২০১৪ সালে যখন বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে, সবার বিকাশের, সবার আচ্ছে দিনের অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন স্বঘোষিত ‘বিকাশপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদি৷ আমরা গণদাবীতে লিখেছিলাম, এই সরকার কংগ্রেসের দুঃশাসনের থেকে আলাদা কিছু মানুষকে দিতে পারবে না৷ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, দুর্নীতি আরও বাড়বে৷ এক পাঠক প্রতিবাদ জানিয়ে গণদাবী দপ্তরে চিঠি লিখেছিলেন, কেন আপনারা আগে থেকে সরকার সম্পর্কে এমন কথা বলছেন৷ আগে দেখুন সরকার কী করে, তারপরে বলবেন৷ উত্তরে আমরা বলেছিলাম, সরকার সম্পর্কে আমরা যা বলেছি, তা আমাদের অনুমান নয়, কিংবা জ্যোতিষীদের মতো তা কোনও মনগড়া ভবিষ্যদ্বাণীও নয়৷ আমরা বলেছিলাম মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ ও শ্রেণি রাজনীতির বিচারে৷ বলেছিলাম, বিজেপি পুরোপুরি একটি বুর্জোয়া দল, বুর্জোয়া শ্রেণির সেবা করাই তার উদ্দেশ্য৷ সরকারি ক্ষমতায় গিয়ে এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখাই তার কাজ হবে৷ বিজেপির গত চার বছরের কর্মকাণ্ড যেমন, তেমনই সদ্য পেশ করা সর্বশেষ বাজেটটিও তার প্রমাণ৷ দেশের সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির কোনও সুরাহাই বাজেটে পেল না৷ মূল্যবৃদ্ধি রোধের কোনও কথা নেই৷ ঠিক যেমন নেই কর্মসংস্থান নিয়ে একটি শব্দও৷ নেই মোদি সরকারের বহু উচ্চারিত কালো টাকা উদ্ধারের গল্পও৷
বাজেটে ১০ কোটি পরিবারের জন্য ৫ লক্ষ টাকা করে স্বাস্থ্যবিমা এবং চাষিদের জন্য সহায়ক মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবকে দেখিয়ে সরকারি দলের নেতা–মন্ত্রীরা একে গ্রাম–গরিব–চাষির বাজেট বলছেন৷ দেশে জনস্বাস্থ্যের ভয়ঙ্কর দুরবস্থার কথা কারও অজানা নয়৷ তা দূর করতেই কি সরকার স্বাস্থ্যবিমা ঘোষণা করেছে? তা হলে বিমা কেন? কেন স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়? সরকারি হাসপাতালগুলিতে সাধারণ মানুষ যাতে সঠিক চিকিৎসা পেতে পারে তার জন্য পরিকাঠামোর উন্নতি না ঘটিয়ে অধিকাংশ গরিব, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? তা ছাড়া কোন পরিবারগুলি এই বিমার অন্তর্ভূক্ত হবে তা কীসের বিচারে ঠিক হবে? বিমা ঘোষণার দ্বারা স্বাস্থ্য নিয়ে সরকার কত চিন্তিত তার বিজ্ঞাপন হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়৷
চাষের বিপুল খরচ কমানোর কোনও সুরাহা বাজেটে নেই৷ চাষিদের থেকে ফসল সহায়ক মূল্য দিয়ে কে কিনবে, অর্থাৎ সরকার নিজে কিনবে, নাকি কর্পোরেটদেরই সেই দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হবে, সহায়কমূল্য কী দিয়ে স্থির হবে, কোনও কিছুই স্পষ্ট করে বলা নেই৷ বাজেটে কৃষকদের আয় পাঁচ বছরে দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে৷ কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় এমন অবাক কাণ্ডটি ঘটবে, সে সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি৷ কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতিকে বিজেপি সভাপতি স্বয়ং নির্বাচনী জুমলা (লোকঠকানো প্রতিশ্রুতি) বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ দেশের মানুষকে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে সভাপতি কবে এই প্রতিশ্রুতিটিকেও জুমলা বলে উড়িয়ে দেন৷
বছরে দু’কোটি বেকারের কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিল বিজেপি৷ বাজেটের হিসেব বলছে, গত দু’বছরে কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ৷ গত চার বছরে বিজেপি সরকার এমন কোনও পরিকল্পনা করতে পারেনি যেখানে দেশের বেকাররা কাজ পেতে পারে৷ বরং নোট বাতিল এবং জিএসটির ধাক্কায় ছোট ও মাঝারি সংস্থায় আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন৷ সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ কোনও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি৷ এর দ্বারা একমাত্র একচেটিয়া পুঁজিপতিরা, যারা প্রতিরক্ষা সহ সরকারের খুলে দেওয়া ক্ষেত্রগুলিতে বিদেশি কোম্পানিগুলির সাথে যুক্তভাবে উৎপাদন করে তা সরকারকে এবং বিদেশের বাজারে বিক্রি করবে, তারা লাভবান হলেও দেশের সাধারণ মানুষের, বেকারদের কোনও সুরাহা হয়নি৷
গদিতে বসার আগে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় এলে ৬০ দিনে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনবেন৷ দাম ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেবেন’ (আনন্দবাজার পত্রিকা : ২২/০৫/২০১২)৷ বাস্তবে আজ পুঁজিপতিরা, বৃহৎ ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো জিনিসের দাম বাড়িয়ে বিপুল হারে মুনাফা তুলছে৷ এদের বিরুদ্ধে মোদি সেদিনও যেমন কথা বলেননি, বাজেটেও তেমনই তাদের বিরুদ্ধে কোনও কথা নেই৷ তারা বহাল তবিয়তে ছিল এবং থাকছেও৷ জনসাধারণই শুধু মূল্যবৃদ্ধির চাপে হাঁসফাঁস করছে৷
২০১৪–র নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদের সেন্ট্রাল হলে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, নতুন সরকার হবে গরিবের৷ তাদের আশা আকাঙক্ষা পূরণই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য৷ আমরা বলেছিলাম, এটা ডাহা মিথ্যে কথা৷ তিনি যদি গরিবের প্রতিনিধিই হতেন তবে কর্পোরেট মিডিয়া ছ’মাস ধরে লাগাতার তাঁর প্রচার দিত না৷
মোদি বলেছিলেন, ‘‘সরকারের ভূমিকাটাই তিনি বদলে দিতে চান৷ সরকারের কাজ হবে সহায়তাকারীর৷ তারা সব কাজ নিজে করবে না৷ বরং বেসরকারি সংস্থা ও অন্যরা যাতে ঠিকভাবে নিজেদের কাজ করতে পারে, তার যথাসম্ভব সুযোগ করে দেবে’’ (এই সময়, ২২/০৫/২০১৪)৷ সেদিন আমরা দেখিয়েছিলাম, এটি নতুন কোনও কথা নয়৷ বিশ্বায়নের ফর্মুলার সঙ্গেই এই মন্ত্র যোগ করা আছে৷ নরসিমা–মনমোহন জুটির সময় থেকেই এ মন্ত্র আওড়ানো হয়েছে ক্রমাগত৷ ধনকুবের শিল্পপতিরা এবং তাদেরই অর্থে পরিচালিত সংবাদমাধ্যম প্রায়শই আর্থিক সংকটের দাওয়াই হিসাবে এই মন্ত্র শুনিয়েছে৷ গত চার বছর ধরে মোদি সরকার এই বেসরকারি সংস্থাগুলির অবাধে লুটপাটে সহায়তাই করে গেছে এবং জনগণের স্বার্থকে তাদের পায়ে বিসর্জন দিয়েছে৷ মোদি সরকার পুঁজিপতিদের আর্থিক রমরমাকেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হিসাবে প্রচার করেছে৷ সমালোচনার উত্তরে সরকারের নেতা–মন্ত্রী–বিশেষজ্ঞরা ট্রিকল ডাউন থিয়োরি তথা ওপরতলা থেকে সম্পদের চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্বের ঢাক বাজিয়েছেন৷ বাস্তবে ধনীর ভাণ্ডার থেকে কতটুকু চুঁইয়ে সমাজের নিচুতলা পর্যন্ত পৌঁছেছে? কিছুই পৌঁছায়নি৷ এ সবই যে ছিল ঝকমকে কথার ভোজবাজিতে মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা, তা আজ প্রমাণিত৷ সেই না পৌঁছানোর কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফ্যামের রিপোর্ট৷ তাতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশের মালিক মাত্র এক শতাংশ ধনকুবের৷ এই রিপোর্ট দেখিয়েছে, ২০১৭ সালেই তাদের সম্পদ বেড়েছে ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা, যার পরিমাণ ২০১৭–১৮ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের মোট পরিমাণের সমান৷ অর্থাৎ মোদি রাজত্বে পুঁজিপতিরা, ধনকুবেররা কী অসম্ভব গতিতে জনগণের সম্পত্তির লুঠতরাজ চালাচ্ছে এই পুঁজিপতিরাই সরকারি বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি থেকে দশ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে শোধ দেয়নি৷ আর সরকার ক্রমাগত কোষাগার থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে টাকা জুগিয়ে যাচ্ছে, যা আবার একই প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিদেরই পকেটে যাচ্ছে৷ আবার, ব্যাঙ্কের এই দুরবস্থা দেখিয়েই তার থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে এফআরডিআই–এর মতো কালা বিল নিয়ে আসছে সরকার যার দ্বারা সাধারণ মানুষের জমানো শেষ সম্বলটুকুও আত্মসাৎ করবে এই ধনকুবেররা৷
ক্ষমতায় বসার আগেই নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, থমকে থাকা সংস্কারের চাকা ফের গড়ানোর কাজ শুরু করবেন তিনি৷ প্রতিরক্ষা, রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে এরই মধ্যে দেশি–বিদেশি বৃহৎ পুঁজির লগ্নির দরজা খুলে দিয়েছে এই সরকার৷ খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্ণির অনুমতি সারা দেশে কয়েক কোটি খুচরো ব্যবসায়ীর রুটি–রুজি কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে৷ কংগ্রেস সরকারের মতো বিজেপি সরকারও কোষাগারে অর্থসংগ্রহের নামে জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে জলের দামে৷ এবারও বাজেটে ব্যাপক বিলগ্ণিকরণের কথা বলা হয়েছে৷ এই ধনকুবেরদের জন্যই এবার বাজেটে কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে৷
সেদিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করেই আমরা বলেছিলাম, এই সরকার জনগণের দুঃসহ জীবনে কোনও সুফল নিয়ে আসবে না৷ বলেছিলাম, বিজেপি কোনও নতুন দল নয়৷ এর আগেও বিজেপি কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ৬ বছর ক্ষমতায় ছিল এবং রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে৷ কেন্দ্রে–রাজ্যে সেই সব শাসনের অভিজ্ঞতা মানুষের খুবই তিক্ত, যা কংগ্রেসি অপশাসনের থেকে কোনও অংশেই পৃথক নয়৷ বিজেপি শাসনে মানুষের ক্ষোভ সেদিন এতটাই উত্তাল হয়েছিল যে ২০০৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় ঘটে৷
ঢাক–ঢোল যতই বাজানো হোক, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি আর্থিক নীতির প্রশ্নে কংগ্রেস বা অন্য কোনও বুর্জোয়া দলের থেকে আলাদা বা বিকল্প যে নয় তা আজ দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার৷ সেই বিশ্বায়ন, সেই উদারনীতি– সবই এক, শুধু বলবার ঢং ও বুলিই শুধু একটু আলাদা৷ সেদিন আমরা বলেছিলাম, কর্পোরেট পুঁজির মদতপুষ্ট দল হিসাবে বিজেপির এর বাইরে কিছু করার নেই৷ কর্পোরেট পুঁজির সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই সে ক্ষমতায় বসেছিল৷ তাই জনগণের স্বার্থ সে দেখতে পারে না৷ মার্কসবাদ দেখিয়েছে, দল মানেই শ্রেণি–দল৷ এই কথাটা না বুঝে একে অস্বীকার করলেই বুর্জোয়াদের প্রতারণার ফাঁদে গিয়ে পড়তে হবে৷ এ ব্যাপারে স্মরণীয় মহান লেনিনের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘জনগণ বরাবরই রাজনীতিতে প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ শিকার হয়ে এসেছে এবং সর্বদা হতেই থাকবে যতদিন না তারা সকল নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণাবলি এবং প্রতিশ্রুতিগুলির পিছনে কোন বা কোন কোন শ্রেণির স্বার্থ কাজ করছে, তা খুঁজে বের করতে শিখবে৷’’
মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ধীরে ধীরে বাড়ছে৷ আবার ধনকুবেরদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে হয় কংগ্রেসকে, না হয় তাদেরই মদতপুষ্ট অন্য কোনও জোটকে বিজেপির বিকল্প হিসাবে প্রচারে তুলে আনবে, জনগণকে ভোট–রাজনীতির ফাঁদেই বেঁধে ফেলার চেষ্টা করবে৷ বুর্জোয়া ভোট রাজনীতিতে শোষিত মানুষের মুক্তি নেই স্বাধীনতার সত্তর বছরের ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে৷ মুক্তি রয়েছে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে তোলার মধ্যেই৷