১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেছেন তা সার্বিকভাবে গরিব মানুষের স্বার্থবিরোধী। অন্যদিকে এই বাজেট কর্পোরেট স্বার্থের অনুকূলে হওয়ায় কর্পোরেট মালিকদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেছে। দু’হাত তুলে তারা বিজেপি সরকারকে আশীর্বাদ করছে। নির্লজ্জ প্রচারমুখী মোদি সরকারের এই বাজেট নানা কথার ফুলঝুরির আড়ালে প্রতারণা ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভরা। সমাজের নানা অংশের গরিব মানুষ এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সামগ্রিক বাজেটের সাথে শিক্ষা বাজেটের সুরে কোনও পার্থক্য ঘটেনি। মোট প্রায় ১.১২ লক্ষ কোটি টাকার শিক্ষা বাজেট গত বছরের বাজেট ১.০৪ লক্ষ কোটির তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি, এই প্রথম ১ লক্ষ কোটি টাকার গণ্ডি ছাড়িয়েছে ইত্যাদি বলে সরকার ও শাসক দলের তরফ থেকে প্রবল হৈ চৈ করা হচ্ছে। শাসক ঘনিষ্ঠ মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করে বলা হচ্ছে, কোভিডের জন্য দু’বছরে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য নাকি এই বাজেট। এই প্রচার যে কত সারবত্তাহীন তা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে।
প্রথমত, ১ লক্ষ কোটি টাকার গণ্ডি পারের গল্প কেবল এ বছর নয়, গত বছরও শোনানো হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের ১.০৪ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট সংশোধিত হয়ে কমে ০.৯৯ লক্ষ কোটিতে দাঁড়ায়। এ বারেও সেই প্রকৃত বাজেট আরও কোথায় নেমে দাঁড়াবে তার হিসাব পরে মিলবে। ফলে এই গণ্ডি অতিক্রমের প্রচারের সম্মুখীন আমরা আবারও হতে পারি। দ্বিতীয়ত, বর্তমানের ৭ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করলে বাজেট ৭ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সহজ পাটিগণিতের হিসাবে তা হবে ১.০৪ লক্ষ কোটি টাকাই। ফলে শিক্ষায় কি বাজেট বৃদ্ধি হল?
এখন আসা যাক, শিক্ষা বাজেট কী হওয়া উচিত, মোট বাজেটের কত শতাংশ বরাদ্দ করা উচিত বা জিডিপি-র কত শতাংশ এই খাতে খরচ করা উচিত সেই সব প্রশ্নে। স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় স্তরে যত শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে শিক্ষায় সরকারি আর্থিক দায় সম্পর্কে তাদের সকলেরই সুপারিশ ছিল, কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করতে হবে। জিডিপি-র ক্ষেত্রে তাদের সুপারিশ ছিল ৬ শতাংশ। এটা বাস্তব যে, কোনও কেন্দ্রীয় সরকার, অতীতের কংগ্রেস বা বর্তমান বিজেপি, কেউই তার ধারে কাছে পৌঁছাতে পারেনি। বিজেপির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ চালু করতে গিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদিজি গত ১৫ আগস্ট লালকেল্লার মঞ্চ থেকে ভাষণে বলেছিলেন, ‘দেশ গর্বিত এমন একটা জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করার জন্য’। শিক্ষানীতির নথি বলছে, ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, ভারতে শিক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ ১৯৬৮ সালের শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক জিডিপি-র ৬ শতাংশ, যা ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ও ১৯৯২ সালের পর্যালোচনাতে সমর্থন করা হয়েছিল– এর কাছাকাছি কোনওদিন যায়নি (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, অনুচ্ছেদ ২৬.১)। ১৯৬৮, ১৯৮৬ ও ১৯৯২ সালের যে নথির কথা বলা হয়েছে তা কংগ্রেস রাজত্বের। কংগ্রেসী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এত জেহাদ ঘোষণাকারী মোদিজি কিন্তু এ ব্যাপারে কংগ্রেসের ছেড়ে যাওয়া জুতোতেই পা গলিয়ে স্বস্তি বোধ করলেন। বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি দূরের কথা, তা ক্রমশ কমাতেই থাকলেন। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত সংকটের যুগে তার সেবাদাস কোনও দল যে শিক্ষা-স্বাস্থে্যর মতো পরিষেবা ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে পারে না তারই প্রমাণ পাওয়া গেল।
জিডিপি-র হারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখা যাক। ২০১৯ সাল থেকে শিক্ষার জন্য খরচ এই দেশে জিডিপি–র ২.৯ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। প্রধানমন্ত্রীর সাধের ২০২০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণার পরেও তা বাড়েনি। চিলি, নরওয়ে, ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা– এসব দেশে শিক্ষায় খরচ জিডিপি-র ৬ শতাংশ বা তার বেশি। তাতে কি ওই দেশগুলো ভারতের থেকে পিছিয়ে পড়ছে? জাতীয় শিক্ষানীতিতে এবং এই বাজেটে বারবার তাঁরা ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’-র আসনে বসাবেই দাবি করে যাচ্ছেন। নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকা উচিত।
কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ যদি ক্রমাগত কমতে থাকে তাহলে শিক্ষায় জিডিপি-র শতাংশ হার বাড়বে কী করে? নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে বাজেটের ৪.৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। ২০১৫-১৬তে তা কমে দাঁড়ায় ৩.৮৮ শতাংশ, এবং এই বরাদ্দ কমতে কমতে ২০২৩-২৪ তা হয়েছে ২.৫ শতাংশ। এই সামান্য অর্থের সিংহভাগ খরচ হবে অনলাইন শিক্ষার পিছনে। প্রসঙ্গত, বিজেপি সরকারের অ্যাজেন্ডায় আছে ন্যাশনাল ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরেই প্রতিষ্ঠা করা। ৪জি পরিষেবা ব্যবহার করে ‘অ্যাপ’ ভিত্তিক শিক্ষার পরিকাঠামো তারা গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছে। তাহলে শ্রেণি-কক্ষ শিক্ষা, পরিকাঠামোর বিকাশ, গবেষণা প্রভৃতির জন্য টাকা আসবে কোথা থেকে?
সব থেকে অবাক করেছে মিড-ডে মিল বাবদ অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্র। মিড-ডে মিলে শিশু-কিশোরদের মাথাপিছু বর্তমান বরাদ্দ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫.৪৫ টাকা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তা ৮.৪৫ টাকা। এই চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির সময়ে তাতে ছাত্রদের মধ্যাহ্নভোজের পাতে কত পুষ্টিকর খাদ্য পড়ে তা বুঝতে কারও অসুবিধা নেই। গ্রামে-শহরে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলির খোঁজ রাখলেই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিলবে। গত বছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১২৮০০ কোটি টাকা, তা বর্তমান বছরের বাজেটে ১১৬০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ১২০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে আগামী দিনগুলিতে স্কুল ছাত্রদের পাতে কী পড়বে তা ভাবতেও অস্বস্তি হয়। কত হৃদয়হীন হলে তবে একটা সরকার শিশুদের খাবার নিয়ে এমন কাজ করতে পারে! কিন্তু ‘মিড-ডে মিল’ প্রকল্পকে ‘পিএম পোষণ’ নামকরণ করতে তাঁরা ভোলেননি। কেবল প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের জন্য নির্লজ্জ ব্যবস্থা!
এর পরেও কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ট্যুইট করে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এই বাজেটকে সর্বসাধারণের শিক্ষার অনুকূলে ও শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের পরিপূরক বলে দাবি করেছেন। তা তিনি মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য যত প্রশংসাই করুন না কেন, এই বাজেটের ফলে সরকারি অর্থানুকূল্যের অভাবে সরকার-পোষিত সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ, কর্পোরেটীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের পথ আরও সুগম হবে। শিক্ষার ব্যয়ভার আকাশচুম্বী হবে, যাদের আর্থিক শক্তি আছে তাদের পরিবারই শিক্ষার আঙিনার মুখ দেখবে, দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির পরিবারে সন্তান-সন্ততি শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবে। ভারত সরকার গ্যাটস চুক্তিতে সই করার ফলে শিক্ষার আঙিনাকে বেসরকারি মালিকদের লুঠের জায়গা হিসাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এই দেশে ক্যাম্পাস খুলতে অনুমতি দেওয়ার নোটিস ইতিমধ্যেই ইউজিসি জারি করেছে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় শিক্ষানীতিতে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার যে নীল-নক্সা রচিত হয়েছে, ২০২৩-২৪ সালের বাজেট তাকে আইনি রূপ দিতে চাইছে। এই ষড়যন্ত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপদ ডেকে আনবে।