কোনও কিছুর অধিকার না থাকাটাই দস্তুর সাফাই কর্মীদের

ছবিটি এখনও হয়ত অনেকের চোখে ভাসছে– প্রধানমন্ত্রী উবু হয়ে বসে পা ধুইয়ে দিচ্ছেন এক সাফাই কর্মীর৷ সরকার অনুগত সংবাদমাধ্যম দৃশ্যটিকে ছড়িয়ে দেয় সারা দেশের মানুষের কাছে৷ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি যে একেবারে নিচুতলা পর্যন্ত রয়েছে তা প্রচার করতেই এমন একটি নাটকীয় দৃশ্য সেদিন রচনা করা হয়েছিল৷ না হলে এই ঘটনার পর অন্তত আদিম পদ্ধতিতে সাফাইয়ের কাজ থেকে সাফাইকর্মীদের বের করে আনার চেষ্টা হত৷ তা যে হয়নি তার অজস্র প্রমাণের মধ্যে সর্বশেষ চেন্নাইয়ের শপিং মলের ঘটনাটি৷

চেন্নাইয়ের একটি শপিং মলে ২৫ বছরের যুবক অরুণকুমার, তাঁর ভাই ও আরও চারজন সাফাই কর্মী মালিকের নির্দেশে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে একটানা বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ভাইকে বাঁচাতে ট্যাঙ্কের ভিতরে ঢোকেন তিনি৷ নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা ছিল না৷ ভাইকে কোনওরকমে বের করতে পারলেও নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন৷

শুধু একটা ঘটনা নয়৷ তামিলনাড়ুতে সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় সাফাই কর্মী মারা গিয়েছেন৷ ২০১৩–২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তামিলনাড়ুতেই শুধু মারা গিয়েছেন ১৪৪ জন৷ এর পরেই আছে উত্তরপ্রদেশ৷ সেখানে একই সময়ে মারা গিয়েছেন ৭১ জন৷ পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হিসেবে আমাদের আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই৷ যত্রতত্র দেখা যায় দু–তিন জন সাফাইকর্মী রাস্তার মাঝে কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই ম্যানহোলে নেমে বালতি বালতি দুর্গন্ধময় পাঁক তুলে পরিষ্কার করছেন, দিনের শেষে নামমাত্র মজুরির আশায়৷ মাঝে মধ্যে যখন ম্যানহোলের বিষাক্ত গ্যাস থেকে দু–একজন উঠে আসতে পারেন না, তখন তা মিডিয়ায় বড়জোর এক সেকেন্ডের কিংবা সংবাদপত্রের এক কোণে জায়গা পায়৷ মানুষের মনে তার রেশ থাকে দু–একদিন৷ তারপর আবার সবকিছু চলে আগের মতোই৷

রাজ্যে রাজ্যে অসংখ্য সাফাই কর্মী দৈনন্দিন শহরজীবনের মলমূত্র থেকে শুরু করে নানা নোংরা সাফাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷ সম্বল বলতে তাদের থাকে একগাছা দড়ি ও বালতি৷ থাকে না দুর্গন্ধযুক্ত গহ্বরে কাজ করার উপযুক্ত গ্যাস–মুখোশ৷ থাকে না হাতে দস্তানা, পায়ে গামবুট, শরীরে বিশেষ জ্যাকেট, মাথার হেলমেট৷ অক্সিজেনের অভাবে কাজ করতে করতে অন্ধকার গর্তে মৃত্যু হয় বহু সাফাই কর্মীর৷ সেই সংখ্যার হিসেবও থাকে না সরকারের কাছে৷ বহু জনের শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগ এবং চামড়ার রোগ দেখা দেয়, যা অনেক সময় জীবনঘাতী পর্যন্ত হয়৷ অথচ আধুনিক পদ্ধতিতে সাফাইয়ের নানা রকম যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যবহারও হচ্ছে৷ কিন্তু ভারতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কোনও ব্যবস্থাই করেনি সরকারি–বেসরকারি কর্তৃপক্ষ৷ এখনও চলছে প্রাচীন পদ্ধতিতে কাজ৷

আপৎকালীন পরিস্থিতি ছাড়া সাফাইকর্মীকে নিকাশি নালায় নামিয়ে পাঁক পরিষ্কার করতে বাধ্য করা অপরাধ– ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট এমন নির্দেশ দিয়েছিল৷ এমনকি সুরক্ষা–সরঞ্জাম নিশ্চিত না করে আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও কাজ করানো যাবে না সাফাই কর্মীদের, এমনটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল৷ ১৯৯৩ সালে ‘দ্য এমপ্লয়মেন্ট অফ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অফ ড্রাই ল্যাট্রিনস (প্রহিবিশন) অ্যাক্ট’ অনুযায়ী শুধু হাতে করে নোংরা পরিষ্কারই নিষিদ্ধ করা হয়নি, উপরন্তু মানুষের বর্জ্য পরিষ্কার করানোর জন্য লোক নিয়োগ করলে পাঁচ বছরের জন্য জেলের বিধান দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু তাতে কী? আমাদের দেশে আইন মেনে কাজ ক’টা জায়গায় হয়? ফলে এ ক্ষেত্রেও চলে চূড়ান্ত অবহেলা এবং বেআইনিভাবে কাজে নিয়োগ৷ সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনও ক্ষেত্রেই তাদের কাজের জন্য নেই কোনও নিরাপত্তা, নেই উপযুক্ত মজুরি৷ উপরন্তু দরিদ্র ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষেরা বেশিরভাগ এই কাজে যুক্ত থাকায় এ ক্ষেত্রে অবহেলা আরও বেশি৷

শহরের বড় বড় হোটেল, অন্যান্য ব্যবসায়িক কেন্দ্র বা বাড়িগুলিতে ঠিকমতো নর্দমা পরিষ্কার করা হয় না, ফলে সেগুলি কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়৷ জীবন অচল হয়ে পড়ে৷ পুর কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন দালাল মারফত নিযুক্ত এই শ্রমিকরা সেই সময় শহুরে মানুষের জীবনকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে প্রাণ হাতে করে নেমে পড়ে অন্ধকার কূপে৷ এদের অধিকাংশই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত৷ মানুষ হিসেবে তাদের যে অধিকার, সেই অধিকারবোধ সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই এদের৷ অনেকেই এই অসহনীয় পরিবেশে কাজ করতে করতে পাঁকের গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে মদের নেশায় ডুবে যায়৷ এদের জীবনটা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে অন্যরকম৷ বিষাক্ত পরিবেশে কাজ করায় অনেকে কিছুদিন পরই কর্মক্ষমতা হারায়৷ বেঁচে থেকেও উপযুক্ত মূল্য পায় না এঁরা, আর মারা গেলে তো এ সবের বালাই নেই৷ আবার মৃতদের অনেকের পরিবারই ক্ষতিপূরণের টাকা পর্যন্ত পায় না৷ এই না–মানুষদের জীবনে কোনও কিছুর অধিকার না থাকাটাই যেন দস্তুর৷ বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমস্ত শ্রমিকদের সম্পর্কে এমন দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করে মালিকরা আর তাদের তাঁবেদার সরকারগুলি৷ সাফাই কর্মীরা কোন ছার!

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৯ সংখ্যা)