কেরালায় শুরু হয়েছে এক অসম যুদ্ধ৷ এই যুদ্ধের একদিকে রয়েছে দেশের সবচেয়ে ধনী পুঁজিপতি আদানি, যার পিছনে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি ও রাজ্যের সিপিএম সরকার৷ উল্টোদিকে বাসভূমি ও জীবন–জীবিকা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হাজার হাজার মৎস্যজীবী সাধারণ মানুষ, পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা৷
কেরালার ভিজিঞ্জামে আদানি গোষ্ঠী গড়তে চলেছে বিশালাকার ‘ট্রান্সশিপমেন্ট কন্টেনার টার্মিনাল’৷ ২০১৫ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ইউডিএফ সরকারের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে সমুদ্র–উপকূলবর্তী ভিজিঞ্জামে শুরু হয়ে গেছে এই বিশেষ বন্দর গড়ার কাজ, যেখানে যাত্রাপথের মাঝেই এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে মালপত্র স্থানান্তরিত করা হবে৷ পিপিপি মডেলে তৈরি হতে চলা ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি লাগবে, যার পরিমাণ ৪৫০ হেক্টর (১ হেক্টর মানে ১০ হাজার বর্গমিটার)৷ এছাড়াও আদানির দখলে চলে যাবে তীরভূমি থেকে সমুদ্রের গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত ১২০ হেক্টর জলভাগ এবং তার নিচে থাকা সমুদ্রতল৷ ইতিমধ্যেই এই বিপুল পরিমাণ জমি আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে সিপিএম সরকার৷
কেরালার দক্ষিণপ্রান্তে ভিজিঞ্জাম এলাকাটি বহু বছর ধরে মৎস্যজীবীদের বাসস্থান৷ এখানকার গ্রামগুলিতে বাস করেন হাজার হাজার খেটে–খাওয়া মানুষ, মাছ ধরা যাদের একমাত্র পেশা৷ সংলগ্ণ সমুদ্রের জলভাগটিও নানা ধরনের মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর সম্ভারে সমৃদ্ধ৷ ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে দীর্ঘ প্রবাল প্রাচীরটিও রয়েছে এই অঞ্চলেই৷ ভিজিঞ্জামের তীরভূমিটি সংরক্ষিত অঞ্চল হিসাবে আগে থেকেই ঘোষিত৷ এখানে বন্দর তৈরি হলে এলাকার মৎস্যজীবী মানুষের জীবন–জীবিকার পাশাপাশি সম্পূর্ণ জীববৈচিত্র্যটিই বিপন্ন হবে৷ এই আশঙ্কা থেকেই পথে নেমেছেন এলাকার ৪০টি গ্রামের হাজার হাজার মৎস্যজীবী, রুখে দাঁড়িয়েছেন বহু পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ৷ একটানা গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা৷ অথচ আদানির মুনাফার স্বার্থে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিপন্ন করে ভিজিঞ্জামেই বন্দর গড়তে বদ্ধপরিকর কেরালার সিপিএম–ফ্রন্ট সরকার৷
কী বলছেন আন্দোলনকারীরা? ‘ইন্টারন্যাশনাল ওসান ইন্সটিটিউট’–এর প্রাক্তন বিজ্ঞানী বিজয়ন জোসেফ বলেছেন, এই অঞ্চলে উপকূলভাগের ভূমিক্ষয় গত ’৭০–এর দশক থেকে শুরু হয়েছে৷ কিন্তু ২০১৫ সালে ভিজিঞ্জামে বন্দরের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে সমুদ্র যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে এসে ভূভাগ গ্রাস করছে৷ ইতিমধ্যে প্রায় ৪০টি গ্রাম সমুদ্রের গ্রাসে চলে যেতে শুরু করেছে৷ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে বিখ্যাত শাংগুমুখম বিচ৷ কোভালাম, ভালিয়াথুরা ইত্যাদি বিচগুলির অস্তিত্বও সংকটের মুখে৷ আদানি গোষ্ঠী বন্দরের প্রয়োজনে যে ব্রেকওয়াটার বা সমুদ্রপ্রাচীর তৈরি করা শুরু করেছে, তার ফলে সমুদ্রস্রোতের দিক পরিবর্তন ঘটছে৷ উত্তাল হয়ে উঠছে সমুদ্র৷ ফলে প্রকল্প এলাকা জুড়ে উপকূলভাগ ধসে পড়ছে৷ এলাকার বাসিন্দা ৬০০–র বেশি মৎস্যজীবী গরিব মানুষ ইতিমধ্যে নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন৷ ত্রাণশিবিরে, গুদামঘরে আশ্রয় জুটেছে তাঁদের৷
শুধু এটুকুই নয়৷ ভিজিঞ্জামে বন্দর তৈরি হলে মৎস্যজীবীপ্রধান এই অঞ্চলের মানুষের রুজির উপর কোপ পড়বে৷ গরিব মৎস্যজীবীরা স্বাধীন ভাবে মাছ ধরতে পারবে না৷ মাছ ধরার ছোট নৌকো শুধুমাত্র আদানি কোম্পানির নির্দিষ্ট করে দেওয়া এলাকাতেই নোঙর করা যাবে চড়া মূল্যের বিনিময়ে৷ ধ্বংস হবে প্রায় ৬০ হাজার দরিদ্র মৎস্যজীবীর জীবন–জীবিকা৷ সমুদ্রপ্রাচীরের কারণে উত্তাল হয়ে ওঠা সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ইতিমধ্যেই আগের চেয়ে অনেক বেশি করে দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হচ্ছে মৎস্যজীবীদের৷ গত এক বছরে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে বেশ কয়েকজন মৎস্যজীবীর৷
‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্স স্টাডিজ’–এর গবেষক ডঃ কে ভি থমাস মন্তব্য করেছেন, ‘‘এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাসিন্দাদের জীবন–জীবিকার ওপর এই বন্দরের কী প্রভাব পড়বে, তা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে খতিয়ে দেখেনি সরকার৷ ভিজিঞ্জামের ভূমিক্ষয়প্রবণ উপকূলে বন্দর নির্মাণের এই সিদ্ধান্ত সরকারের অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়’’৷ আগামী দিনে বন্দরের কাজের জন্য সমুদ্রপ্রাচীরগুলির নির্মাণ শেষ হলে গোটা এলাকার উপকূলভাগ আরও ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা৷
এই পরিস্থিতিতে বন্দর নির্মাণ বন্ধ করা, উচ্ছেদ হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যজীবীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দেওয়া, উপকূল অঞ্চলে ভূমিক্ষয় বন্ধের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্ঘটনায় মৃত মৎস্যজীবীদের পরিবারগুলিকে সাহায্যদান সহ সাত দফা দাবিতে রাজ্যের সিপিএম সরকারের কর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসেছেন আন্দোলনকারীরা৷ কিন্তু সিপিএম সরকার দরিদ্র মৎস্যজীবীদের দাবি মানতে রাজি নয়৷ ফলে মাসের পর মাস ধরে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা এবং এলাকার সাধারণ মানুষ৷ তিরুবনন্তপুরমের সাথে ভিজিঞ্জামের সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও বিমানবন্দরে যাওয়ার রাস্তা অবরোধ করছেন বিক্ষোভকারীরা, সচিবালয় ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন৷ আগস্ট মাস থেকে চলা এই আন্দোলনের ১০০তম দিনে সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার নৌকোয় আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ জানান মৎস্যজীবীরা৷ নৌকো দিয়ে সমুদ্রপথ অবরুদ্ধ করেও প্রতিবাদ জানান তারা৷ বন্দর এলাকার নির্মীয়মাণ গেট ভেঙে, প্রতিবাদকারীদের আটকানোর জন্য তৈরি পুলিশি ব্যারিকেড সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উত্তাল বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন স্থানীয় মানুষ৷ কোভালামের মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ আমাদের বাঁচার লড়াই৷ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটব না৷ কি ইউডিএফ, কি এলডিএফ সরকার বারেবারে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করেছে আমাদের৷ এর শেষ দেখে ছাড়ব৷
ভিজিঞ্জামে বিশালাকৃতি বন্দর তৈরি করে আদানি গোষ্ঠীর বিপুল মুনাফা লুটের স্বার্থে রাজ্যের খেটে–খাওয়া সাধারণ মানুষ সহ পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের প্রতিবাদকে আমল দিতে রাজি নয় কেরালার সিপিএম সরকার৷ এমনকি এই আন্দোলন দমনে দক্ষিণপন্থী বিজেপির সঙ্গে নির্লজ্জ ভাবে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেনি ‘বাম’ নামধারী সিপিএম৷ ১ নভেম্বর নানা হিন্দু সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত এক মিছিলে মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে স্লোগানে গলা মেলালেন সিপিএম–এর তিরুনন্তপুরম জেলা সম্পাদক ও বিজেপির জেলা সভাপতি৷ আন্দোলনের পিছনে বিদেশি অর্থের প্ররোচনা থাকার গুজব ছড়াচ্ছেন এই ভণ্ড বামপন্থীরা৷ এমনকি ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টিরও চেষ্টা করছেন সিপিএমের শিক্ষামন্ত্রী৷
অথচ পূর্বতন ইউডিএফ সরকারের আমলে যখন আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিজিঞ্জামে বন্দর গড়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তখন এই সিপিএম–ই তার বিরোধিতা করেছিল৷ এই বিশাল প্রকল্পটি বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে দুর্নীতির ভিত্তিতে এই চুক্তি হয়েছে বলে শোরগোল তুলেছিল, শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছিল৷ বাস্তবিকই পিপিপি মডেলের এই বন্দর প্রকল্পে ব্যয়ের সিংহভাগই চাপানো হয়েছে জনসাধারণের কাঁধে৷ প্রকল্পটিতে আদানির বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা৷ বাকি ৫ হাজার ৭১ কোটি টাকা জনসাধারণের পকেট থেকে নিয়ে প্রকল্পে ঢালবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার৷ শুধু তাই নয়, ২০১৭–র সিএজি রিপোর্টও মন্তব্য করেছিল, আদানিকে নানা বিষয়ে ৪০ বছর ধরে ছাড় দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তাতে রাজ্যের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা৷ সিএজি আরও জানিয়েছিল, বন্দর নির্মাণের জন্য যে টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল, তাতেও বহু ফাঁকফোকর আছে এবং গোটা চুক্তিটিই তৈরি হয়েছে রাজ্যের মানুষের পরিবর্তে শুধুমাত্র আদানির মুনাফার স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে৷
আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত সেবাদাস হিসাবে বিজেপি তার ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করছে৷ কিন্তু সিপিএম তার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে কেন? আসলে, মুনাফার লক্ষ্যে পুঁজিপতিদের বিনিয়োগের প্রশ্নে তারা আজ একচেটিয়া মালিকদের প্রচারিত তথাকথিত উন্নয়নের তত্ত্বকেই সমর্থন করে৷ সমৃদ্ধির নামে, কর্মসংস্থানের নামে যে উন্নয়ন খেটে–খাওয়া মানুষের সর্বনাশ করে একচেটিয়া মালিকদের মুনাফার উন্নতি ঘটায়, সিপিএম সেই উন্নয়নের পক্ষেই ঢাক পেটায়৷
অথচ এভাবে উন্নয়নের নামে গরিব মানুষের সর্বনাশের স্বরূপ তুলে ধরার কথা বামপন্থীদেরই৷ তাদেরই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা৷ বিপরীতে হেঁটে আজ সিপিএম নামক সোস্যাল ডেমোক্রেটিক শক্তিটি বামপন্থাকে কেবলমাত্র নির্বাচনী স্লোগানে পরিণত করেছে৷ ক্ষমতার স্বার্থে লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে এভাবেই তারা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কাছে নিজেদের আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাইছে৷ তাদের এই ভূমিকা আগেও দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে সরকারে থাকার সময়ে, সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের ঘটনায়৷ কেরালায় ভিজিঞ্জাম বন্দর আদানিকে উপহার দেওয়ার ঘটনায় তাদের আসল চেহারা আরও একবার নগ্ন হয়ে গেল৷
(তথ্যসূত্রঃ দ্য ওয়্যার–২৪–৮–’২২, দ্য ফেডেরাল–২২–৮–’২২, হাফ পোস্ট–১২–১০–’২০, ইকনমিক টাইমস – ২৩–৫–’১৭)