এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে ব্যাগ থেকে ২০০০ টাকার নোট বের করে স্বেচ্ছাসেবকদের দিকে এগিয়ে দিতে দেখে পাশের এক দোকানদার বললেন, আরে কী করছিস? উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘যা করছি ঠিক করছি৷ যেখানে দিচ্ছি, ঠিক জায়গাতেই দিচ্ছি৷’’ ঘটনা উত্তর কলকাতার হরিসা হাটে৷ সেখানে কেরালার বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করছিলেন এসইউসিআই(সি) কর্মীরা৷ দেশ জুড়ে দলের কর্মীরা, ছাত্র–যুব–মহিলা সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা ত্রাণ সংগ্রহে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন৷ সংগৃহীত ত্রাণসামগ্রী কেরালায় পাঠানো হচ্ছে, তা দুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করছেন দলের স্থানীয় নেতা–কর্মীরা৷ দলের মেডিকেল টিম নানা জায়গায় ক্যাম্প করে চিকিৎসা করছে, ওষুধ বিতরণ করছে৷
কলকাতার বেলগাছিয়া মসজিদের কাছে ত্রাণ সংগ্রহ করছিলেন পার্টি কর্মীরা৷ পাশে এসে দাঁড়ালেন দু’জন ভিখারি৷ একজন অপরজনকে বললেন, ‘‘রোজ আমরা চাই, আজ আমাদের দিতে হবে৷ মানুষগুলো বড় বেকায়দায় পড়েছে গো৷’’ আরেক জায়গায় এক কর্মীর কাছে এসে এক ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ‘‘ঠিক জায়গায় যাবে তো?’’ তারপর কর্মীটির বুকে পার্টির ব্যাজ লক্ষ করে জিভ কাটলেন, ‘‘ওহো এসইউসিআই সরি ভাই, সরি৷’’ তিন হাজার টাকা তিনি কালেকশন বক্সে ঢুকিয়ে দিলেন৷ সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের মোড়ে দু’জন কুড়ি–বাইশ বছরের ছেলে বাইক ছুটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন৷ দলের কর্মীরা হাত দেখালেও বাইক থামল না৷ পাঁচ মিনিট পর হেঁটে তাঁরা ফিরে এলেন৷ দু’জনের হাতে একশো একশো দুশো টাকা৷ বক্সে দিয়ে বললেন, ‘‘তব হেলমেট নেহি থা, ইসলিয়ে নেহি রুকে৷ কুছ মাইন্ড মৎ কিজিয়েগা৷’’
কেরালায় বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে এস ইউ সি আই (সি)–র উদ্যোগে বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার কর্মী কয়েকদিন ধরে অর্থ, ওষুধ, জামাকাপড় প্রভৃতি সংগ্রহ করেছেন৷ ইতিমধ্যেই তা পৌঁছে গেছে কেরালার বন্যার্ত এলাকাগুলিতে৷ ত্রাণের কাজ চলছে রাজ্যের ওয়েনাড়, পালাক্কাড়, ত্রিশূর, এর্নাকুলাম, কোট্টায়াম, আলেপ্পি, পথানামথিট্টা জেলার বিভিন্ন এলাকায়৷ দলের পরিচালনায় ৩০টি ত্রাণশিবির চলছে৷ দলের স্বেচ্ছাসেবকরা প্লাবিত এলাকাগুলি থেকে মানুষজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া, নিখোঁজদের খুঁজে বের করা, মেডিকেল ক্যাম্প চালানো, ভ্রাম্যমান মেডিকেল ইউনিট চালানো, বাড়িগুলিতে জমে থাকা কাদা সরানো প্রভৃতি নানা কাজে নেমেছেন৷ মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার, ডিএসও, ডিওয়াইও, এমএসএস, এআইইউটিইউসি–র স্বেচ্ছাসেবকরা এই কাজে সব রকমের সক্রিয় সহিযোগিতা করছেন৷ |
কোটি কোটি মানুষের শ্রমের ফসল বিনা বাধায় আত্মসাৎ করার জন্য হাজার ষড়যন্ত্র করেও, শিক্ষা–সংস্কৃতি–মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করার হাজার অপচেষ্টা করেও সমাজ–সভ্যতাকে শাসক শ্রেণি যে এখনও একেবারে পচিয়ে দিতে পারেনি, তারই প্রমাণ কেরালার বন্যাদুর্গতদের জন্য মানুষের উজাড় করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা৷ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার সাহায্য দেওয়াতে চূড়ান্ত ঔদাসীন্য দেখাচ্ছে, দেশের সম্পদ লুটে ধনকুবের হওয়া শিল্পপতি–ব্যবসায়ীরা যেখানে ভাব দেখাচ্ছে যেন এসব কিছু খবর তারা জানেই না, সেখানে সাধারণ মানুষ সাধ্যের বাইরে গিয়েও সাহায্য দিচ্ছেন বন্যাত্রাণ তহবিলে৷
চেন্নাইয়ের একটা ছোট্ট মেয়ে৷ সাইকেল কিনবে বলে টাকা জমিয়েছিল৷ বন্যার কথা শুনে সব টাকা সে দিয়ে দিয়েছে ত্রাণে৷ খবরটা পেয়ে এক সাইকেল দোকানদার বলেছেন, আমি মেয়েটিকে একটি সাইকেল উপহার দেব৷ কোচির দম্পতি সিদ্দিক আর ফতেমা ত্রাণ কর্মীদের গাড়িতে জামাকাপড়–খাবারদাবার দিচ্ছেন দেখে পড়া ফেলে ছুটে এল তাঁদের যমজ সন্তান হারুন আর দিয়া৷ হাতে ওদের নিজস্ব জমানোর ঘট ভাঙা পুরোটাই, ২২১০ টাকা দিয়ে দিল৷ কান্নুরের স্কুলপড়ুয়া স্বাহা আর ব্রহ্মাকে তাদের দাদু এক একর জমি কিনে উপহার দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে৷ এখন সেই জমিটির দাম কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা৷ তারা সেই জমি বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য দান করে দিয়েছে৷ ত্রিশূর জেলার ২১ বছরের কলেজ ছাত্রী হানান হামিদ৷ পরিবার ও পড়াশোনার খরচ চালাতে অভাবী হানানকে বাজারে মাছ বিক্রি করতে হয়৷ সে জন্য কেউ কেউ বিদ্রূপও করে৷ সেই হানান দুর্গত মানুষদের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছেন৷ প্রশ্ন করলে শুধু বলেছেন, ‘‘আমার পড়াশোনার জন্য অনেকেই আমাকে আর্থিক সাহায্য করেন৷ সেগুলো যতটা পারি জমিয়ে রাখি বিপদ–আপদের জন্য৷’’ নিজের বিয়েতে গয়নার খরচ বাবদ জমানো এক লক্ষ টাকা দান করে দিলেন কোঝিকোড়ের অমৃতা এস বেনু৷ বললেন, ‘‘বিয়ের দিন গয়না পরে সাজার চেয়ে, অসহায় মানুষদের সাহায্যে তা দান করতে পেরে ভাল লাগছে৷’’
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, আলাপুঝার মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান মধ্য চল্লিশের জয় সেবাস্টিয়ানের কথা৷ পেশায় তিনি তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী৷ স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবি– ডিঙি নৌকায় কেরলের ম্যাপ, সঙ্গে গোটা গোটা হরফে লেখা ‘হলিউডের স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, আয়রনম্যান সব আছে৷ আমাদের সবেধন নীলমণি এই ফিশারম্যানই৷’ পোস্টটা দেখে জয় বললেন, ‘‘…খাটো লুঙ্গি আর মাথায় গামছা জড়িয়ে এই ক’টা দিন ওঁরাই তো বাঁচালেন গোটা রাজ্যটাকে৷ পেটে কিল মেরে বুক চিতিয়ে লড়লেন, অথচ কী অবলীলায় দৈনিক ৩০০ টাকার পুরস্কার–ভাতা জমা দিচ্ছেন ত্রাণ তহবিলে৷ নিজেকে মৎস্যজীবীর ছেলে বলতে গর্ব হচ্ছে৷’’ অফিসে না গিয়ে ১৫ আগস্ট থেকে জেলা বিপর্যয় মোকাবিলা কেন্দ্রের সদর দফতরে থেকে ত্রাণের কাজ দেখভাল করছিলেন তিনি৷ বললেন, ‘‘গোড়ায় বিপদটা আন্দাজ করতে পারিনি৷ কিন্তু ১৭ তারিখ রাত থেকে একের পর এক ফোন আসতে শুরু করল৷ বুঝলাম, বন্যায় আটকে পড়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ বাড়ছে উদ্বেগ৷’’ নৌসেনার কপ্টার নামিয়ে উদ্ধারকাজ চালানোর ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘১৬–১৯ আগস্টের মাঝরাত পর্যন্ত রাজ্যের যে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষকে উদ্ধার কিংবা নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে, তার ৬০ শতাংশ তো করলেন আমাদের উর্দিহীন মৎস্যজীবীরাই৷ এয়ারলিফট করে উদ্ধার করা হয়েছে গোটা রাজ্যে বড়জোর ৩০০ জনকে৷’’ রাজ্য সেচ দফতরের এক কর্তা জানান, ‘‘আলাপুঝা, এর্নাকুলাম, কোল্লম, তিরুবনন্তপুরম মিলিয়ে গত ক’দিন হাজার তিনেক মৎস্যজীবী তাঁদের ৭০০ দেশি নৌকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন৷’’ অথচ এই সময়টা মাছ ধরার ভরা মরসুম৷ সমুদ্রে গেলেই এক–এক বারে হাজার পাঁচেক টাকা রোজগার৷ ‘‘ওঁরা কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা করেননি…৷’’ আলাপুঝায় ১৮ আগস্ট রাতের কথা ভুলতে পারছেন না জয়৷ বললেন, ‘‘বাবার বয়সি এক মৎস্যজীবী সেদিন সটান চলে এসেছিলেন কন্ট্রোল রুমে৷ বলছিলেন, ‘বাবু, রাত হয়ে গিয়েছে বলে ওরা যেতে দিচ্ছে না৷ কিন্তু খবর পেলাম, এখান থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে ১৫ জন আটকা পড়ে আছে৷ কিছু একটা করুন৷ রাতে সত্যিই আমাদের চোখ জ্বলে, সব দেখতে পাই৷ দেখবেন ঠিক পারব৷’ এঁদের কথা ভুলব কী করে?’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ আগস্ট, ’১৮)৷
এরকম অসংখ্য ঘটনার খবর প্রতিনিয়ত আসছে৷ বাঁচার আকাঙক্ষা কত মানুষকে শুধু মানুষ পরিচয়েই একত্রিত করে দিয়েছে৷ কাছাকাছি মন্দির–মসজিদ–গীর্জা৷ সেগুলোর কোথাও রান্না, কোথাও চিকিৎসা, কোথাও থাকা–খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে, সকলেরই জন্য৷ স্বেচ্ছাসেবকদের দল ত্রাণকার্যে ও বিধ্বস্ত অঞ্চল পুনর্গঠনে হাত লাগিয়েছে৷ তাতে রয়েছে আজিজ, আসাদুল্লারা৷ যেতে যেতে পথের ধারে মন্দির চত্বরের কাদা ধুয়ে জঞ্জাল সরিয়ে পূজার্চনার উপযুক্ত করে দিয়ে যাচ্ছে৷
এইসব মানুষগুলোকে কারা শেখাতে চায় ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’? বিনোদনের নামে কারা এদের নোংরামো, অশ্লীলতা আর মাদকের ফাঁদে জড়ায়? ধর্মের নাম করে কারা এদের নরহত্যায় সামিল করে? তারাই এসব করে যারা এদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে না, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দিতে পারে না, চাকরি দিতে পারে না৷ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের দাবিতে এরা যাতে বিদ্রোহী না হয়ে ওঠে, সে জন্য লুঠেরা মালিকের দল এদের মধ্যেকার মনুষ্যত্ব–মূল্যবোধ কেড়ে নিতে চায়৷ তাদের তাঁবেদার ভোটবাজ দলগুলোও তাই সরকারে বসে একের পর এক জনবিরোধী নীতি নেয়৷ মানুষকে এমন সংকটের মধ্যে ফেলে, যেখানে অনেকে চেষ্টা করেও নীতিনৈতিকতা এবং আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়৷ কিন্তু কেরলের বন্যাপরবর্তী অমূল্য অভিজ্ঞতা এ কথাই আরও বলিষ্ঠ ভাবে প্রমাণ করল যে, সবটাই শেষ হয়ে যায়নি৷
(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)