পূর্ব প্রকাশিতের পর
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার জন্য আদানি-আম্বানিদের কাছ থেকে যা পেয়েছেন, তা শোধ করতে তিনি তাদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই আইনগুলি পাশ করাতে তিনি সংসদের অধিবেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি, তার আগেই করোনা-জনিত লকডাউনের সুযোগ নিয়ে অর্ডিন্যান্স জারি করে ফেলেছিলেন। সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত তার অপেক্ষা না করার কারণ আজ সহজেই বোঝা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আদানিরা বিশাল বিশাল গুদাম, সাইলো, হিমঘর তৈরি করে ফেলেছে। আসলে তর সইছিল না সেই আদানিদের। তাই তাদের ‘চৌকিদার’ প্রধানমন্ত্রী তাদের নির্দেশ মতো আদেশ পালন করেছেন। এখন অভূতপূর্ব এই কৃষক আন্দোলনের চাপে সরকার দিশাহারা হলেও প্রধানমন্ত্রীর আসল প্রভুরা সেই আইনগুলি বাতিল করার নির্দেশ দিচ্ছেন না– এটাই নরেন্দ্র মোদির সমস্যা।
কৃষকরা আজ শুধু সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, আওয়াজ তুলছে কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধেও
শাসক শ্রেণির স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলগুলি কাজ করতে গিয়ে জনবিরোধী নীতি গ্রহণ করে যখন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে, তখন তাদের প্রচারমাধ্যম আরেকটা বুর্জোয়া দলের পক্ষে প্রচার দিয়ে তাকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করে। কিন্তু শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু এবার কৃষকরা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে বলার সাথে সাথে স্পষ্ট বলছেন মোদিজির সত্যিকারের প্রভু কারা। তাই শুধু সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, আওয়াজ উঠেছে কর্পোরেট পুঁজির মালিক আদানি-আম্বানিদের বিরুদ্ধেও। সাথে সাথে ভগৎ সিং, নেতাজি, চন্দ্রশেখর আজাদ সহ আপসহীন ধারার বিপ্লবীদের কথাও তাঁদের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। উচ্চারিত হচ্ছে তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের অপূরিত স্বপ্নের কথা। নিজেদের জীবনের সংগ্রামের আগুন-ই তো মানুষের অনুভবকে সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল করে তোলে। পূর্বসূরী বিপ্লবীদের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়। একেই তো উন্নত সংস্কৃতি, উন্নত রুচি বলা হয়– যা মানুষকে নুতন মানুষে পরিণত করে ধীরে ধীরে। ঐতিহাসিক এ কৃষক আন্দোলন শুধু আন্দোলনের বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে তাই নয়, দেশের ছাত্র-যুবক-তরুণ প্রজন্মসহ সংগ্রামী মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে নতুন মানুষ হয়ে ওঠার আবেগেরও। যদিও এ কথা সত্য যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্যই যে এই কর্পোরেট পুঁজির উত্থান– সে কথা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের বেশিরভাগের কাছে এখনও সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। কিন্তু সারা দেশের কৃষকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া দানবীয় এই আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে শাসকদের স্বরূপ, তাদের নিষ্ঠুর হিংস্রতা, মিথ্যাচার, পুঁজি-মালিক কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের মরিয়া চেষ্টা তাঁরা নিজের চোখেই দেখছেন। এই মূল্যবান অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধীরে ধীরে সঠিক উপলব্ধি গড়ে ওঠার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শুধু আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষকেও তা বুঝতে সাহায্য করছে।
আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)
এই আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) ও কৃষক সংগঠন এ আই কে কে এম এস পিচমবঙ্গ সহ সারা দেশে এই আন্দোলন সংগঠিত করতে সর্বশক্তি দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ আই কে কে এম এস-এর সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান এবং সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আজ দিল্লির সীমান্তে আন্দোলনকারীদের সাথেই রাজপথে। সারা দেশেই দল এবং কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘কৃষক কমিটি’। আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে জেলায় জেলায় কৃষক ধরনা মঞ্চ, কৃষক আন্দোলন সংহতি মঞ্চ গড়ে তুলে সর্বস্তরের মানুষকে সামিল করা হচ্ছে। সারা দেশেই ২৫ সেপ্টেম্বর ‘গ্রামীণ ভারত বনধ’, ১৪ অক্টোবর ‘কিসান প্রতিরোধ দিবস’, ২৬ নভেম্বর শ্রমিক সংগঠনগুলির আহ্বানে সাধারণ ধর্মঘট এবং ৮ ডিসেম্বর ‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’ আহূত ভারত বনধে আমাদের দল ও কৃষক সংগঠনের কর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। কৃষকদের দিল্লি অভিযান শুরুর দিন কৃষক-কর্মীরা পায়ে পা মিলিয়ে ব্যারিকেডে অংশ নিয়েছে। হরিয়ানার এআইকেকেএমএস রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়করণজি সহ বহু সংগঠককে হরিয়ানা সরকার গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে। মধ্যপ্রদেশ থেকে সংগঠনের ‘কিসান জাঠা’ দিল্লির দিকে যাত্রা শুরু করলে যোগী সরকার উত্তরপ্রদেশের সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে ৬৮ ঘণ্টা আটকে রাখে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের অদম্য মানসিকতার ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার পথ ছাড়তে বাধ্য হয়। ৮ ডিসেম্বর সারা ভারত বনধ ভাঙতেও বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি কোনও অপচেষ্টাই বাদ রাখেনি। সারা গুজরাট জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। উত্তরপ্রদেশের বদলাপুর দলীয় অফিসে পুলিশ হামলা চালিয়েছে, জৌনপুর জেলা সম্পাদক কমরেড রবিশঙ্কর মৌর্যকে গ্রেফতার করেছে, অনেককেই গৃহবন্দি করেছে। অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সম্পাদক কমরেড অমরনাথকে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার গ্রেফতার করেছে, ওড়িশার কটকে ৪৫ জন এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) কর্মী সহ ৫৫ জন বামকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার সহ অন্যান্য অ-বিজেপি সরকারগুলিও, আন্দোলনের প্রতি প্রবল জনসমর্থন দেখে মৌখিক সমর্থন করতে বাধ্য হলেও ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু কোনও কিছুই সর্বাত্মক ধর্মঘটের স্বতঃস্ফূর্ততাকে আটকাতে পারেনি।
দিল্লির বুকে সংগঠিত এই কৃষক আন্দোলনের জোয়ার সারা দেশে লড়াইয়ের নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। আজ শুধু পুরুষ কৃষকরাই নন, আন্দোলনে সামিল হয়েছেন অসংখ্য মহিলা। সঙ্গে এনেছেন তাঁদের শিশুসন্তানদেরও। সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষ শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরাও আন্দোলনের সমর্থনে সোচ্চার হয়েছেন। বিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ সহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্ধত আচরণের প্রতিবাদে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সরকারি পদক খেতাব ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করছেন এবং অনেকে প্রাপ্ত পদক খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও, যুব সংগঠন এআইডিওয়াইও, মহিলা সংগঠন এআইএমএসএস, শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি সহ দেশের বিভিন্ন ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক সংগঠন সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও আজ আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দিল্লির চারপাশে অবস্থানরত কৃষকদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন দলের মেডিকেল ফ্রন্টের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সহ ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠনও।
এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সংহতি ও সমর্থন জানিয়ে আমাদের দল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, একে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হবে এবং সর্বত্র গড়ে তুলতে হবে ‘ভলান্টিয়ার বাহিনী’। তারই ভিত্তিতে আমরা পশ্চিমবাংলার সমস্ত জেলায় অসংখ্য কৃষক আন্দোলন সংহতি ধরনা মঞ্চ সংগঠিত করেছি। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মোর্চা যেসব আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করছে সেগুলিকে সর্বত্র পালন করছে কৃষক কমিটি এবং ধরনা মঞ্চ কমিটিগুলি। দেশব্যাপী পালিত হয়েছে কৃষক আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিবস, শহিদ দিবস, কৃষক সংহতি শপথ দিবস প্রভৃতি। এই কর্মসূচিগুলিতে সাধারণ মানুষ ব্যাপক সংখ্যায় সামিল হয়েছেন এবং আরও হাজারে-হাজারে সামিল হবেন।
আমরা মনে করি চাষিদের দাবি আদায় নির্বাচনের পথে হবে না। তাই এই আন্দোলনকে নির্বাচনের স্বার্থে আন্দোলনের মহড়া হিসাবে দেখা অত্যন্ত অন্যায় হবে এবং তা হবে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কিছু রাজনৈতিক দল সেই চেষ্টাই করে চলেছে। আজ প্রয়োজন হল, বামপন্থী ও যথার্থ গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে সঠিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করা, যাতে মোদি সরকার দাবি মানতে বাধ্য হয়।
তাই আমরা বামপন্থী দলগুলিকে আবেদন করব, সংযুক্ত কিষান আন্দোলনের পরিপূরক শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তুলে এই লড়াইকে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ে পরিণত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য আমরা সকল অংশের মানুষের কাছেও আহ্বান জানাচ্ছি। তবেই এই মহতী আন্দোলনে রাজপথে ওঠা আওয়াজ সফল হবে– ‘আমরা লড়ব, আমরা জিতব’। (শেষ)