কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের দাপটে ভারতসহ সমগ্র বিশ্ব যখন আতঙ্কিত ও দিশেহারা, এই ভাইরাসের ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া প্রজাতিগুলির সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক কী হবে, তা নিয়ে চলছে গবেষণা, তখন জানাগেল, কিছুটা হলেও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধটি এই রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে। ঘটনাচক্রে এই ওষুধটি ভারতেইবেশি তৈরী হয় ম্যালেরিয়া ও রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের চিকিৎসার জন্য। ভারতে দুটিবেসরকারি সংস্থা ‘ইপকা’ ও ‘জাইডাস ক্যাডিলা’ এবং একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড’ এটি তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হূ’ এবং দেশীয় গবেষণা সংস্থা ‘আইসিএমআর’ এই ওষুধটি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। তারা শুধুকোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীই নয়, কোয়ারাইন্টাইনে রাখা সন্দেহভাজনদের এবং চিকিৎসায় যুক্ত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদেরও প্রতিরোধক হিসাবেদেওয়ার কথা বলেছে। এতে সংক্রমণ এড়ানো, নিদেনপক্ষে কমানো সম্ভব হবে।
দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রুত হারে বাড়ছে। ২১ দিন লকডাউন চলার পরেও এর সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে পাঁচশোরও বেশি মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। সংক্রমিত হয়ে পড়ছেন ডাক্তার, নার্স ,স্বাস্থ্যকর্মীরা। বাদ যাননি এমনকি একটি হাসপাতালের সুপারও। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পরিষেবাকে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে সাজানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রয়োজন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো ওষুধের বিপুল পরিমাণে সরবরাহ। অথচ যে শতাব্দীপ্রাচীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এই ওষুধগুলি তৈরি করে, তাদের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বাড়তি নির্দেশ আসেনি। আসেনি হাইড্রি’ক্লোরোকুইন তৈরি করার অনুমতি। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে যথাযথ ভাবে ব্যবহারের যে প্রয়োজন ছিল, তা না করে কেন্দ্রীয় সরকার বেসরকারি সংস্থা ‘ইপকা’-কে ১০কোটি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেটের বরাত দিয়ে দিল। যদিও অনেক পরে হলেও রাজ্য সরকার বেঙ্গল কেমিক্যালকে ৩০ লক্ষ হাইড্রি’ক্লোরোকুইন ট্যাবলেট তৈরির বরাত দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এমন আচরণ কি ওই বেসরকারি কোম্পানিগুলির স্বার্থ দেখার বেআব্রু চেষ্টা নয়? স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠেছে যে, ওই কোম্পানিদুটি মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ বলেই কি এভাবে বেঙ্গল কেমিক্যালকে বঞ্চিত করা হল?
বেঙ্গলকেমিক্যালের ওষুধ বাজারে বিক্রি হয় না। বিভিন্ন রাজ্য সরকার সরকারি হাসপাতালের জন্য এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর সেনাবাহিনীর জন্য এখানে বরাতদেয়। এখানে ৪৫ রকমের ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল, ১০ ধরনের ইনজেকশন এবং নানা জীবাণুনাশক সামগ্রী তৈরি হয়। বেশ কয়েক বছর লোকসানে থাকার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার একে বিআইএফআর-এ পাঠায় এবংবেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আন্দোলনের চাপে এবং আদালতের রায়ের ফলে তারা তা করতে পারছে না। যদিও সংস্থাটি পূর্বের লোকসানের পর্যায় কাটিয়ে উঠে সম্প্রতি স্বনির্ভর হতে পেরেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ তারা পর্যায়ক্রমে শোধ করে চলেছে, তবুও সরকারেরলোলুপ দৃষ্টি এড়ানো যাচ্ছে না। সরকার একে বিক্রি করতে মরিয়া। আর ঠিক এই কারণেই কি সরকার এদের ওষুধ তৈরির বরাত দিতে চাইছে না? পাছে বরাত পেলে বেঙ্গল কেমিক্যাল আবার ভাল করে উঠে দাঁড়ায়!
শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই স্বাধীন ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবাটি যাতে স্বনির্ভর হয়ে গড়ে উঠতে পারে, সেজন্যই তাঁর এই প্রয়াস ছিল। দেশকে একটা সুস্থ সবল সামাজিক কাঠামোর উপর দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আর আজ স্বাধীনতার প্রায় তিয়াত্তর বছর পর সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। স্বাস্থ্যনীতি বলতে আজ প্রতিটি মানুষের সুস্থ ভাবেবেঁচে থাকার অধিকার দেওয়ার সামাজিক নীতিকে বোঝায় না। স্বাস্থ্য এখন পরিষেবা নয়, এটা এখন পণ্য– বিশ্বায়নের বাজারের পণ্য। এই পণ্যের বাজারকে উন্মুক্ত করতে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও যতটুকু টিকে আছে, সেটুকুও বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বেপরোয়া চেষ্টা চালাচ্ছে মোদি সরকার। তাইবেঙ্গল কেমিক্যাল বিক্রি করে দিতে তারা এত মরিয়া। মানুষ মরলেও সরকার তার নীতিতে একরোখা।