কেনিয়ায় গণবিক্ষোভঃ প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব

ব্যারিকেড ভেঙে পার্লামেন্টে ঢুকছেন বিক্ষোভকারীরা

দু’বছর আগের শ্রীলঙ্কার গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি ফিরিয়ে সম্প্রতি উত্তাল জনবিক্ষোভে কেঁপে উঠল কেনিয়া। ২৫ জুন জনরোষের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল পার্লামেন্ট ভবনের একাংশ। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫৩ জন বিক্ষোভকারীর। আহত কয়েকশো। আন্দোলনের চাপে দাবি মানতে বাধ্য হলেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো।

বিক্ষোভের শুরু ‘আর্থিক বিল-২০২৪’-কে কেন্দ্র করে। সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক সংস্থা আইএমএফ-এর শর্ত মেনে বিপুল ঋণ পাওয়ার বিনিময়ে এই বিল পাশ করিয়ে রুটি, চিনি, ভোজ্য তেল, ওষুধ সহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর কর চাপানোর ঘোষণা করেছিল রুটো সরকার। এর বিরুদ্ধেই ফুঁসে ওঠে জনরোষ। গরিবি-বেকারিতে বিপর্যস্ত জনসাধারণের পকেট কেটে সরকারের বড়কর্তাদের বিলাস-ব্যসন, বিপুল আর্থিক বৈষম্য ও ব্যাপক দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ মানুষ নির্মম পুলিশি আক্রমণ উপেক্ষা করে পথে নামে।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরে ঋণের বোঝায় বিপর্যস্ত। বাজেটের একটা বড় অংশ চলে যায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নানা ঋণের সুদ মেটাতে। এই অবস্থায় ত্রাতা সেজে এগিয়ে এসেছে আইএমএফ। এ বছরের শুরুতে বেশ কয়েকটি শর্তের বিনিময়ে আইএমএফ ৯৪ কোটি ১০ লক্ষ ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় রুটো সরকারকে। এই শর্তের অন্যতম হল আর্থিক সংস্কার তথা জনগণের উপর কর চাপানো, যা ‘আর্থিক বিল-২০২৪’-এর মধ্য দিয়ে রূপায়িত করতে চেয়েছিল কেনিয়া সরকার।

প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলিকে লুটে নেওয়ার এ হল সাম্রাজ্যবাদীদের চেনা ছক। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতো সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলি বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই পথেই তাদের খেলা সাজায়। আর্থিক ভাবে বিপর্যস্ত দেশগুলিকে সাহায্য করার নামে প্রথমে তারা ঋণের ঝুলি নিয়ে হাজির হয়, সঙ্গে থাকে কিছু শর্ত। ঋণের বিনিময়ে শর্তের জালে জড়িয়ে যায় ঋণগ্রহীতা দেশগুলি। শর্ত মেনে ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার সমাজকল্যাণমূলক ক্ষেত্রগুলি থেকে হাত গুটিয়ে নিতে থাকে। দেশের সরকারি সংস্থা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার একে একে তুলে দিতে থাকে বেসরকারি মালিকের হাতে। এতে প্ররোচনা থাকে দেশের বৃহৎ পুঁজি গোষ্ঠীগুলিরও। ফলে চলতে থাকে দেশি-বিদেশি পুঁজির দেদার লুঠতরাজ। এরই সঙ্গে ঋণশোধের টাকা জোগাড় করতে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের নির্দেশ অনুযায়ী দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের উপর ক্রমাগত আরও বেশি করে কর চাপাতে থাকে ঋণগ্রহীতা সরকার। সরকারি সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত সাধারণ মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে।

কেনিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছে। ঋণের চাপে জর্জরিত রুটো সরকার আইএমএফ-এর বিপুল দেনা পরিশোধের লক্ষ্যে তাদেরই নির্দেশমতো নতুন আর্থিক বিল এনে বিপুল করের বোঝা চাপাতে চেয়েছিল দেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে, যা সরোষে প্রত্যাখ্যান করেছে কেনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, বিশেষত যুবসমাজ। এমনিতেই আর পাঁচটা পুঁজিবাদী দেশের মতো কেনিয়াতেও আর্থিক বৈষম্য চরমে। গরিবি-বেকারিতে সাধারণ মানুষ জর্জরিত। ২০২২-এ চাপানো করের ধাক্কায় এমনিতেই জিনিসপত্রের চড়া দামে নাভিশ্বাস উঠছে জনসাধারণের। এর উপর নতুন আর্থিক বিল এনে আবার কর চাপানোর সরকারি পরিকল্পনায় তাদের ক্ষোভ সমস্ত সীমা ছাড়িয়েছে।

সমাজমাধ্যমে এই বিলের কথা প্রচারিত হতেই বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে কেনিয়ায়। ১৮ জুন নাইরোবি সহ অন্য শহরগুলিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষের মিছিলে রুটো সরকার ও আইএমএফ-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার স্লোগান ওঠে। বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগের বয়সই ৩০-এর নিচে। যথারীতি হামলা চালায় পুলিশ। গ্রেফতার হয় ৩০০-রও বেশি বিক্ষোভকারী। কিন্তু জলকামান, কাঁদানে গ্যাস চালিয়েও বিক্ষোভ দমাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ।

২০ জুন পার্লামেন্টে ওই বিলের উপর ভোটাভুটির দিনে নাইরোবি, কাকামেগা, নাকুরু, মোম্বাসা ইত্যাদি শহরে শহরে হাজার হাজার তরুণ বিক্ষোভ দেখায়। বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন ২৪ বছরের এক যুবক। এই ঘটনায় আগুনে ঘৃতাহুতি হয়। ২৫ জুন পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক উঠলে বিল বাতিল ও প্রেসিডেন্ট রুটোর পদত্যাগের দাবিতে দেশ জুড়ে সোচ্চার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা কেনিয়া। ব্যারিকেড ভেঙে পার্লামেন্টে ঢুকে পড়ে বিক্ষোভকারীরা, আগুন ধরিয়ে দেয় ভবনের একাংশে। পুলিশ বেপরোয়া হামলা চালায়। নাইরোবি ও তার আশপাশের শহরগুলিতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ৫৩ জন বিক্ষোভকারী, আহত হন শত শত।

গণবিক্ষোভের তীব্রতায় হতভম্ব, আতঙ্কিত প্রেসিডেন্ট রুটো পরদিন ২৬ জুন ঘোষণা করেন, নয়া আর্থিক বিলে তিনি সই করবেন না। ডেপুটি প্রেসিডেন্টও এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে বিক্ষোভকারীদের প্রতি মিনতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি একজন বাবার মতো করে আমার ছেলেমেয়েদের কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে তোমরা বিক্ষোভ কর্মসূচি বন্ধ করার কথা ঘোষণা করো।’’

বোঝা যায় গণবিক্ষোভের তীব্রতায় সরকারের ঘুম ছুটে গেছে। জনসাধারণ জেগে উঠলে হাজারো পুলিশ-মিলিটারি দিয়েও যে শেষরক্ষা করা যায় না, শাসকরা তা জানে। তাই তড়িঘড়ি দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন প্রেসিডেন্ট রুটো। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না বিক্ষোভকারীরা। এই প্রতিবেদন লেখার সময়েও প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।

কোথায় গিয়ে পৌঁছবে এই গণবিক্ষোভ, সময়ই তা বলবে। তবে এ কথা বলা যায় যে, আর্থিক বিল-২০২৪ প্রত্যাহার কিংবা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি আদায় হলেই কেনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান হবে না। বিক্ষোভের চাপে আপাতত কর বসানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হলেও রুটো সরকার যে আইএমএফ-এর বিপুল ঋণের দায় শেষ পর্যন্ত সেই খেটে-খাওয়া মানুষের ঘাড়েই চাপাবেন, তা বোঝা কঠিন নয়। একটি পুঁজিবাদী রাষ্টে্র শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপের বোঝা বইতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকেই। ফলে সঙ্কটের মূলে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্কট থেকে মুক্তির প্রশ্নটিও যে পুঁজিবাদ উচ্ছেদের সঙ্গে জড়িত–এই উপলব্ধির ভিত্তিতে পুঁজিবাদবিরোধী সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে শোষণমূলক এই ব্যবস্থাটিকে বিপ্লবের আঘাতে উচ্ছেদ করতে না পারলে কেনিয়ার সাধারণ মানুষের মুক্তি মিলবে না।

কেনিয়ার সাম্প্রতিক এই জনবিক্ষোভ প্রসঙ্গে দু’ বছর আগের শ্রীলঙ্কার জনঅভ্যুত্থানের কথা বার বার উঠে আসছে। সেখানেও অত্যাচারিত, বিক্ষুব্ধ জনতার স্রোত দখল করে নিয়েছিল প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ। আতঙ্কে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারকে। কিন্তু সেই আন্দোলন উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত হতে পারেনি বলে কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে তা স্তিমিত করে দেয় শ্রীলঙ্কার শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি। ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় আবারও দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণায় পিষ্ট হতে হচ্ছে সেখানকার খেটে-খাওয়া জনসাধারণকে। উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকলে কেনিয়ার এই উত্তাল জনবিক্ষোভেরও একই পরিণতি হবে কি না– সেই আশঙ্কা থেকেই যায়।