আসন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এ রাজ্যে এবং সর্বভারতীয় স্তরেও সিপিএম–কংগ্রেস নির্বাচনী আঁতাত ভেস্তে গেলেও সিপিএম তার কংগ্রেস–প্রীতি অটুট রাখতে মরিয়া৷ এ রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ৪০টিতেই দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে৷ খোদ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী কেরালায় সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন৷ তিনি ওই রাজ্যে সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রচার না করার কথা বললেও তাঁর দলের কর্মীরা ভালই বুঝছেন এর কোনও অর্থ নেই৷ কারণ ওই রাজ্যে সিপিএমকে প্রতিপক্ষ করেই কংগ্রেসকে ভোটে লড়তে হবে৷ এর পরেও বহরমপুর এবং মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আসন না দেওয়ার কথা একতরফা ভাবে ঘোষণা করেছেন সিপিএম নেতারা৷ বহরমপুরে আরএসপি প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করায় অতি তৎপরতায় সিপিএম তা আটকানোর চেষ্টা করেছে৷ আরএসপি এ কথা শুনতে না চাওয়ায় তাদের সিপিএমের হুমকিও শুনতে হয়েছে৷ অপরদিকে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরীর হয়ে সিপিএম সরাসরি প্রচারে নেমেছে৷ বামমনস্ক মানুষদের প্রশ্ন, নিছক ভোটের কারণে এত কংগ্রেস প্রীতির আসল কারণটা কী? এর দ্বারা তো বামপন্থাকেই কলঙ্কিত করা হচ্ছে৷
সিপিএম বলে যাচ্ছে, বিজেপি এবং তৃণমূলকে হারানোই তাদের উদ্দেশ্য৷ কিন্তু এটাই যদি সত্যি হয়, তা হলে বাকি ৪০টি কেন্দ্রে তারা প্রার্থী দিল কেন? রায়গঞ্জ কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী না দিলে কংগ্রেসের পক্ষে তো তৃণমূল বিজেপিকে অধিকতর বেগ দেওয়া সম্ভব হত৷ সেক্ষেত্রে তৃণমূল–বিজেপিকে হারানোর ফরমুলা নিজেরাই কি ভাঙলেন না? আসলে মুখে তাঁরা যতই বলুন, তৃণমূল, বিজেপিকে হারানোই লক্ষ্য– মানুষ দেখছে আসলে লক্ষ্যটি হল যে ভাবেই হোক একটা–দুটো আসন জেতা৷
নির্বাচনে জেতা অবশ্যই সংগ্রামের একটি লক্ষ্য৷ কিন্তু যে কোনও ভাবেই হোক জেতা বামপন্থীদের লক্ষ্য হতে পারে কি? জেতার লক্ষ্যে মূল উদ্দেশ্যটাকেই শিকেয় তুলে রাখতে পারে নাকি কোনও বামপন্থী দল? কংগ্রেস ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণির সবচেয়ে পুরনো সেবাদাস এবং তাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত দল৷ কংগ্রেসের দীর্ঘ অপশাসনের কথা দেশের মানুষ জানে৷ তাদের শাসনের ফলে গরিবি বেড়েছে৷ অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হোতা কংগ্রেস৷ জরুরি অবস্থা জারি করে কংগ্রেস গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে৷ যে কোনও গণআন্দোলন দেখলেই কংগ্রেস সরকার তার উপর নির্মম অত্যাচার করেছে৷ গুলি চালিয়ে অসংখ্য শ্রমিক–কৃষক–ছাত্র হত্যা করেছে৷ এ হেন কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আখ্যা বামপন্থীরা কখনওই দিতে পারে না৷ সিপিএম এর দ্বারা শ্রমিক–চাষিদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াল৷ যে কংগ্রেসের জনবিরোধী নীতির ফলে জনজীবন জেরবার, সেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিবর্তে তার সঙ্গে মৈত্রী ফরমূলা এনে শোষিত মানুষের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই গুলিয়ে ফেলা হল৷ এর দ্বারা বামপন্থায় বিশ্বাসী শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের প্রশ্নেও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সামনে ঠেলে দেওয়া হল৷ বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা মানুষকে বোঝান যে, একটি বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দলের উপর মানুষ খেপে গেলে ভোটে তাকে বদলে দিয়ে আর একটি দলকে ক্ষমতায় বসালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ সিপিএমের তৃণমূল–বিজেপিকে হারাতে কংগ্রেস প্রীতি ঠিক একই কায়দায় মানুষকে আন্দোলনের বদলে নিকৃষ্ট বুর্জোয়া ভোট সর্বস্ব রাজনীতির দিকে আরও ঠেলে দিল৷
যে কোনও ভাবেই হোক না কেন, আমরা ভোটে জিতলেই সব ঠিক হয়ে যাবে– মানুষকে এ কথা বোঝানো কোনও নীতি নয়, সুবিধাবাদ৷ এই সুবিধাবাদই কেরালায় আরএসপিকে সিপিএম জোট থেকে সরিয়ে কংগ্রেসের জোটে সামিল করেছে৷ দল অনুসৃত এই সুবিধাবাদই দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে৷ তারাও অঙ্ক কষছে কোন দলে গেলে এবং ভোটে দাঁড়ালে জয়ের সম্ভাবনা বেশি, সুযোগ বুঝে তারা দলত্যাগ করছে৷ সিপিএম, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের যে সব বিধায়ক–সাংসদ সম্প্রতি এবং বিগত বছরগুলিতে তৃণমূল এবং বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন এবং ভোটে দাঁড়িয়েছেন, নিচের তলার নেতা–কর্মী–সমর্থক যে দলে দলে তৃণমূলে গিয়ে ভিড়ছে, বিজেপিতে ভিড়ছে, তার পিছনে রয়েছে নেতৃত্বের এই নিকৃষ্ট সুবিধাবাদী রাজনীতির চর্চা৷
তৃণমূল–বিজেপি বিরোধিতাকে সিপিএম যেভাবে পাখির চোখ হিসাবে দেখছে সেটাও কি আন্তরিক, নাকি একটা ‘রাজনৈতিক লব্জ’? এখন মানুষ তুলনা করে দুর্নীতি, দলবাজি, স্বজন–পোষণ, তোলাবাজি, রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর সন্ত্রাস, জনবিরোধী নীতি নিয়ে সরকার চালানো, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, মদের প্রসার বাড়ানো, এই সব কাজে কে বেশি এগিয়ে, সিপিএম নাকি তৃণমূল? যেসব অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে উঠছে, সবই চরম আকার নিয়েছিল সিপিএমের শাসনে৷ জনবিরোধী নীতি যা তৃণমূল শাসনে চলছে, তার বেশির ভাগই সিপিএমের আমলেই গৃহীত৷ ফলে সিপিএম যখন তৃণমূল অপসারণের দাবি তোলে তা মানুষের মধ্যে দাগ কাটে না৷ তাদের তৃণমূল বিরোধিতার মধ্যেও নীতিগত কোনও বিষয় নেই, রয়েছে স্রেফ গদি হারানোর জ্বালা৷
তাদের বিজেপি বিরোধিতাতেও কোনও আন্তরিকতা নেই৷ ভোটের যে লক্ষ্য এখন তাদের কংগ্রেসমুখী করে তুলেছে, সেই লক্ষ্যই একসময় তাদের বিজেপি ঘনিষ্ঠও করেছিল৷ আশির দশকে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যে বিজেপি কাউন্সিলারের সমর্থন নেওয়া, শহিদ মিনার ময়দানে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আমন্ত্রণ করে এনে জনসভা করা, জ্যোতি বসুর সঙ্গে বাজপেয়ীজির হাত ধরা ঐক্যের ছবি এ রাজ্যের মানুষ দেখেছে৷ সেই কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই, তাঁদের দলের কর্মী–সমর্থকরা পর্যন্ত তাদের বিজেপি বিরোধিতার মধ্যে নীতিগত অবস্থান দেখতে পান না৷ তাঁরা বুঝে গিয়েছেন ‘নীতি–ফিতি পরে, ভোটই আসল’– বামপন্থা মানে যে শুধু কিছু স্লোগান আর ভোটের একটা কৌশল মাত্র নয়, সিপিএম নেতৃত্ব কর্মী–সমর্থকদের সেটাও ভুলিয়ে দিচ্ছেন৷
বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক মানুষদের মনে রাখা দরকার, বিজেপিকে শুধু ভোটে পরাজিত করলেই সাম্প্রদায়িকতার পরাজয় ঘটে যায় না৷ ইতিপূর্বে কেন্দ্রে বিজেপি একবার পরাস্ত হয়েছে৷ কিছু কিছু রাজ্যেও বিজেপি পরাজিত হয়েছে৷ কিন্তু তারা দ্বারা সাম্প্রদায়িকতা পরাস্ত হয়নি৷ বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে জনগণের ঐক্য ধ্বংস করার শক্তিশালী হাতিয়ার৷ পুঁজিপতিরা গণআন্দোলন ধ্বংস করতে এই সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন দিয়ে থাকে৷ ক্ষমতাসীন সরকার কখনও কখনও সাম্প্রদাকিতায় উস্কানি দেয় অপশাসন বা ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে৷ আর ভোট–সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলি সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন দেয় সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটিয়ে ভোটে জেতার জন্য৷
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হলে, এই সার্বিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে৷ একই সাথে জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ কোনওটিতেই সিপিএমের কোনও আগ্রহ নেই৷ যখন প্রয়োজন বামপন্থী আন্দোলনের বিকল্প ধারার জন্ম দেওয়া, তখন সিপিএম দু–চারটে আসন জেতার জন্য ভিড়ে যাচ্ছে কংগ্রেস শিবিরে৷
কংগ্রেস কি বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধির কোনও সুযোগ দিতে পারে? কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার জন্য সিপিএমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, এরিয়া কমিটির সম্মেলন থেকে পার্টি কংগ্রেস– এসব থেকে কংগ্রেস বুঝেছে সিপিএমকে যে শর্ত দেওয়া যাবে, ভোটের লোভে তা মানতে তারা বাধ্য হবে৷ সিপিএম কংগ্রেসের সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার দায় কার কতটা? এ চর্চার সঙ্গে কোনও জনস্বার্থ জড়িত নেই৷ জনস্বার্থ জড়িত ছিল না এই সমঝোতা প্রয়াসের মধ্যেও৷
এই অবস্থায় সংগ্রামী বামপন্থার জাগরণ ঘটানোই বামপন্থীদের সামনে জরুরি কর্তব্য৷ সিপিএমের সৎ কর্মী–সমর্থকদের বিষয়টি ভেবে দেখতে অনুরোধ করি৷