এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট নাকি জনগণের হাতে অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেবে, যা ঝিমিয়ে পড়া অভ্যন্তরীণ বাজারকে চাঙ্গা করে তুলবে। অন্তত বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের তাই বয়ান। কিন্তু সত্যিই কি এই বাজেট বাজার সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে কোনও রকম সাহায্য করবে? দেখা যাক।
কোনও একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কী? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। দেশে ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা যত বেশি হবে অর্থনীতি তত গতিশীল হবে। ভারতীয় অর্থনীতির এখন মূল সমস্যা কী? শিল্প এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদার অভাব। মন্দায় আক্রান্ত বাজার। এর হাত থেকে অর্থনীতির রেহাইয়ের রাস্তা কী? মানুষের চাহিদা তথা পণ্য কেনার ক্ষমতা বাড়ানো। কী উপায়ে তা বাড়তে পারে? মানুষের হাতে পণ্য কেনার মতো ক্ষমতা জুগিয়ে। এই ক্ষমতা কী ভাবে জোগানো সম্ভব? মানুষের রোজগার বাড়িয়ে। মূল্যবৃদ্ধি রোধ করে। জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ— শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সহ অন্যান্য খরচের সীমাকে নামিয়ে এনে। সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো পরোক্ষ করের বোঝা কমিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী সকলেই এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটকে জনগণের জন্য বাজেট বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। সরকার অনুগত প্রচারমাধ্যমগুলি তারস্বরে সে কথাই প্রচার করে চলেছে। বাস্তবটা কি সত্যিই তাই? দেখা যাক, বাজেটে বিজেপি সরকার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিজেপি নেতা-মন্ত্রী এবং প্রচারমাধ্যম সবচেয়ে বেশি হইচই বাধাচ্ছে যা নিয়ে তা হল আয়করে ছাড়। সরকার যে নতুন করনীতি ঘোষণা করেছে তাতে মধ্যবিত্ত অংশের রোজগারে কর কমানো হয়েছে এবং বছরে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে কর পুরোপুরি মকুব করা হয়েছে। ২০২৩-এ ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এ বার তা বাড়িয়ে ১২ লক্ষ টাকা করা হল। এর ফলে অতিরিক্ত ১ কোটি মানুষকে কোনও আয়কর দিতে হবে না।
ভারতে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে আয়কর দেওয়ার মতো রোজগার রয়েছে কতটুকু অংশের মানুষের? মেরেকেটে ১০ কোটির আশেপাশে। এর মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যা কত? ৩.২ কোটি। বাকি প্রায় ৭ কোটি মানুষ যাঁরা আয়কর দেন, তাঁরা উচ্চবিত্ত এবং ধনী। বাজারে কেনাকাটা বাড়াতে আয়কর কমিয়ে মানুষের হাতে অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেওয়ার দাবি অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন শিল্পপতিদের সংগঠনগুলি এবং অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা। সরকার এ বার সে দাবি মানল। কিন্তু সরকারের এই পদক্ষেপে কি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে? মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিল? বাজেটে তেমন কোনও পরিকল্পনার কথা নেই। কর্মসংস্থান তৈরি করে মানুষের রুজি-রোজগার বাড়াতে পারলে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কর্মসংস্থানের কোনও দিশা বাজেটে নেই। সরকারের ভাবনা, করছাড়ের ফলে মানুষের হাতে যে অতিরিক্ত অর্থ আসবে তা বাড়ি-গাড়ি-ভোগ্যপণ্য এবং পরিষেবায় ব্যয় হবে। তার ফলে যে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হবে তা পূরণের জন্য উৎপাদন পরিকাঠামো বাড়ানোর প্রয়োজন হবে এবং তাতেই কর্মসংস্থান ঘটবে। এই দায়িত্বটুকুও বেসরকারি সংস্থাগুলির উপর চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রীর বকলমে অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের প্রশ্নে সরকারের নীতি ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’-এর। যদি মধ্যবিত্ত করছাড়ে উদ্বৃত্ত অর্থ পণ্য ও পরিষেবা কেনায় ব্যয় করে তবে খানিকটা কর্মসংস্থান ঘটবে। এমন কাল্পনিক ভাবনার উপর বেকার সমস্যার মতো গুরুতর সমস্যার সমাধানের কথা ভাবে যে সরকার তারা যে আসলে বাস্তব পরিস্থিতিটাকে স্রেফ চোখ বুজে থেকে অস্বীকার করার মতো হাস্যকর চেষ্টা করছে, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না।
দেখা যাক, মধ্যবিত্তের হাতের এই অতিরিক্ত অর্থটুকুর কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনা কতখানি। মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় খরচ বেড়ে চলেছে মাত্রাছাড়া হারে। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা বেকার। এই অবস্থায় আয়কর ছাড়ে যতটুকু সাশ্রয় হবে তার বড় অংশ মূল্যবৃদ্ধির খাঁই মেটাতেই খরচ হয়ে যাবে। অবশিষ্টটুকুর মধ্যে কতটুকু মানুষ ভোগ্যপণ্যের পিছনে ব্যয় করবে?
মধ্যবিত্তের উপরের বড় একটি অংশের রোজগার যথেষ্ট বেশি। ভোগ্যপণ্যের পিছনে ব্যয়ের জন্য তাঁদের করছাড়ের উপর নির্ভর করার প্রয়োজন হয় না। নানা আর্থিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই অংশের মানুষ হাতে অতিরিক্ত অর্থ এলে তা সঞ্চয় করেন বা শেয়ার কেনেন। অর্থাৎ এই তিন শতাংশের কাছাকাছি মানুষের হাতে কয়েক হাজার টাকা অতিরিক্ত এলে তা দিয়ে যে বাজার চাঙ্গা হয় না, এটা বোঝার ক্ষমতা তাঁদের মাইনে করা আমলা-অর্থনীতিবিদদের অন্তত আছে। তা হলে তারা এটা করল কেন? তার কারণ, একদিকে সামনের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চাকরিজীবী মানুষদের খুশি করে ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা, অন্য দিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই অংশটিকেই তারা যে হেতু জনমত গড়ার কারিগর মনে করে, তাই তাদের তুষ্ট রাখা। তা ছাড়া আর একটি উদ্দেশ্য হল, করছাড়ের দামামা বাজিয়ে সমাজের অন্য বড় অংশের মানুষের বঞ্চনাকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা। কিন্তু যা কঠিন বাস্তব, তাকে কি এই প্রতারণা দিয়ে বিজেপি নেতাদের পক্ষে ঢাকা সম্ভব হবে?
বিজেপি সরকারের এই বাজেট আসলে কাদের পক্ষে তা আরও খানিকটা স্পষ্ট হবে বাজেটের কর্পোরেট সেবার দৃষ্টিভঙ্গিটা খেয়াল করলেই। ২০১৯-এ কর্পোরেট করের হার বিজেপি সরকার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করেছিল ২২ শতাংশ। তখনও সরকারের অজুহাত ছিল এর ফলে সাশ্রয় হওয়া অংশ দিয়ে লগ্নি বাড়াবে তারা। বাস্তবে একই কারণে, অর্থাৎ বাজারে চাহিদা না থাকায় লগ্নি মুনাফা আকারে ফিরে না আসার আশঙ্কা থেকেই তারা লগ্নি করেনি। দীর্ঘ দিন ধরেই এমনকি পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরাও দাবি করছিলেন, জনগণের হাতে আরও অর্থ তুলে দিতে অতিধনীদের উপর সম্পদ কর চাপানো হোক। কিন্তু সরকার সম্পদ কর চাপানো দূরের কথা, কর্পোরেট করের পরিমাণটুকুও বাড়াল না। বরং তা ব্যক্তিগত করদাতাদের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশের থেকে অনেক কমই রেখে দিয়েছে। এর দ্বারা কর্পোরেট মহলকে তুষ্ট রেখে তাদের আশীর্বাদ অব্যাহত রাখার কাজটিই করেছে বিজেপি সরকার।
বাস্তবে দেশের যে বাকি ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষ, যারাই বাজারের সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রেতা, যাদের রোজগার কম, আয়করের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, যাদের হাতে অর্থের পরিমাণ বাড়লেই একমাত্র অর্থনীতি সত্যি সত্যিই চাঙ্গা হতে পারত, তাদের কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই বাজেটে সরকার কোনও পদক্ষেপই করেনি। উপরন্তু করছাড় দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে ১ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব সরকারের কম আয় হচ্ছে, তা এই বঞ্চিত জনগণের ঘাড়ের উপরই চাপিয়েছে সরকার। এই টাকা জোগাড় করতে কেন্দ্রীয় সাহায্যে চলা সরকারি প্রকল্পে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ ছাঁটাই করেছে তারা। রাজ্যগুলির জন্য অর্থ কমিশনের অনুদান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দ যে ছিটেফোঁটাটুকু জুটত সেটুকুও আর মিলবে না।
বেকারত্ব গত ৫০ বছরে সর্বাধিক মাত্রায় পৌঁছেছে। বেকারদের জন্য এই বাজেট কী দিল? কিছুই না। সরকার যতই মাঝারি ও ছোট সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলুক, প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতির বর্তমান সময়ে বড় শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দেওয়া এই সংস্থাগুলির পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এই ধরনের সংস্থাগুলি প্রায়শই মুখ থুবড়ে পড়ছে। অন্য দিকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বিপুল অঙ্কে বাড়লেও এই সংস্থাগুলি একদিকে যেমন নতুন কর্মী নিয়োগের পরিবর্তে কৃত্রিম মেধা এবং রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে, তেমনই এমনকি কর্মীদের সামান্য বেতন বাড়াতেও তারা রাজি হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই বাজেটের লক্ষ্য সরকারের কোষাগার ভরানো নয়, নাগরিকের পকেট ভরানো। সেই নাগরিক কারা প্রধানমন্ত্রীজি? দেশের ৯০ ভাগ মানুষ কি তা হলে সেই নাগরিক নন? তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বাজেটে কোনও পদক্ষেপের কথাই নেই কেন? অথচ এই প্রধানমন্ত্রীই একদিন বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’–সবার পাশে থেকে সবার বিকাশ ঘটানো। এটা কি তিনি তা হলে সে দিন দেশের মানুষকে শুধু ধোঁকা দিতেই বলেছিলেন? সরকারি নীতিতে আর্থিক বৈষম্য আজ আকাশ ছুঁয়েছে। কর্পোরেট মুনাফা গত ১৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। তা সত্তে্বও তাদের উপর ‘করের চাপ’ বাড়াননি প্রধানমন্ত্রী। বাস্তবে একচেটিয়া পুঁজিকে অবাধ লুঠের ব্যবস্থা করে দেওয়ার যে রাস্তায় চলছে মোদি সরকার, তাতে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার রাস্তা নেওয়া ছাড়া তাদের কিছু করার নেই। আমরা মার্ক্সবাদীরা বরাবরই যে কথা বলেছি যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকারগুলি আসলে পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করে। পুঁজিপতিদের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়াই এই সব সরকারগুলির কাজ। তাই জনগণ যখন দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে তখনও পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা আমাদের বক্তব্যের সত্যতাই প্রমাণ করছে।
সরকারি নীতিতে যে ভাবে বৈষম্য বাড়ছে তাতে এই ব্যবস্থার সেবা করে জনগণের কোনও সমস্যারই সমাধান করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে কি এই ধনবৈষম্য সত্যিই দূর করা সম্ভব নয়? সমস্ত বেকারের হাতে কাজ দেওয়া কি সত্যিই অসম্ভব? কোনও উপায়েই কি সমাজের সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে পারে? হ্যাঁ পারে। সমাজতন্ত্র একদিন এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেখিয়েছিল।
সেই ব্যবস্থায় উৎপাদনের উদ্দেশ্য মুষ্টিমেয় মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পরিবর্তে ছিল সমস্ত দেশবাসীর প্রয়োজন মেটানো। তাই সেখানে বাজারসঙ্কট দেখা দেয়নি। সব মানুষের প্রয়োজন মেটাতে বিপুল উৎপাদনের জন্য বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল সেই ব্যবস্থায়। উৎপাদন থেকে কারও মুনাফা লোটার সুযোগ ছিল না, তাই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্কটও সেখানে কোনও দিন দেখা দেয়নি। বর্তমানে কেন্দ্র-রাজ্য সব সরকারই পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়াতে শ্রম-সময় আট ঘণ্টার পরিবর্তে ১০-১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাচ্ছে। সমাজতন্ত্র শ্রম-সময় আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে প্রথমে সাত এবং পরে ছ’ঘণ্টায় নিয়ে গিয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল তা আরও কমিয়ে আনার। অত্যাধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার সেখানে মানুষের কাজ কেড়ে নিত না, বরং কায়িক শ্রম লাঘব করত এবং শ্রম সময় কমিয়ে সেই সময়কে অন্য সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহারের সুযোগ করে দিত। আজ যদি পুঁজিবাদের এই ভয়ঙ্কর বাজারসঙ্কট থেকে রেহাই পেতে হয় তা হলে উৎপাদনকে সর্বোচ্চ মুনাফার ফাঁস থেকে মুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা নেই। বাস্তবে মোদি সরকার কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর নামে বাজেটে যে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সমস্যা কমা দূরের কথা, আরও বাড়তেই থাকবে। কারণ সঙ্কটের কারণটিকে টিকিয়ে রেখে সঙ্কট-মুক্তি ঘটানো যায় না।