দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যা কবলিত। হাওড়া, হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া, দুই মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অংশ জলের তলায়। হুগলির আরামবাগ মহকুমায় জলে ডুবে এক শিশু সহ চার জনের মৃত্যু হয়েছে, খানাকুলে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বন্যাদুর্গত। হাজার হাজার বাড়িঘর ভেঙে গিয়েছে, গবাদি পশু ভেসে গেছে, মারা গেছে। কৃষিফসলের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন বহু মানুষ। ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে খাদ্য ও পানীয় জলের। বন্যার পরে পরেই জ্বর সর্দি-কাশি-ডায়েরিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি নানা রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বহু জায়গায় মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, রাস্তা অবরোধ করেছেন।
কেন এই বন্যা? পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে প্রবল বৃষ্টি এবং এ রাজ্যের কয়েকটি জেলায় বৃষ্টিপাতের কারণে প্রচুর পরিমাণে জমা জল বাঁধগুলি থেকে ছাড়ার কারণে মূলত এই বন্যা। এর সাথে রাজ্যের বহু স্থানে জলনিকাশি ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে থাকার কারণে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। নাব্যতা থাকলে নদীগুলি অতিরিক্ত জল ধারণ করতে পারত। সে জন্য প্রয়োজন ছিল নিয়মিত ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা বাড়ানো। দামোদর, কংসাবতী, রূপনারায়ণ সহ কোনও নদীতেই ড্রেজিং হয়নি দীর্ঘদিন। ডিভিসির বাঁধগুলি সহ কোনও নদীতে জলাধারের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা গত ৭০ বছরে এক বারও ড্রেজিং হয়নি বলে ডিভিসি সূত্রেই জানা গেছে। শুরুতে এর জলধারণ ক্ষমতা ছিল প্রায় সাড়ে ছয় মিলিয়ন কিউবিক মিটার। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় জল কমিশনের সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশ, তা প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছে (আনন্দবাজার পত্রিকা-১১। ৯)। এই দীর্ঘ সময়ে কেন্দ্রের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস ও বিজেপি, কিন্তু কেন ড্রেজিং হল না, তার কোনও জবাব তারা দিতে পারেনি। উল্টেকেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানিয়েছেন, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে ডিভিসি-তে ড্রেজিং সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল, তা হলে কি ফি-বছর বন্যায় ভাসতে থাকবে মানুষ? চাঁদে, মঙ্গলে অভিযান করছে যে দেশ, সে দেশে প্রযুক্তির অভাব বলে মানতে হবে? প্রধানমন্ত্রীর জন্য সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার বিমান কেনার পয়সা আছে, অথচ বন্যা থেকে মানুষকে বাঁচানোর কাজে টাকার অভাবের কুযুক্তি কি মানা যায়?
রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দুর্গাপুর ব্যারেজ। ব্যারেজের আপস্ট্রিমের পলি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রেও রয়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের চরম অবহেলা। একই ভাবে বিহার-ঝাড়খণ্ড সরকারেরও দায়িত্ব ছিল ড্রেজিং করার। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির তরফে তা চূড়ান্তরূপে অবহেলিত হয়েছে। রাজ্যেও বহু জায়গায় নদীবাঁধগুলি ভেঙে পড়েছে। নদী বাঁধের ওপর এবং নিকাশি খালে অবৈধ নির্মাণ, ভেড়ি, ইটভাটা ইত্যাদি ভাঙার কথা বারবার বলা হলেও প্রভাবশালীদের মদতে প্রশাসন এ বিষয়ে চোখ বুজে থাকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, চন্দ্রকোণা, দাসপুরে বাঁধ ভেঙে প্লাবন হয়েছে। কংসাবতীর বাঁধও প্রায় ২০ বছর ধরে সংস্কার হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে একাধিক নদীকে ঘিরে সামগ্রিক পরিকল্পনা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা শোনা যাচ্ছে দশকের পর দশক। কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের টালবাহানায় তা রূপায়িত হচ্ছে না। মাঝে অর্থ বরাদ্দের কথা শোনা গেলেও কার্যকরী কিছু হয়নি।
ফলে এই বন্যা চূড়ান্তভাবে ‘ম্যান মেড’ বন্যা, আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে সরকারি অবহেলাজনিত বন্যা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে ‘ম্যান মেড’ বলে হইচই করছেন, তাতে তাঁর সরকারের দায় ঝেড়ে ফেলার প্রচেষ্টা স্পষ্ট। কিন্তু বাস্তব হল, কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমার অযোগ্য দায়িত্বহীনতার পরিণামেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে এই দুর্ভোগ নেমে এল।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের উদ্যোগে ত্রাণের কাজ নিয়ে চলছে অবহেলা এবং দলবাজি। এস ইউসি আই (কমিউনিস্ট) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ এবং নিরপেক্ষ ভাবে সেই ত্রাণ বিতরণের দাবি জানিয়েছে। ত্রাণ বিতরণ নিয়ে শাসক দলগুলির যে দলবাজি ও দুর্নীতি মানুষ বারেবারে প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে মানুষ আতঙ্কিত যে, এ বারও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) সর্বদলীয় কমিটি গড়ে সরকারি ত্রাণ বিতরণের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি দলগত ভাবে এস ইউ সি আই (সি) ত্রাণের কাজে নেমেছে। দলীয় কর্মী-সমর্থকরা উদ্ধার কাজে ও সারা রাজ্যে ত্রাণ সংগ্রহে নেমেছেন। দলের মেডিকেল টিম চিকিৎসা শিবির পরিচালনা করছে। দলের উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কমিটিগুলিও ক্ষতিপূরণের দাবিতে প্রশাসনিক স্তরে ডেপুটেশন-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতি বর্ষায় বন্যার পুনরাবৃত্তি এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে স্থায়ী ব্যবস্থার দাবিতে ব্যাপক গণঅন্দোলন গড়ে তোলার জন্য রাজ্যের মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।
১৮ সেপ্টেম্বর, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট ১২ দফা দাবিতে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক ও জেলা পরিষদের সভাধিপতিকে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দাবি তোলা হয়– দুই মেদিনীপুর জেলার বন্যাকবলিত এলাকায়় প্রয়োজনে পাম্প বসিয়ে জমা জল দ্রুত বের করতে হবে। ভেঙে যাওয়া নদীবাঁধ দ্রুত বাঁধার বন্দোবস্ত করতে হবে। সমস্ত নিকাশি খালে কচুরিপানা সহ আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে। জলনিকাশির পথ আটকে থাকা সমস্ত বেআইনি মাছের ভেডি, ইটভাটা প্রভৃতি অবিলম্বে সরাতে হবে। সমস্ত নদীতে ড্রেজিং, সমস্ত খালের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, বাঁধগুলি সংস্কার করতে হবে। সমস্ত লকগেটের আধুনিকীকরণ করতে হবে। বন্যাদুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত মানুষকে পর্যাপ্ত ত্রিপল, শুকনো খাবার, পানীয় জল সহ প্রয়োজনীয় রিলিফ দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বন্যা-ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকেও মুখ্যমন্ত্রী, সেচমন্ত্রী, জেলাশাসক ও জেলা পরিষদের সভাধিপতিকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ঘাটালের মহকুমা শাসক ও সেচ দপ্তরের এসডিও-কে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ঘাটালের অনেকগুলি গ্রামে নৌকা সহযোগে বন্যা দুর্গতদের মধ্যে যোগাযোগ করে শুকনো খাবার, বেবিফুড, পানীয় জল ও ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়।