সামনের বছর লোকসভা নির্বাচন৷ গত চার বছরে দেশের মানুষকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী৷ পূরণ করেননি কিছুই৷ নতুন কোনও প্রতিশ্রুতি তাই এখন আর দাগ কাটে না মানুষের মনে৷ জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তীব্র শোষণ–বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে মানুষের বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে৷ কৃষকরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নানা শোষণ–বঞ্চনার বিরুদ্ধে৷ সেই আন্দোলনে বারবার লাঠি–গুলি চালিয়েছে সরকার৷ এখন হঠাৎ নিজেদের কৃষক দরদি প্রমাণ করতে বিজেপি সরকার ধান গম সহ ১৪টি শস্যের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করল৷
ধানের মূল্য কুইন্টাল পিছু ২০০ টাকা বৃদ্ধি ঘোষণা করা হয়েছে৷ ফলে সহায়ক মূল্য দাঁড়াল ১৭৫০ টাকা প্রতি কুইন্টাল৷ মাত্র ১৩ শতাংশ বেশি৷ স্বাভাবিক ভাবেই কৃষকরা এই বৃদ্ধিকে সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা বলে মানতে নারাজ৷ বিজেপি সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, তারা ডঃ স্বামীনাথনের সুপারিশ মেনে চাষির মোট খরচের ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করবে৷ স্বামীনাথন বলেছিলেন, এই ক্ষেত্রে চাষের যাবতীয় খরচকে ধরতে হবে৷ যার মধ্যে পড়ে অন্যান্য সমস্ত খরচের সাথে পারিবরিক শ্রম, জমির লিজ এবং ঋণ নেওয়ার খরচও৷ অথচ সরকার এগুলিকে হিসাবের মধ্যে ধরলই না৷
সরকার সহায়ক মূল্যে যে পরিমাণ চাল–গম কেনে তা মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশের বেশি নয়৷ জোয়ার, বাজরা, রাগি, মুগ ডাল প্রভৃতির ক্ষেত্রে এই বর্ধিত মূল্য ঘোষণা করলেও এবং তার পরিমাণ বেশ খানিকটা বেশি হলেও সরকার এগুলি প্রায় কেনে না বললেই চলে৷ এগুলির ক্ষেত্রে বৃদ্ধির এই ঘোষণা তাই নিছক কাগুজে এবং নির্বাচনী চমক ছাড়া আর কিছু নয়৷ ফসলের বেশিরভাগ অংশই চাষিদের বিক্রি করতে হয় খোলা বাজারে৷ সেখানে সরকার নয়, দাম নিয়ন্ত্রণ করে ফড়ে এবং ব্যবসায়ীরা৷
পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা কংগ্রেস–বিজেপির সরকারগুলি উদারনীতির নামে কৃষিক্ষেত্রকে বৃহৎ পুঁজির মুনাফার ক্ষেত্র হিসাবে খুলে দিয়েছে৷ তার কল্যাণে গত কয়েক দশকে চাষের খরচ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷ বীজ চলে গেছে চাষির হাতের বাইরে৷ বীজ সার কীটনাশক সবই দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণে৷ তাদের অতি মুনাফার খাঁই মেটাতে এ–সবের দাম আকাশছোঁয়া৷ খরচ জোগাতে চাষিদের ঋণ করতেই হয়৷ ব্যাঙ্ক এবং সমবায়গুলির নানা জটিলতার কারণে বহু ক্ষুদ্র চাষি চড়া সুদে ব্যক্তিগত ঋণ নিতে বাধ্য হয়৷ ফসল ওঠার পরই ঋণ শোধ করা এবং সংসার চালানোর জন্য চাষিদের বিক্রির তাড়া থাকে৷ অথচ সরকার সহায়ক মূল্যে যতটুকু ফসল কেনে তা–ও কিনতে নামে অনেক দেরি করে৷ এর সুযোগ নেয় ফড়ে এবং ব্যবসায়ীরা৷ তারা তখন ফসল কেনা কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম ভাবে দাম কমিয়ে রাখে৷ চাষিদের বাধ্য করে কম দামে ফসল বেচতে৷ সরকার এই অভাবী বিক্রি রোধ করতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কোনও সরকারই চাষিদের এই অভাবী বিক্রি রোধে কার্যকরী কোনও ব্যবস্থা নেয়নি৷ ফলে বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা যতই এই সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক বলে নিজেদের পিঠ নিজেরা চাপড়ান তাতে চাষির কোনও লাভ নেই৷
স্বামীনাথন সুপারিশ করেছিলেন ২০০৬ সালে৷ কংগ্রেস সরকার ২০১৩ সালে বাড়িয়েছিল মাত্র ১৭০ টাকা৷ বিজেপি গত চার বছরে ভিক্ষের দানের মতো বাড়িয়েছে মাত্র ৪০–৮০ টাকা৷ অথচ চাষের খরচ বেড়েছে বিপুল পরিমাণে৷ এর থেকে কি প্রমাণ হয় না, চাষিদের লাভজনক দাম পাওয়া নিয়ে কংগ্রেস কিংবা বিজেপি– কোনও সরকারেরই কোনও উদ্বেগ নেই? বাস্তবে চাষিদের সত্যিই লাভজনক দাম দিতে চাইলে এমন হিসেবের কারচুপি না করে চাষের সমস্ত খরচকে হিসেবে ধরে তার থেকে যথার্থই ৫০ শতাংশ বেশি ধরে সরকার সহায়ক মূল্য ঘোষণা করত এবং খোলা বাজারেও চাষিরা যাতে সেই দাম পায় তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করত৷ কিন্তু কোনও সরকারই এই ব্যবস্থা করল না৷ কেন করল না? তার কারণ, এই দল তথা সরকারগুলি মুখে যতই কৃষক দরদের কথা বলুক, বাস্তবে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা নয়, তাদের আসল উদ্দেশ্য কৃষিপণ্যের বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের স্বার্থই রক্ষা করা৷ তাই যে সরকার ধনকুবেরদের মুনাফা বৃদ্ধির হার ঠিক রাখতে প্রতিদিন পেট্রল–ডিজেলের দাম বাড়ায়, তারাই ফসলের সহায়ক মূল্য বাড়াতে কুণ্ঠিত৷
সরকার যদি সত্যিই চাষিদের স্বার্থ দেখতে চাইত তবে প্রথমেই দেখত যাতে চাষের খরচ কমানো যায়৷ তা কিছুতেই সম্ভব নয় সার বীজ কীটনাশক ট্রাক্টর সহ কৃষিসরঞ্জাম প্রভৃতি কৃষির অত্যাবশ্যক উপকরণগুলি বহুজাতিকদের হাতে ছেড়ে রেখে৷ দরকার ছিল এগুলি নিয়ে মুনাফা নিষিদ্ধ করে এগুলির উৎপাদন সরকারের নিজের হাতে রাখা৷ সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি দরকার ছিল৷ বেশির ভাগ চাষিকেই ডিপ টিউবওয়েল মালিকদের থেকে চড়া দামে জল কিনতে হয়৷ দীর্ঘদিন ধরে সরকার সেচ ব্যবস্থার উন্নতির দিকে কোনও নজরই দেয়নি৷ এ সব কোনও কিছু না করে হঠাৎ একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে সামান্য কিছু সহায়ক মূল্যের বৃদ্ধি ঘোষণা করে দিলেই যদি কৃষকের জটিল এবং স্থায়ী সব সমস্যাগুলির সমাধান হয়ে যেত তবে তা অনেক আগেই হয়ে যেত৷ আসলে কৃষক জীবনের সমস্যার সমাধান করা সরকারের উদ্দেশ্য নয়৷ এ বছরের শেষে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন৷ সামনের বছর লোকসভা নির্বাচন৷ বিজেপি জানে দেশজুড়ে কৃষকদের মনে বঞ্চনার ক্ষোভ বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে৷ নির্বাচনে গদি টলে যেতে পারে৷ তাই সেই ক্ষোভে জল ঢালতেই এই নতুন ‘জুমলা’ তথা প্রতারণার আশ্রয়৷
(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)