুষের সংখ্যা কম করে ৫৪ কোটি৷ বুন্দেলখণ্ডের ১৩ টা জেলার ১১,০৬৫ গ্রামে শুধু গত তিন মাসেই জলের অভাবে মারা গেছে ৩ লক্ষ গবাদি পশু৷ এদের বেশিরভাগটাই গোরু৷ ক্ষমতাসীন গোমাতার সন্তানরা পানীয় জল দিয়ে ‘মায়ের প্রাণরক্ষা’র কোনও চেষ্টাই করেনি৷ এদিকে কৃষিক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানোর জন্য এরা কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি?
এবার আসুন কালো টাকা উদ্ধারে মোদি সরকারের আয়োজনের কথায়৷ অবাক হয়ে দেশবাসী দেখল রাতারাতি পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করা হল৷ সগর্বে মোদিজি বললেন, সব কালো টাকা এবার ধরা পড়ে যাবে৷ কিন্তু কোথায় কী কালো টাকা ধরা গেল না৷ মাঝখান থেকে হল সাধারণ মানুষের মারাত্মক হয়রানি৷ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রাণ হারালেন একশো–র বেশি মানুষ৷ দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য লাটে ওঠার জোগাড়৷ নোট বাতিলের ধাক্কায় মানুষের রুটি–রুজি বন্ধ হয়েছে৷
গত বছর জুলাই মাসে মোদি সরকার দেশের পরোক্ষ কর ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে জি এস টি (পণ্য ও পরিষেবা কর) চালু করে৷ এর ফলে বেশ কিছু পণ্য ও পরিষেবার উপর কর বেড়ে যায়, বেড়ে যায় জিনিসপত্রের দাম৷ কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে৷ বস্ত্রশিল্পে এর প্রভাব পড়ে সাংঘাতিক৷
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকে মোদি সরকার পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের মতোই বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মুনাফা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে৷ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গরিব ঘরের সন্তানদের প্রবেশ নিষেধ৷ কঠিন রোগ হলে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের এখনও জলপড়া–তেলপড়াই ভরসা৷ শিক্ষাঙ্গনে যতটুকু গণতান্ত্রিক কাঠামো এতদিন মরতে মরতেও বেঁচে ছিল তাকেও প্রশাসনিক হুকুমে বলি দেওয়া হয়েছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধিকার এখন অতীতের বিষয়৷ পাঠ্যসূচির পরিবর্তন ঘটিয়ে মোদি সরকার বস্তাপচা পুরনো অনৈতিহাসিক অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ছাত্রদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চাইছে৷ ইতিহাসের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার জায়গায় বিকৃত সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা হাজির করছে৷ আর এই প্রক্রিয়ায় ওরা চাইছে ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে
তাই আমরা দেখছি, মোদিজির চার বছরের রাজত্বে জনজীবনে চূড়ান্ত সর্বনাশ নেমে এসেছে৷ অর্থনীতি–শিল্প–কৃষি–– সব ক্ষেত্রে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে৷ পাশাপাশি দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিদের লাভ হয়েছে অনেক৷ এদের আমদানি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, কোম্পানি কর ইত্যাদি কমানো হয়েছে৷ এদের ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া বিপুল ঋণ মকুব করা হয়েছে (গত বছর মকুব করা হয়েছিল ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা)৷ বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে দেশের নামজাদা সব শিল্পপতিরা (বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি প্রমুখ) হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে৷ এই প্রক্রিয়ায় এরা এক লক্ষ কোটি টাকার উপর দেশের অর্থ লুঠ করেছে৷ মোদিজির চার বছরের রাজত্বে বিশ্বে বিলিওনিয়ারের (শত কোটি বা তার বেশি অর্থের মালিক) সংখ্যায় ভারত তৃতীয়৷ এখানে সম্পদের কেন্দ্রীভবনও হয়েছে অভূতপূর্ব৷ দেশের কয়েকটা মাত্র পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে ৪৯ শতাংশ সম্পদ৷ সম্পদের সুউচ্চ চূড়ায় বসে এরা প্রতিদিন অত্যাচারের বুলডোজার চালাচ্ছে গরিব জনসাধারণের উপর৷ আর মোদিজি ও তাঁর সরকার এদেরই সেবাদাসত্ব করছে৷
নবজাগরণের আলোকদীপ্ত প্রয়াস ও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে এ দেশের বুকে সভ্যতা–মানবিকতা–যুক্তিবাদী চিন্তা ও মননের এক সুমহান সৌধ গড়ে উঠেছিল৷ এই সংগ্রামের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা পেয়েছিলাম রামমোহন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবারাও ফুলে, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের মতো মনীষী, পেয়েছিলাম তিলক, নেতাজি, লাজপৎ রাই, ভগৎ সি–এর মতো মহান বিপ্লবী নেতাদের৷ মাথা উঁচু করে মর্যাদা নিয়ে কী করে বাঁচতে হয় তা তাঁরা আমাদের শিখিয়েছিলেন৷ দীর্ঘ কংগ্রেসী রাজত্ব এই সুমহান ঐতিহ্যকে অনেকটাই ধ্বংস করে দিয়েছে৷ তবুও মরতে মরতে যতটুকু বেঁচে ছিল বিজেপির চার বছরের শাসন তার কফিনে শেষ পেরেকটা মারার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ ওদের চার বছরের শাসনে এটাই হল সবচেয়ে বড় ক্ষতি৷ এই ক্ষতি পূরণে দেশবাসীকে অনেক মূল্য দিতে হবে৷
(৭০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ৬ জুলাই, ২০১৮)