ইংরেজি নববর্ষের আগমন ঘটল কোভিড সংক্রমণের ব্যাপক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে গত ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে দৈনিক সংক্রমণ ছিল ২ হাজারের ঘরে, জানুয়ারির ২ তারিখের মধ্যে তা দৈনিক ৬ হাজার ছাড়িয়েছে। সারা ভারতে গত এক সপ্তাহে ১ লক্ষ ৩০ হাজার নতুন সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। যত সময় যাচ্ছে বৃদ্ধির হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
এমনটা যে ঘটতে চলেছে তা কি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অজানা ছিল? একেবারেই তা নয়। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছুদিন ধরেই এই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিলেন। তবু সরকারের হুঁশ ফেরেনি। কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসকদল এবং অন্য বড় দলগুলিও যথেচ্ছভাবে কোভিড বিধি ভাঙার পর আশঙ্কা বাড়ছিলই। এরপর পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী নিজে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট সহ অন্যত্র বড়দিন এবং বর্ষবরণের নামে হুল্লোড়ে প্রবল উৎসাহ দিয়েছেন। ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সমস্ত বিধিনিষেধও শিথিল করে দেওয়ায় ভিড় উপচে পড়েছে রাস্তাঘাট ও নানা বিনোদন কেন্দ্রে। প্রায় কারও মুখে মাস্ক নেই, দূরত্ব মানার প্রচেষ্টা নেই, মানানোর জন্য প্রশাসনিক সদিচ্ছার তো আরও অভাব। এই বাঁধনহারা অব্যবস্থাই কোভিড বিপদ বাড়িয়ে তুলল।
মুখ্যমন্ত্রী নিয়ন্ত্রণের বদলে উৎসাহ দিতে বলে দিলেন, মানুষ যাতে আনন্দ পায় তার উপর তিনি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবেন না। এ জন্যই হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে গঙ্গাসাগর মেলাও বন্ধ করতে তিনি নারাজ। কারণ এসব করতে গেলে ভোটব্যাঙ্কে তার প্রভাব পড়তে পারে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন এবং তারপর পুজোকে ঘিরে হুল্লোড়ের জেরে কীভাবে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউকে ডেকে আনা হয়েছিল, কত মানুষের জীবন গেছে, শারীরিক, আর্থিক দিক থেকে কত মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে গেছেন তা কি সরকার ভুলে গিয়েছিল! একদল মানুষ লাগামছাড়া হুল্লোড়কে আনন্দ মনে করলেই সরকারকে তাতে মদত দিতে হবে? এটাই কি সরকারের দায়িত্ব? জনজীবনের নিরাপত্তাবিধানের চেয়ে উৎসবের জাঁকজমককে কোনও দায়িত্বশীল সরকার বড় করে দেখাতে পারে? অথচ সেটাই ঘটল। সরকারের এই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে আজ সাধারণ মানুষকেই।
কোভিড সংক্রমণ মাত্রাছাড়া হওয়ার পর নতুন করে রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ বিধি আরোপের ঘোষণা করেছে সরকার। স্কুল-কলেজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে বন্ধ হয়েছে। লোকাল ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ, সরকারি-বেসরকারি অফিসে কর্মীসংখ্যা কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপের ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, পরিচারিকা ইত্যাদি স্তরের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নতুন করে সমস্যা দেখা দেবে। শিক্ষাক্ষেত্র ইতিমধ্যেই অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে তা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরাও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে পড়েছে। অথচ সরকার সময় মতো তার সঠিক ভূমিকা পালন করলে মানুষকে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না।
এই প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তারা বিশেষত প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ নানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ভূমিকাও কিছু আলাদা নয়। তাঁরা এখন উত্তরপ্রদেশের ভোটে মেতেছেন। কোভিড বিধি নস্যাৎ করে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে জনসভা করে চলেছেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে তাঁরাই ভোটের স্বার্থে কুম্ভমেলার সমারোহ করে সংক্রমণ ছড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সুযোগে উত্তরপ্রদেশ সহ মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাটেও লাফিয়ে লাফিয়ে কোভিড বাড়তে শুরু করেছে। তথাকথিত জনমোহিনী পদক্ষেপ নিয়ে ভোটব্যাঙ্ককে তুষ্ট করতে গিয়ে এভাবে মানুষকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও শাসকই কিছু কম যায় না। বিজেপি, তৃণমূল, কংগ্রেস যে যেখানে ক্ষমতায়, সেখানে যেমন এ কাজ করছে, বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএমও সে পথেই হেঁটেছে। মানুষের মনে আছে, গত আগস্ট মাসে ঠিক একই কায়দায় কেরালায় ওনাম উৎসব নিয়ে মাতামাতিতে কোনও নিয়ন্ত্রণ না করে সে রাজ্যের সিপিএম সরকার কোভিড বৃদ্ধির বিপদ ডেকে এনেছিল।
টিকাকরণের প্রশ্নে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে ২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শতকোটি টিকাকরণের ড্রাম বাজিয়েছেন। প্রচারের ডামাডোলে যে সত্যটি চাপা পড়ল, তা হল প্রাপ্তবয়স্কদের সাড়ে ৭৫ কোটি মানুষ পেয়েছেন মাত্র একটি ডোজ, ১১ কোটি জন একটি ডোজও পাননি। ১৫ থেকে ১৮ বছরের জন্য এবং ষাটোর্ধ্বদের বুস্টার ডোজের সরবরাহ কী ভাবে হবে তার কোনও রূপরেখা কেন্দ্রীয় সরকার করেনি। জনসাধারণের প্রতি সরকারগুলির ন্যূনতম দায়বদ্ধতা থাকলে এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারত?