কেরালায় বন্যার এই ভয়াবহতা অনিবার্য ছিল কি

গত বছর কেরালার যে নদীগুলোতে খরা দেখা দিয়েছিল, এবার সেগুলো উপচে উঠেছে৷ এ বছর গোটা রাজ্যের প্রায় সমস্ত এলাকা বন্যায় বিধ্বস্ত৷ জীবন চলে গেছে শত শত অসহায় মানুষের৷ আহত অসংখ্য৷ তছনছ হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর–সংসার৷ ত্রাণ এবং উদ্ধারকার্যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ক্ষমাহীন উদাসীনতাকে ধিক্কার জানিয়ে গোটা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়েছে বিপন্ন মানুষের পাশে৷ কিন্তু, সাধারণ মানুষের এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি কি অনিবার্য ছিল? কেন এত বড় বিপর্যয় ঘটল? একবার নির্মম খরা, পরের বছর প্রবল বন্যা– এ কি নিছক প্রকৃতির মার? বিশেষজ্ঞেরা প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্যের ঊনচল্লিশটা বাঁধের গেট কেন সময়মতো জুলাইয়ের মাঝামাঝি খুলে দেওয়া হয়নি? সমুদ্র তীরবর্তী যে রাজ্যে পম্বা, ভারতপূজা, পেরিয়ার–সহ চুয়াল্লিশটি নদী প্রবহমান, সেখানে বন্যা–সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় অবহেলা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা৷ তাঁদের মতে, সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছুটা রোধ করা যেত৷

এই চরম অবহেলা, এই বেপরোয়া উদাসীনতা কার, কীসের জন্য? নানাবিধ উন্নয়ন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ইত্যাদি সত্ত্বেও কেন মানুষ সর্বনাশের অতলে তলিয়ে যায়? উত্তর কী? উত্তর না পেলে তো আজ কেরালা, কাল মহারাষ্ট্র, পরশু বাংলা– এ ঘটনা বারবার চলতেই থাকবে৷ এই বীভৎস ধ্বংসকাণ্ড কি এ ভাবে চলতে দেওয়া যায়?

প্রকৃতির নানা ভয়ঙ্কর আক্রমণের সামনে নানা সময়ে মানুষ পড়েছে৷ বাঁচার তাগিদে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত শ্রমকে ঐক্যবদ্ধ করে যাবতীয় আক্রমণকে প্রতিহত করতে করতেই মানুষ সভ্যতা সৃষ্টি করেছে৷ জানা–জানা অগণিত মানুষের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সুবিশাল জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, যা সভ্যতাকে আগলে রেখেছে নানান বিপদ–আপদ থেকে৷ সেই জ্ঞান প্রয়োগ করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে আরও কত নতুন ও সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতার অধিকারী হচ্ছে মানুষ৷ এই অবস্থায় উত্তরাখণ্ড বা কেরালার মতো ঘটনাগুলো তো ঘটার কথা নয়৷

শুধুমাত্র স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টির ফলে কেরালার এই মর্মান্তিক পরিণতি অনিবার্য ছিল না৷ এ কথার ভিত্তি কী? গত বছরই বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, কেরালার ৪৪টি নদীই ভয়ঙ্করভাবে দূষিত এবং সর্বনাশের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে৷ মানুষের অভিজ্ঞতায় আছে, বাসযোগ্য স্থলভূমির সাথে জলাশয়, জলাভূমি, অরণ্যভূমি ইত্যাদির ভারসাম্য না থাকলে সভ্যতা টিকিয়ে রাখা বা তার অগ্রগতি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়৷

ভারতের বহু রাজ্যের মতো কেরালাতেও জনবসতি আর প্রকৃতির এই ভারসাম্য মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, হয়ে চলেছে৷ বালির খাদান তো রয়েছেই, তার সাথে হাজার হাজার পাথর খাদান গোটা কেরালা জুড়ে৷ যত আইনি প্রায় তার সমান বেআইনি৷ তারা লাগাতার পাথর তুলে চলেছে৷ মারাত্মক সব বিস্ফোরক ব্যবহার করা হচ্ছে পাথর ভাঙার কাজে৷ এই সমস্ত কিছুর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে ভূ–গর্ভে৷ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহপথ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে পাথর বালি পরিবহণের জন্য নদীর আশপাশের খাল ইত্যাদি বুজিয়ে রাস্তা বানানো হচ্ছে৷ নদীখাতে নিয়মিত ড্রেজিং না হওয়ার ফলে নদীগুলির নাব্যতা নষ্ট হচ্ছে৷ ফলে, বৃষ্টির জলে নদীগুলির জলের উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে৷ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই হারে খাদানের অত্যাচার চলতে থাকলে আগামী পঞ্চাশ বছরে জলতল বিপদসীমা ছাড়িয়ে যাবে৷ যার পরিণতি এক পশলা বৃষ্টিতেই প্রবল বন্যা৷ এর পরেও খাদানের ব্যবসা বিনা বাধায় চলছে৷ এর দায় কাদের? এ প্রশ্ন তুললে, ব্যবসায়ীদের টাকায় বেড়ে ওঠা সরকারি দলগুলো, তাদের স্নেহভাজন মিডিয়াগুলো, উন্নয়নবিরোধী তকমা সেঁটে দেওয়ার চেষ্টা চালায়৷ এমনকী খুন পর্যন্ত করায়৷ ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বেআইনি খাদান বিরোধী আন্দোলনের কর্মী অনুপ ভেলোলিপ্পি খুন হয়েছিলেন কোঝিকোড়ে৷

শিল্পে লাগাতার মন্দার এই যুগে শিল্পপতি–ব্যবসায়ীরা, অপেক্ষাকৃত সহজে বিপুল মুনাফা লোটার জন্য, উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে পরিষেবা ক্ষেত্রে পুঁজি ঢালছে৷ বিভিন্ন রাজ্যে কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, গড়ে উঠছে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা, শিক্ষাব্যবসা, স্বাস্থ্যব্যবসা আর পর্যটন ব্যবসা৷ ১৯৮০–র পর থেকে লাগাতার কেরালার পাহাড়ের গায়ে, সমুদ্রতটে এবং লক্ষ লক্ষ হেক্টর জলাজমি ধ্বংস করে ফ্ল্যাট–রিসর্ট–বাংলো ইত্যাদির কারবার শুরু হয়েছে৷ আর হু হু করে বাড়ছে নানা ধরনের হোটেল৷ কারণ, কেরালা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ৷ দেশ–বিদেশ থেকে বছরে প্রায় ৭০–৮০ লক্ষ পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে৷ ফলে, ব্যবসায়ীরা রমরমিয়ে ফায়দা লুটছে৷ সরকারে যে–ই থাকুক, নিজেদের কায়েমি স্বার্থে তারা ওই ব্যবসায়ীদের সব রকমের ছাড় দিয়ে যাচ্ছে৷ বছরের পর বছর অসংখ্য হোটেল থেকে হাজারো রকমের বর্জ্য এসে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে, জলাশয়–নদীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে– এসব কোনও দিকেই তারা নজর দেয় না৷ উদাহরণস্বরূপ, সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন পালাক্কাড় জেলায় কোকা কোলা কারখানা কী মারাত্মক জলদূষণ ঘটিয়ে চলেছে৷ সরকার  শিল্পবান্ধব অর্থনীতির কথা বলে প্রকৃতিবিরোধী, জনবিরোধী সর্বনাশা সব নিয়মনীতি তৈরি করছে৷ এতে, গোটা কতক পুঁজিপতি আর কতকগুলো নীতিহীন জনপ্রতিনিধির সিন্দুক বেশ ভালই ভর্তি হচ্ছে৷ আর, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে সামান্য কিছু রোজগারের মিথ্যা আশা দিয়ে আদতে তাদের মরণখাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে৷ শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে তুচ্ছ করে মুনাফা লোটার সার্বিক এই ধনতান্ত্রিক চক্রই কেরালায় বন্যার মারাত্মক ভয়াবহতার জন্য দায়ী৷

বিপদ যে কোনও সময় ঘটতে পারে জেনেও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারি কর্তাব্যক্তিরা তৎপরতা দেখাননি, এটা আরও একটা গুরুতর অপরাধ৷ কৃত্রিম জলাধার কোথায় তৈরি করা যায়, বন্যাপ্রবণ এলাকায় আগাম বিশেষ সতর্কতামূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, কীভাবে প্রাণহানির সংখ্যা কমানো যায় ইত্যাদি নিয়ে সরকারি স্তরে কোথাও কোনও নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই৷

আমরা বলছি, এখনও সময় আছে৷ উত্তরাখণ্ড, কেরালা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে কোটি কোটি দেশবাসীর জীবন এবং তাদের শ্রমে সৃষ্ট বিপুল সম্পদ রক্ষা পেতে পারে৷ কিন্তু সে জন্য ধ্বংসাত্মক, ন্যায়নীতিবোধরহিত, মুনাফা–লালায়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই চাই৷ তা না হলে, বেপরোয়া পয়সা কামানোর পরিণতিতে, জনজীবনের এরকম মর্মান্তিক বিপদ বারবার ঘটতেই থাকবে৷

(৭১ বর্ষ ৬ সংখ্যা ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)