রাজভবনে আছড়ে পড়ল বিক্ষোভ
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ডিজেল–পেট্রলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়ানোয় সাধারণ মানুষের উপর মারাত্মক বোঝা চেপে বসেছে৷ প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে৷ কারণ তেলের দাম সরকার প্রতিদিন বাড়িয়ে চলেছে৷ তেল কোম্পানিগুলির মুনাফা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷ কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই তেলের উপর বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স চাপিয়ে জনগণকে শুষে নিচ্ছে৷
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসার সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অশোধিত তেলের দাম ছিল ১১০ ডলার৷ কলকাতায় প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬১ টাকা ৩৮ পয়সা৷ আর এখন অশোধিত তেল ৮০ ডলার, অথচ ডিজেল প্রতি লিটার ৭০ টাকা৷ তা হলে তেলের ‘দাম বাড়ছে’, ‘দাম বাড়ছে’ বলে যে শোরগোল তোলা হচ্ছে এবং তাকে অজুহাত করে দেশীয় বাজারে দাম বাড়ানো হচ্ছে, তা তো চরম মিথ্যাচার৷
২০১৪–র মে থেকে ২০১৭–র সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১২ বার শুল্ক বেড়েছে পেট্রোপণ্যের৷ আর এবারের মে মাসে ইতিমধ্যেই ১৪ বার দাম বাড়ানো হয়ে গেছে৷ পেট্রলে কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক ২০১৪ সালে লিটার প্রতি ৯ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০১৮ সালে করা হয়েছে ১৯ টাকা ৪৮ পয়সা৷ একই ভাবে রাজ্যের ট্যাক্সের পরিমাণ বেড়েছে৷ গত ৪ বছরে কেন্দ্র তেল থেকে ১০ লক্ষ কোটি টাকা উৎপাদন শুল্ক আদায় করেছে৷ রাজ্য সরকারগুলিও আদায় করছে কমপক্ষে ৭ লক্ষ কোটি টাকা৷
পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের মতোই মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে বলেছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদেশে তেলের দাম ওঠানামা করবে৷ সরকার আর কোনও ভরতুকি দেবে না৷ এর গালভরা নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ট্রেড প্যারিটি প্রাইসিং মেথডলজি’৷ সরকারি কর্তারা তখন ধরেই নিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তেই থাকবে এবং তার আর্থিক দায় পুরোটাই জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে থাকে৷ নরেন্দ্র মোদি যখন ক্ষমতায় বসেছিলেন সেদিন পেট্রলের দাম ছিল ৭১.৪১ টাকা৷ প্রাইস প্যারিটিকে নীতি হিসাবে ধরলে ২০১৬ সালে তেলের দাম যখন ব্যারেল প্রতি মাত্র ২৬ ডলারে নেমে এসেছিল তখন নানা রকম ট্যাক্স সহ পেট্রলের দাম হওয়া উচিত ছিল ৩০.০০ টাকার নিচে৷ অথচ মোদি সরকার দাম বেঁধে দিল ৫৯.৯৫ টাকায়৷ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৬৬ শতাংশ কমলেও দেশের মানুষকে ভিক্ষে দেওয়ার মতো এদেশে দাম কমানো হল মাত্র ১৬ শতাংশ৷ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কোনও সুফল জনসাধারণকে না দিয়ে বিপুল হারে এক্সাইজ ডিউটি ও সেন্ট্রাল ট্যাক্স বাড়িয়ে বিশাল পরিমাণে টাকা আত্মসাৎ করল সরকার৷

আসলে তেল হচ্ছে সরকারের কাছে এক কামধেনু, যাকে সহজে মোক্ষণ করে সরকারি কোষাগারে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ভরে নেওয়া যায়৷ পশ্চিমবঙ্গে পেট্রল ৮০ টাকা, ডিজেল ৭১ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে (২৫ মে)৷ কিন্তু পেট্রলের এই ৮০ টাকার মধ্যে ঢোকানো রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ট্যাক্স বাবদ ১৯.৪৮ পয়সা এবং রাজ্য সরকারের ট্যাক্স বাবদ ১৬ টাকা ২০ পয়সা৷ অর্থাৎ ৮০ টাকার মধ্যে ৩৬ টাকাই ক্রেতাকে দিতে হচ্ছে সরকারি ট্যাক্স বাবদ৷ এটা না থাকলে এ রাজ্যে পেট্রলের দাম দাঁড়ায় ৪৪ টাকা প্রতি লিটার৷ এ রাজ্যে ডিজেলের খুচরো দাম ৭১.০৮ টাকা৷ এর মধ্যে কেন্দ্রের ট্যাক্স ১৫.৩৩ টাকা, রাজ্য সরকারের ট্যাক্স ১০.৬০ টাকা৷ এই ২৬ টাকার ট্যাক্স বাদ দিলে এ রাজ্যে ডিজেল ক্রেতারা অনায়াসে ৪৫ টাকা লিটার পেতে পারেন৷ কী অভাবনীয় লুঠ চলছে ভাবুন!

সরকারি বিপুল লুঠ ছাড়াও রয়েছে তেল কোম্পানিগুলির লুঠ, যা নিয়ে কোনও সরকার টুঁ শব্দ করে না৷ একদিকে পরিশোধন ব্যয়ের থেকে অনেক বেশি দাম চাপিয়ে তেল বিক্রি করছে৷ অন্য দিকে দেশীয় তেলখনিগুলি থেকে যে তেল তুলছে আম্বানি সহ তেল কোম্পানিগুলি তা–ও আন্তর্জাতিক দামেই বিক্রি করে অগাধ মুনাফা লুটছে৷ এ সব নিয়ে সরকারগুলি নীরব৷ বরং তারা যাতে নীরবে, লোকচক্ষুর আড়ালে এই লুঠ চালিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করে চলেছে৷ বাস্তবে তেল কোম্পানিগুলিই সরকারের তেল নীতি ঠিক করে দিচ্ছে৷

তেলের দামবৃদ্ধির ফলে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় জনজীবন যখন বিপর্যস্ত তখন দাম কমানোর দাবিতে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ রাজ্য যে জনগণের ঘাড় ভেঙে বিপুল ট্যাক্স আদায় করছে তা নিয়ে নীরব তৃণমূল কংগ্রেস৷ তাদের এই প্রতিবাদ সত্যিই জনস্বার্থে হলে তাদের উচিত প্রথমে রাজ্যের ট্যাক্স কমানো, তারপর আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স কমাতে বাধ্য করা৷ তা কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস করছে না৷ অতীতেও দেখা গেছে, কেন্দ্রে কংগ্রেস কিংবা রাজ্যে সিপিএম যারা যখন ক্ষমতায় বসেছে তারা একই ভাবে বিপুল ট্যাক্স চাপিয়ে জনগণকে শোষণ করেছে৷ কারণ মুখে জনগণের স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে সত্যিই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা, জনজীবনের দুর্গতি রোধ করা এদের কারও উদ্দেশ্য নয়৷ এই দলগুলি কোনওটিই জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী দল নয়৷
ইতিমধ্যে পণ্যপরিবহণের ভাড়া নিঃশব্দে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ যার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে মূল্যবৃদ্ধিতে৷ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সহ সমস্ত জিনিসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে৷ যাত্রীপরিবহণের ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলছে পরিবহণ মালিকরা৷ অর্থাৎ আরও এক দফা বোঝা চাপবে জনগণের উপর৷ জনগণ যখন দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে, তখন পরিবহণ কোম্পানিগুলি তাদের লোকসানের গল্প প্রচার করে চলেছে৷ সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, গরিব মানুষ যারা জীবিকার

প্রয়োজনেই প্রতিদিন গণপরিবহণ ব্যবহার করতে বাধ্য হয় তাদের আয় বাড়ানোর কোনও ব্যবস্থা কোনও সরকারই করছে না, বরং নানা ভাবে তা কমে চলেছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই জনগণ পরিবহণের ভাড়াবৃদ্ধির তীব্র বিরোধী৷ পরিবহণের ভাড়া বাড়িয়ে নয়, কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারকে ট্যাক্স কমিয়ে এবং তেল কোম্পানিগুলির যথেচ্ছ মুনাফা নিয়ন্ত্রণ করেই পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যায়৷ মনে রাখতে হবে, জনবিরোধী এই সরকারগুলিকে ট্যাক্স কমাতে বাধ্য করতে হলে ব্যাপক গণআন্দোলন ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) সেই গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজেই নিয়োজিত আছে৷ জনগণকে সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে শক্তিশালী করতে হবে যাতে তা দাবি আদায়ের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে৷
দাম রাজ্য কর কেন্দ্রীয় কর
পেট্রল ৮০.১২ টাকা ১৬.২০ টাকা ১৯ টাকা ৪৮ পয়সা
ডিজেল ৭১.০৮ টাকা ১০.৬০ টাকা ১৫ টাকা ৩৩ পয়সা
কেন্দ্রীয় কর রাজ্য কর
পেট্রল ৩১.৮৮ শতাংশ ২৫.২৯ শতাংশ
ডিজেল ২৬.৭৫ শতাংশ ১৭.৭০ শতাংশ
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)