কৃষক নেতা কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডলের জীবনাবসান

এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি এবং বারুইপুর সাংগঠনিক জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর প্রবীণ সদস্য, বিশিষ্ট কৃষক নেতা কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল ১৯ এপ্রিল ৭৮ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি রিউমাটায়েড আর্থারাইটিস সহ নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালের আইটিইউতে ভর্তি করতে হয়। তাঁর নিউমোনিয়া এবং নিউট্রোপেনিক সেপসিস রোগ ধরা পড়ে। হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার টিমের খ্যাতনামা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলে। সর্বোচ্চ চিকিৎসা সত্ত্বেও অবস্থা খুবই সংকটজনক হয়ে মাল্টি অরগ্যান ফেলিওর শুরু হয়। ১৯ এপ্রিল সকালে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। ওই দিন বেলা তিনটে পঁচিশ মিনিটে কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাইশহাটা, গড়দেওয়ান, বেলে দুর্গানগর, মণিরতট ইত্যাদি এলাকায় দলের প্রতিষ্ঠা পর্বের প্রথম দিকে জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক ও খেতমজুরদের সংগঠিত করে যে তীব্র ও কঠিন সংগ্রাম মাথা তুলেছিল তাতে প্রয়াত কমরেডের ভূমিকা ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক। প্রকৃতপক্ষে কমরেড মজিবর লস্কর, মনিরুজ্জামান গাজি এই এলাকার গরিব মানুষের কাছে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস শুরু করার অব্যবহিত পরে প্রবাদপ্রতিম কৃষক নেতা কমরেড আমির আলি হালদারের বিশিষ্ট নেতৃত্বকারী ভূমিকায় এই আন্দোলন অধিকতর ব্যাপকতার সাথে বিস্তৃতি লাভ করে। কমরেড হালদারের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, গরিবদরদি মন ও দৃঢ়চিত্ততার আকর্ষণে যাঁরা তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা ছিলেন কমরেডস মোকসেদ খান, তাজিম সরদার, রব্বানি খাঁ, অশ্বিনী মণ্ডল প্রমুখ সহ কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল। এঁদের মধ্যে কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল ছিলেন বয়ঃকনিষ্ঠ। কিন্তু ওই বয়স্ক সহযোগীরা বলেছিলেন, ‘কী ভাবে প্রফুল্ল আমাদের নেতা হয়ে গেল তা আমরা বুঝতে পারিনি। সে আমাদের খুব সম্মান করত, ভালবাসত। আমরাও তাকে ভালবাসতাম’। ছাত্র অবস্থায় ১৯৬২ সাল নাগাদ তিনি দলে যোগ দেন। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এভাবে বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ায় অভিভাবকরা খুবই রুষ্ট হয়েছিলেন। ফলে তিনি দীর্ঘ দিন ঘর বাড়ি ছেড়ে কমরেড রব্বানি খানের বাড়ি সহ অন্য বহু পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল অবশেষে নিজের অভিভাবকদেরও জয় করতে সক্ষম হন এবং তাঁদের দলের অনুরাগীতে পরিণত করেন।

অত্যন্ত সরলমনা, সদা হাসিখুশি, দরদি ব্যবহার ও দায়িত্বশীলতা, যে কোনও মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা, দলের যে কোনও বিপদের মুহূর্তে ধীর-স্থির অবস্থান– এই ছিল তাঁর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। সততা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুণ। দলের কাছ থেকে প্রয়োজনেও অর্থসাহায্য নেওয়ার মনোভাব তাঁর ছিল না, বরং জমি বিক্রি করে এসব প্রয়োজন মেটাতেন। শেষ কয়েক বছর তিনি কানে প্রায় একদমই শুনতে পেতেন না। শ্রবণযন্ত্র দলের তরফ থেকে কিনে দেওয়ার প্রস্তাবেও তিনি না করেন। এমনকি এই শেষ চিকিৎসার সময় দলের খরচ হবে বলে চিকিৎসা করাতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্বের নির্দেশকে তিনি মান্যতা দেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। দল সাধ্যমতো তাঁর সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কমরেডদের নিকটজন বা আত্মীয়-স্বজনদের রাজনীতিগত বা সংস্কৃতিগত বিচ্যুতি দেখলে খুবই ব্যথা পেতেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অটুট ছিল।

জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার ফলে রাজ্যের বা কেন্দ্রের পূর্বতন ও বর্তমান শাসক দলগুলি, তাদের আশ্রিত গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ ষড়যন্তে্র জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠায় তাঁকে নেতৃত্বের পরামর্শে বারবার আত্মগোপন করে থাকতে হত। মিথ্যা মামলায় বারবার তাঁকে ফাঁসানো হয়। যারা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা করেছে, কুৎসিত ব্যবহার করেছে, তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে, এমনকি কোনও কারণে দলের কমরেডরা তাঁকে ভুল বুঝলেও তিনি তাদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। পরবর্তী সময়ে তাঁদের অনেককেই জয় করেছেন, দলের অনুগামীতে পরিণত করেছেন।

দলের প্রতি তথা নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। নেতাদের বিরুদ্ধে ভুল বুঝে কেউ কিছু বললে তিনি তাদের দলের সঠিক রীতিনীতি ধরিয়ে দিতেন। কোনও কর্মীর সমালোচনা কেউ তাঁর কাছে করলে তিনি দলের শিক্ষা অনুযায়ী সেই কর্মীর গুণের দিকগুলো তুলে ধরতেন। এলাকার বিশিষ্ট নেতাদের কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল হচ্ছে মনে হলে তিনি জেলা সম্পাদক কমরেড ইয়াকুব পৈলানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন এবং ওই ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতি কী হবে তা বুঝে নিয়ে সেই নেতাদেরও ভুল সংশোধনে সফল ভূমিকা পালন করতে পারতেন। এমন উন্নত মনের মানুষ ছিলেন কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল।

চৌভাঙির ঘটনার পর পুলিশ এসইউসিআই(সি) কর্মীদের নির্বিশেষে গ্রেপ্তার করে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করছিল। এর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে প্রশাসন দলের পক্ষে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে। সে সময় কর্মীদের গ্রেফতার থেকে বাঁচাতে দল কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কমরেডকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলে। এর ফলে নির্বিচার গ্রেফতার বন্ধ হয়। দল যাদের নির্দেশ দিয়েছিল তাঁদের অন্যতম ছিলেন কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল। তিনি আত্মসমর্পণ করতে আসার পথে চার-চার বার দলের স্থানীয় কমরেডরা তাঁর পথ আটকান। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, ‘নেতৃত্বের নির্দেশকে অবশ্যই খুশি মনে মানতে হবে’। শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করার পর জেলবন্দি জীবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এ প্রসঙ্গ কেউ তুললে তিনি সর্বদা হাসিমুখে বলতেন, ‘বিপ্লবী দলের কর্মকাণ্ড না বুঝলে তোমাদের এই আক্ষেপ থেকে যাবে’। তাঁদের বলতেন, ‘পুঁজিবাদের সাথে, মালিক শ্রেণির রাজনীতির সাথে আপস কোরো না। দল যে মহৎ উদ্দেশ্যে সব সময় সর্বস্তরের শোষিত মানুষের স্বার্থে আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে তাকে সফল করতে তোমরা উদ্যোগ নিও’। বলতেন, ‘দেখতেই পাচ্ছ, শোষক শ্রেণির স্বার্থবাহী দলগুলোর এত অনাচার-অত্যাচার সত্তে্বও জেলায়-জেলায়, রাজ্যে-রাজ্যে দলের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে। দল বাড়বেই, ভয় পেয়ো না, কাজ করে যাও’। তাঁর এই আচরণ থেকে বোঝা যায় যে, এ ঘটনা তাঁর মনে এতটুকু ক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারেনি। বোঝা যায় বিপ্লবী আদর্শের প্রতি তাঁর আনুগত্য কত গভীর ছিল।

দলে যোগদানের পর থেকে তিনি আদর্শগত চর্চার উপর সবসময় জোর দিতেন। তিনি কর্মীদের নিয়ে পত্রপত্রিকা বিক্রি ও পড়ার ক্ষেত্রে নানা সময় উদ্যোগ নিতেন। গণদাবী পত্রিকা মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া, গ্রাহক করানোর ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। পার্টির মাসিক চাঁদা নিয়মিত দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কখনওই ভুল করতেন না। ঘাটশিলার মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা চর্চা কেন্দ্রের জন্য দেয় মাসিক দানও নিয়মিত দিতেন। এসইউসিআই(সি)র মতো বিপ্লবী দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সব সময়ই অর্থ সংগ্রহ করে চলতে হয়। সারা জীবন তিনি এ কাজে কখনও বিরক্ত না হয়ে উৎসাহের সাথে কর্মীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ নিয়ে দল পরিচালনা করতেন।

দলের যে কমরেডরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে বন্দি ছিলেন তাঁদের এবং অন্যান্য বন্দিদের সাথে নিয়ে জেলে বসেই আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। ২৪ এপ্রিল, ৫ আগস্ট পালন সহ মহান নেতাদের স্মরণ দিবস, নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন ধারার বীর বিপ্লবীদের স্মরণে নানা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। জেলবন্দি থাকা অবস্থায় তাঁদের মধ্যে যে উন্নত রুচি-সংস্কৃতির ছাপ পদস্থ আমলারাও লক্ষ করেছিলেন, তাতে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। অনেক বন্দিকে তাঁরা দলের অনুরাগীতে পরিণত করেন। জেলের মধ্যে গণদাবীর গ্রাহক করিয়েছিলেন।

তিনি মূলত কৃষক আন্দোলনের নেতা ছিলেন। কয়েক বছর সমগ্র দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার তৎকালীন কৃষক ও খেতমজুর ফেডারেশন, অধুনা যা এ আই কে কে এম এস, তার সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাসন্তী এলাকায় বিশেষত ঝড়খালিতে দলের সংগঠন গড়ে তোলায় তাঁর অবদান যথেষ্ট। তিনি ছাত্রদের সংগঠন এ আই ডি এস ও, যুবদের সংগঠন এ আই ডি ওয়াই ও, মহিলাদের সংগঠন এ আই এম এস এস, বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্যোগী ছিলেন। দলে যোগদানের পর থেকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে রাজ্য-জেলা-লোকাল স্তরের প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল একনিষ্ঠ কর্মীর মতো। ঝড়ে-ঝঞ্ঝায়-মহামারিতে, নদী ভাঙনের বিপর্যয়ের মুহূর্তে, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে তিনি যেমন ছিলেন সংগঠক, তেমনই আর্তদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ ও বণ্টনে ছিলেন অগ্রণী।

তাঁর মৃত্যুতে গরিব খেটে খাওয়া মানুষ হারাল তাদের এক অত্যন্ত প্রিয়জনকে, দল হারাল এক বলিষ্ঠ নেতাকে।

কমরেড প্রফুল্ল মণ্ডল লাল সেলাম