মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ভারতের একমাত্র বিপ্লবী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে আমি ‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’-র ডাকা ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধকে সফল করার জন্য দেশের মেহনতি মানুষ, কৃষক, মজুর, কর্মচারী, ছাত্র-যুবক, বুদ্ধিজীবী সহ সমস্ত সাধারণ মানুষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আপনারা জানেন, এই বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন পাঞ্জাবেই প্রথম সংগঠিত হয়। অবিভক্ত পাঞ্জাব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটা গৌরবজনক স্থান দখল করে আছে– যেখানে বিপ্লবী ‘গদর পার্টি’ গঠন হয়েছিল। পাঞ্জাব স্বাধীনতা আন্দোলনে কর্তার সিং সরাভা, উধম সিং এবং শহিদ-ই-আজম ভগৎ সিং-এর মতো বহু সাহসী যোদ্ধা ও শহিদের জন্ম দিয়েছে।
এই মহান সংগ্রামী যোদ্ধাদের শিক্ষা হৃদয়েবহন করে শুরুতে পাঞ্জাবের কৃষকরা এই সংগ্রামে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো জ্বলে ওঠে এবং মুহূর্তের মধ্যেই তা হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনতিবিলম্বে দুর্নিবার প্রবল জোয়ারের গতিতে তা অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে ও তা সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক জনসমর্থন পায়।
আগেকার কংগ্রেস সরকারের মতোই বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারও একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক সেবাদাসের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এই আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য তারা বিভিন্ন হীন পন্থা প্রয়োগ করে যাচ্ছে, কিন্তু কৃষকরা তাদের প্রতিটি অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে অসীম সাহসিকতার সাথে এগিয়ে চলেছে। সংগ্রামী কৃষকরা স্লোগান তুলছে ‘আমরা লড়ব, আমরা জিতবই’। এই আন্দোলন কেবলমাত্র বীরত্বপূর্ণই নয়, এটা একটা ঐতিহাসিক এবং অভূতপূর্ব সংগ্রাম। কৃষকরা একদিকে পুলিশি অত্যাচার, জল-কামান, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জের মোকাবিলা করেছে, অপরদিকে হাড়কাঁপানো শীত, ঘন কুয়াশা, প্রচণ্ড দাবদাহ, প্রবল বৃষ্টির বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হচ্ছে। এমন একটা দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ কৃষক– বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, মহিলা, পুরুষ, শিশু-কোলে মায়েরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করছে, যে দেশের শাসকশ্রেণি এবং সরকারি দলগুলি জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ ও সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ এবং সংঘর্ষের আগুন জ্বালিয়ে আন্দোলনকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তাকে ভিত্তি করে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করছে। কিন্তু সংগ্রামী কৃষকদের এই লড়াইয়ে তাদের আলাদা কোনও পরিচয় নেই; তাদের একমাত্র পরিচয় তারা একচেটিয়া পুঁজি ও তার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সেবাদাস বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক। গত দশ মাস ধরে চলতে থাকা কৃষকদের এই আন্দোলন ভারতবর্ষ ইতিপূর্বে কোনও দিন প্রত্যক্ষ করেনি। যদি আমি ভুল না হই, আমার ধারণা, এই আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসেও অতুলনীয়। এই সংগ্রাম হচ্ছে একটা দীর্ঘ ও কঠিন লড়াই, এটা জীবন-মরণের লড়াই, যা প্রচণ্ড অধ্যবসায়, ধৈর্য, ঐক্য, অদম্য উদ্দীপনা ও সাহস এবং বীরত্বে এগিয়ে চলেছে।
বিজেপি সরকার আন্দোলনকে নানা ভাবে দমন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এগারো বার আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে সরকার যে বৈঠকে বসে, তা ছিল বাস্তবে আলোচনার নামে প্রহসন। এতে সরকারের পরিকল্পনা ছিল যাতে কৃষকরা হতাশাগ্রস্ত হয় এবং আন্দোলন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। এরপর তারা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় যাতে আন্দোলনকে আইনের জালে জড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কোর্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অবশেষে সরকার কৃষি আইনকে দেড় বছরের জন্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব দেয় যাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করানো যায়। আমাদের কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস এবং সংযুক্ত কিসান মোর্চা (এসকেএম) এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আন্দোলন এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।
অতীতে আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা বিশিষ্ট নেতাদের নেতৃত্বে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলনে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, কোনও রাজনৈতিক দল বা কোনও বিশিষ্ট নেতার নেতৃত্বে এই আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, জনগণের মনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্রোধ ও বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার এ আন্দোলন দমনে কঠোর এবং অনড়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতীতে কংগ্রেস পরিচালিত সরকারও বহুজাতিক সংস্থা ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে একই আচরণ করেছে। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছে যে তারাই কংগ্রেস সরকারের তুলনায় একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থার সেবা করতে সবচেয়ে উপযুক্ত, দক্ষ ও সব থেকে হিংস্র। বস্তুত, পুঁজিপতিদের অর্থবল, পেশিশক্তি, প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসনিক ক্ষমতার আশীর্বাদেই বিজেপি মসনদে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
বিজেপি সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থে এই তিনটি কালা কৃষি আইন এবং বিদ্যুৎ বিল (সংশোধনী)-২০২১ প্রণয়ন করেছে। এই আইনগুলো শুধুমাত্র বিশেষ কোনও এলাকার কৃষক স্বার্থবিরোধীই নয়, সারা দেশেরই কৃষক সম্প্রদায়ের স্বার্থবিরোধী। উপরন্তু এটা দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী।
মার্কসবাদী হিসাবে আমরা জানি, পুঁজিবাদ তার অগ্রগতির পথে একচেটিয়া পুঁজি এবং বহুজাতিকের জন্ম দিয়েছে। এই একচেটিয়া পুঁজিবাদ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের সম্মুখীন, যে সঙ্কট স্থায়ী এক গভীর মন্দায় নিমজ্জিত। ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিও এই অনতিক্রম্য সঙ্কটে ডুবছে। মৌলিক শিল্প এবং উৎপাদন শিল্প ভয়াবহ বাজার সংকটের সম্মুখীন। বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, বিভিন্ন সংস্থায় উৎপাদন সংকুচিত করা হচ্ছে এবং নির্বিচারে যথেচ্ছ শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। স্থায়ী চাকরি বলতে যা বোঝায় তা প্রায় বিলুপ্ত, তার বদলে চুক্তিভিত্তিক কাজ এবং আউটসোর্সিং ও অফসোরিং (কাজের খোঁজে বিদেশে যাওয়া) ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। শ্রম আইনগুলো প্রকৃতপক্ষে এখন মালিক পক্ষের আইনে পরিণত করা হয়েছে। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস করায় তার নিজস্ব বাজার আজ সংকুচিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সেই কারণেই কৃষি ক্ষেত্রে তাদের পুঁজি নিয়োগ করা অধিক প্রয়োজন। তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে কৃষি উৎপাদন, কৃষিপণ্যের বাজার ও কৃষিজমি গ্রাস করতে চলেছে। আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ কৃষক ইতিমধ্যেই জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে এবং এর ফলে আরও হবে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বলছে ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে ৪ লক্ষ ৪২ হাজার ৪৮০ জন কৃষক ঋণের জালে জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছে। একচেটিয়া পুঁজি এখন সবরকম নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কৃষি উৎপাদন এমনকী খুচরো ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোও গ্রাস করতে চাইছে। বিজেপি সরকার বিভিন্ন রকম উপায়ে একচেটিয়া পুঁজি ও বহুজাতিক সংস্থার কাঙ্খিত সর্বোচ্চ মুনাফার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। যার ফলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দরিদ্র ও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি যে ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা প্রাক অতিমারির হিসাব অনুযায়ী ৯.৯ কোটি থেকে কমে ৬.৬ কোটি হয়েছে। ভাবুন আপনারা! এই অল্প সময়ের মধ্যেই ৩ কোটি মধ্যবিত্ত মানুষ সর্বহারা ও আধা সর্বহারাতে পরিণত হয়েছে।
এই আন্দোলনে ছোট-বড় কৃষক এবং কৃষি শ্রমিক সহ সর্বস্তরের কৃষক ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। শ্রমিক, মহিলা, ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকরা তাদের সাথে সামিল হয়েছেন। প্রত্যেকে এই সার্বজনীন সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ। এটা শুধু চাষিদের আন্দোলন নয়। আমাদের প্রত্যেকের খাদ্য প্রয়োজন। যদি কৃষিজমি ও কৃষিবাজার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায় তা হলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে? তারাই জিনিসপত্রের দাম ঠিক করবে এবং সব কিছুর় দাম আরও ঊর্ধ্বগামী হবে। ১৩৬ কোটি মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যাবে। তাই এই আন্দোলন দেশের প্রত্যেকটি মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই।
প্রথমত, এই আন্দোলন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ বা তার সংলগ্ন এলাকাগুলোরই শুধু নয়। এই আইন যদি বলবৎ হয়ে যায়, যদি প্রত্যাহার করা না হয় তা হলে দেশের সকল কৃষকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই আন্দোলন দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষের আন্দোলন।
ইতিমধ্যে সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্র যেমন– রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, রেল, বিমা, সড়ক, বিমান ও জাহাজ বন্দর, ইস্পাত শিল্প ইত্যাদি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অধিক মুনাফা ও লালসা পূরণের স্বার্থে বেসরকারিকরণ করেছে। একচেটিয়া পুঁজি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলি এখন গড় মুনাফায় সন্তুষ্ট নয়, তাদের প্রয়োজন সর্বোচ্চ মুনাফা। বর্তমানে এটাই একচেটিয়া পুঁজিবাদের নিয়ম। সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থেই তারা সর্বাধিক শ্রমিক শোষণ চালাচ্ছে। ব্যাপকভাবে ছাঁটাই, বেকারি বাড়ছে, ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প আর কোনও পথ জনসাধারণের সামনে নেই। বর্তমান আন্দোলন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
এই আন্দোলনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা সকলের শিক্ষণীয়। ভারতবর্ষে অতীতের বিভিন্ন গণআন্দোলনে জনগণ তাদের শত্রু হিসাবে দেখেছে শুধুই সরকারকে। কিন্তু বর্তমান এই আন্দোলনে কৃষকরা স্লোগান তুলেছে একচেটিয়া পুঁজি ও বহুজাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে। তাদের কাছে দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির সেবাদাস ছাড়া নরেন্দ্র মোদি আর কিছুই নয়। মোদি সরকার তাদের শত্রু হলেও আসল শত্রু যে পর্দার আড়ালে একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলি– আন্দোলনের এই উপলব্ধি অনন্য। নিঃসন্দেহে প্রকৃত শত্রু সম্পর্কে এটা যথার্থ উন্নত স্তরের উপলব্ধি। বেশ কয়েক বছর আগে আমরা দেখেছি আমেরিকায় ৭ মাসব্যাপী ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন। যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল শিক্ষিত জনসাধারণ, বেকার যুবক, ছাঁটাই শ্রমিক, ছাত্র-যুব-মহিলারা। কিন্তু এই কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা, যাদের ভাবা হয় অশিক্ষিত, অলস, জড়োসড়ো, অসহায়, রাজনৈতিক অসচেতন, অসংগঠিত, তারা কিন্তু এই আন্দোলনে নিজেদের ক্ষমতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এটাও এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
এই অসংগঠিত কৃষকরাই আজ সংগঠিত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতিমধ্যে ৬০০-র বেশি কৃষক এই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন এবং আরও প্রাণ দিতে তাঁরা প্রস্তুত। সাধারণত আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মানুষ প্রাণ হারায়, কিন্তু প্রবল শৈত্য প্রবাহে, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে, বর্ষায়, রোগগ্রস্ত হয়ে মারা গেছেন অনেকে, তবুও আন্দোলনের ময়দান ছেড়ে তাঁরা কেউ যাননি। চোখের সামনে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের এই অটুট মনোবল এক অভূতপূর্ব ঘটনা, আগামী দিনে বিশ্বব্যাপী গণআন্দোলনে যা প্রেরণা জোগাবে।
‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’-র নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে শুরুর দিন থেকেই আমাদের পার্টি সমস্ত শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষমতা নিয়ে সামিল হয়েছে। আমাদের কৃষক সংগঠন এ আই কে কে এম এস সহ ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনের কর্মীরা এবং মেডিকেল ইউনিটের চিকিৎসকরা পূর্ণশক্তি, আবেগ ও সামর্থ্য দিয়ে এই আন্দোলনে নিয়োজিত আছে। আমরা কোনও নির্বাচনী স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, আন্দোলনকে শক্তিশালী করা ও জয়যুক্ত করার জন্যই এই সংগ্রামে আছি। সমস্ত রকম অন্যায়, অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও লড়াই করাই কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের কর্তব্য মনে করি।
সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে আমরা জানি একমাত্র গণআন্দোলনের মাধ্যমেই জনসাধারণ রাজনৈতিক শিক্ষা অর্জন করে। শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তারা চিনতে শেখে কে তার আসল বন্ধু, কে তার আসল শত্রু, আর কে ছদ্মবেশী বন্ধু। মাক্সর্বাদী হিসাবে, মহান মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুং-কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে আমরা জানি, একমাত্র আন্দোলনেই জনগণের মনে রাজনৈতিক চেতনার আলো স্ফূরিত হয়, মানুষ বুঝতে পারে একতার শক্তি কত। তার দৃষ্টিভঙ্গির দিগন্ত প্রসারিত হয়, মনোবল শক্তিশালী হয়, ফলে ভবিষ্যতে লড়াইয়ের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। তাই গণআন্দোলনের মাধ্যমে খুব অল্প সময়েই জনগণ মূল্যবান শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়।
বর্তমানে আমাদের দেশে একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। কোটি কোটি শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে। আরও কোটি কোটি বেকার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই হচ্ছে দেশের অবস্থা। এর কারণ কী? এর জন্য দায়ী কে? দায়ী এই পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জনগণের রক্ত চুষে মানুষকে শোষণ করে তাদের মুনাফার পিপাসা নিবারণ করে। এই অবস্থায় মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে ছটফট করছে, অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে।
আপনারা জানেন, পশ্চিমবঙ্গে এনআরএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডোমের চাকরির ৭টি শূন্য পদে আবেদন চাওয়া হয়েছিল, তাতে আবেদন করেছে ১০০ জন ইঞ্জিনিয়ার, ২০০০ স্নাতক, ১০০০ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা। একইভাবে ২০০টি পিয়নের পদের জন্য উত্তরপ্রদেশে কিছুদিন আগে আবেদন করেছে প্রায় লক্ষাধিক উচ্চ ডিগ্রিধারী যুবক-যুবতী। ঝাড়ূদারের পদের জন্যও একই ঘটনা দেখা গেছে তামিলনাড়ুতেও।
অতি সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন বলেছেন, ভারতে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে ৬ জন বেকার। সে সংখ্যা বাদ দিলেও দেশে অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কোটি কোটি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কোটি কোটি বেকার যুবক ও শ্রমিক কর্মচারীর ছাঁটাইয়ের জন্য দায়ী কে? এর জন্য দায়ী বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, একচেটিয়া পুঁজি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলি। এই বহুজাতিক সংস্থা ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধেই গড়ে উঠেছে কৃষক আন্দোলন। সেই দিক থেকেও এই ছাঁটাই শ্রমিক, কর্মহীন বেকার, যাদের চাকরি চলে যেতে বসেছে, তাদেরকেও বুঝতে হবে যে ‘‘এটা আমাদেরই আন্দোলন” এবং অবশ্যই এই আন্দোলনের সাথে থেকে তাদের শক্তি জোগাতে হবে।
শিক্ষার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও গৈরিকীকরণে আজ ছাত্ররা আক্রান্ত। তাদের বুঝতে হবে এর জন্য দায়ী কে? এর জন্যও দায়ী সেই বহুজাতিক ও একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠী। কারণ, পুঁজিবাদ আমাদের দেশে ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী করছে। এই কারণেই তারা চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তিসঙ্গত মানসিক শক্তি, বৈজ্ঞানিক মননকে ধ্বংস করতে চাইছে। ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃতেরা যে শিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকে তারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে নতুন ইতিহাস লিখছে। সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাকে মুছে ফেলে পৌরাণিক কাহিনিকে ইতিহাস হিসাবে দেখাতে চাইছে। বিজ্ঞানের পরিবর্তে চলছে মায়াবিদ্যার প্রচার। আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা, ধর্মভিত্তিক মানসিকতা, অন্ধবিশ্বাস গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী মননকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। তাই আজ ছাত্র সমাজকেও বুঝতে হবে এই কৃষক আন্দোলন একচেটিয়া পুঁজি ও বহুজাতিকের বিরুদ্ধে। ফলে এটা তাদেরও আন্দোলন।
অতীতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, আইন-ব্যবস্থা ইত্যাদি পেশাকে সম্মানজনক ও মহৎ পেশা হিসাবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাদ এই পেশাজীবীদের শিক্ষিত বেতনভুক শ্রমিকে পরিণত করেছে। তাদের কোনও মর্যাদা নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের আড়ালে চলছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্র। এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নেই, এমনকি ভিন্ন মত প্রকাশ করা এবং প্রতিবাদ করারও অধিকার নেই। সমস্ত অধিকারকে নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে। এই ব্যবস্থায় একমাত্র স্বাধীনতা আছে শুধু পুঁজিপতিদের শোষণের মেশিন চালানোর, যাতে মানুষরূপী কাঁচামালের অর্থাৎ শোষিত মানুষের হাড়-মাংস চূর্ণবিচূর্ণ করা যায়। এই কৃষক আন্দোলন দানবীয় ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। তাই সকলকেই এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে।
আর একটি ভয়াবহ দিকও লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিদিন একেবারে শিশুকন্যা থেকে শুরু করে নব্বই, একশো বছরের মহিলারা পর্যন্ত আজ ধর্ষিতা হচ্ছেন। এমনকি বাবা তার মেয়েকে ধর্ষণ করছে এ অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নারীপাচার একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এই অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে, কিন্তু শুধু তার দ্বারা কি এই অপরাধের মূল কারণ বন্ধ হতে পারে? এই ঘটনা আজ ঘটছে কেন? এই অপরাধীরা হল বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সৃষ্টি। এরা না মানুষ না পশু। এরা এই আধুনিক অবক্ষয়িত পুঁজিবাদ সৃষ্ট একধরনের মনুষ্যেতর জীব, এক ধরনের নতুন প্রজাতি। এই পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের প্রয়োজনে নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করছে। ভারতীয় নবজাগরণের মহান মনীষী রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ফুলে, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, লালা লাজপত রায়, তিলক, নেতাজি, মহান সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, প্রেমচন্দ, সুব্রহ্মনিয়ম ভারতী, বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি ভি রামন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, স্বাধীনতা আন্দোলনের শহিদ সূর্য সেন, বাঘা যতীন, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং, আসফাকউল্লা খান, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভুলিয়ে দিতে চাইছে। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিতে চাইছে যাতে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এই সব বড় মানুষদের জানতে না পারে এবং এঁদেরকে ভুলে যায়। তারা বর্তমান প্রজন্মকে মদ-জুয়া-সাট্টা, ব্লু ফিল্ম, নোংরা যৌনতায় নিমজ্জিত করছে। মাদকাশক্তির মতো যৌনতাতেও নিমগ্ন রাখার চেষ্টা চলছে। ভারতবর্ষ এমন জিনিস আগে কখনও দেখেছে? এটাই কি সভ্যতার অগ্রগতি? এর জন্য দায়ী কে? এই পুঁজিপতিরা এবং তারা যাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে সেই রাজনৈতিক দাসেরা– তারাই এর জন্য দায়ী। এই কৃষক আন্দোলন সেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে। এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমাদের দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নীতি-নৈতিকতা সহ সমস্ত দিক থেকেই আজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। গোটা সমাজটাই আজ প্রায় পচে গেছে। পারিবারিক জীবনে শান্তি নেই, স্নেহ-প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কখনও সন্তান বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে, তাদের ঘর থেকে বের করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসছে, তারা বিলাপ করছে, আবার একদল বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে– যেখানে তারা মৃত্যুর দিন গোনে। পুঁজিবাদ অর্থ এবং মুনাফা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। দেশ, জনসাধারণের জন্য পুঁজিপতিদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আপনারা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, এই অতিমারির সময়েও তারা কত আয় করেছে। এই অতিমারির সময়ে দেশের ১০০ জন কোটিপতি ১২ লক্ষ ৯৭ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে যেখানে কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়েছে, ছাঁটাই হয়ে প্রায় রাস্তার ভিখারিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের মাত্র ১ শতাংশ লোক মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯৫.৩ কোটি লোকের মোট সম্পত্তির চারগুণ সম্পত্তির অধিকারী। পুঁজি কী ভাবে কেন্দ্রীভূত হয় দেখুন। জনসংখ্যার এক শতাংশ লোক জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ লোকের মোট সম্পত্তির চার গুণ সম্পত্তির অধিকারী। পুঁজিবাদের নিয়ম অনুসারেই পুঁজি আরও কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
ভারতবর্ষের ১৩৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৮০ কোটি মানুষ দৈনিক ২০ টাকা রোজগার করে। তারা জীবনধারণ করবে কীভাবে? কোটি কোটি গরিব মানুষ ডাস্টবিনে ধনী লোকেদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। কোটি কোটি শিশু রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা জানে না তাদের বাবা-মা কে, তাদের বাড়ি কোথায়, তারা কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে। এই হচ্ছে ভারতবর্ষের উন্নয়ন! পুঁজিবাদ আজ মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু এবং এই কৃষক আন্দোলন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে। তাই এই আন্দোলনে শুধু যোগদানই নয়, একে শক্তিশালী করাও হচ্ছে আজ আমাদের অবশ্যকরণীয় কর্তব্য।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সিপিআই(এম)-এর মতো বৃহৎ বামপন্থী পার্টির নেতারা এই আন্দোলনে শুধুমাত্র মৌখিক ভূমিকা পালন করছে। আপনারা জানলে অবাক হয়ে যাবেন, গত ৩০ ডিসেম্বর সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সরকার, কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধিরা একত্রে বসে এই আন্দোলনের একটা মীমাংসা করুক। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ এবং ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ১ জানুয়ারি, ২০২১ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একটি কমিউনিস্ট পার্টির কথা না হয় বাদই দিলাম, নিদেনপক্ষে একটি বামপন্থী পার্টিও কি এই কথা বলতে পারে? যদি সমস্ত বামপন্থী পার্টিগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে, তাদের সমস্ত শক্তিকে যুক্ত করে এই কৃষক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারত, তা হলে বর্তমান পরিস্থিতি অন্য রকম হত।
যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি না হলেও ১৯৫০ ও তার পরবর্তীকালে কিছুদিন অবিভক্ত সিপিআই-এর একটা সংগ্রামী ভূমিকা ছিল। ১৯৬৪ সালে সিপিআই(এম) তৈরি হওয়ার পর ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তারাও কিছু কিছু আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে সরকারি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরেই তাদের রূপ বদলাতে শুরু করে। অন্যান্য বুর্জোয়া পার্টিগুলির মতোই তারাও কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে পুলিশ পাঠায়, গুলি চালায়। তখন থেকেই আপনারা দেখতে পাবেন, সিপিআই(এম) কোনও রাজ্যেই যথার্থ কোনও আন্দোলন গড়ে তোলেনি। তারা কিছু বিবৃতি দেয়, কিছু প্রোগ্রামের কথা ঘোষণা করে, অথবা কিছু আন্দোলনের মহড়া দেয় শুধুমাত্র কিছু ভোট পাওয়ার আশায়। ইতিপূর্বে এরা সমস্তরকম বামপন্থী নৈতিকতাকে পদদলিত করে কখনও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে মোকাবিলা করার নামে শাসক বুর্জোয়া দল অর্থাৎ কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে, তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, আবার কখনও কংগ্রেসের স্বৈরতন্ত্রকে মোকাবিলা করার জন্য জনতা পার্টি (যার মধ্যে আরএসএস, জনসংঘ ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী শক্তি ছিল)-র সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। এখন তারা আবার পার্লামেন্ট এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় যেভাবেই হোক কিছু সিট পাওয়ার আশায় কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলের সাথে ঐক্য করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মার্কসবাদী নামের আড়ালে এটি এখন একটি ভোটসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। সিপিআই(এম)-এর সৎ এবং বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কর্মী-সমর্থকদের এগুলি বিচার করে দেখতে হবে। কংগ্রেস অথবা অন্যান্য সমস্ত আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলি কখনও কোনও আন্দোলনে আসেনি এবং আসবেও না। কারণ শুধুমাত্র শাসকদলই নয়, এই সমস্ত পার্টিগুলি এমনকি সিপিআই, সিপিআই(এম)ও একচেটিয়া পুঁজির কাছে বাঁধা পড়ে আছে। তারা ইলেকশন বন্ডের মাধ্যমে তাদের ভোটের ফান্ড তোলে। তাদের ফান্ডে টাকা কে দেয়? সমস্ত পার্টিগুলি এই সমস্ত একচেটিয়া পুঁজির থেকে কম-বেশি তাদের ফান্ড সংগ্রহ করে। এই খবর ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তা হলে তারা কী ভাবে এই একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে লড়তে পারে? আমরা এই সমস্ত বামপন্থী দলগুলির সৎ কর্মী-সমর্থক-দরদিদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি– গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বামপন্থী আন্দোলনের স্বার্থে আপনারা সমস্ত শক্তিকে নিয়োজিত করে এই কৃষক আন্দোলনে যোগদান করুন এবং আপনাদের নেতৃত্বকেও বাধ্য করুন এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে-ই গড়ে তুলুক না কেন, আন্দোলনের দাবি যদি ন্যায্য হয়, গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষ যদি তাতে যুক্ত হয়, আমাদের দলকে ডাকুক, না ডাকুক বা আমাদের দল নেতৃত্বে থাকুক, না থাকুক, আমরা সেই আন্দোলনে অবশ্যই যোগদান করি। আমরা সেই সংগ্রামে যোগদান করি, সেই সংগ্রামকে শক্তিশালী করি একটি বিপ্লবী লক্ষ্য নিয়ে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি আবার আপনাদের সবার কাছে আহ্বান জানাচ্ছি– এই সফল সর্বাত্মক ভারত বনধের পরেও এই আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য– যতদিন না আন্দোলনের দাবিগুলি অর্জিত হয়। তার জন্য আপনারা সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন, গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগ্রাম কমিটি, কারখানা ও শ্রমিক ব্যারাকে শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি, ছাত্র-যুব সংগ্রাম কমিটি, মহিলা সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন, স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নাম লেখান এই আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য, একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এমনকি আপনাদের নিজেদের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। আন্দোলন ছাড়া, সংগ্রাম ছাড়া আপনারা কোনও দাবি আদায় করতে পারবেন না। যদি এই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়, তা হলে শুধু যে দেশের কৃষকরাই লাভবান হবেন তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি দুর্বল হবে, সরকারি বুর্জোয়া দলগুলি দুর্বল হবে। দেশের শোষিত মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এর মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই কৃষক আন্দোলনে আপনাদের সামিল হওয়া প্রয়োজন।
শেষ করার আগে আমি প্রথমে শহিদ-ঈ-আজম ভগৎ সিং ও সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য থেকে কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই। ভগৎ সিং-এর যে বক্তব্যটি আমি শোনাব, সেটি এ দেশের অনেকেই জানেন না। ভগৎ সিংকে তাঁর বীর সাহসী চরিত্রের জন্য শহিদ-ঈ-আজম বলা হয়। সেই যুগের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে ভগৎ সিং-ই যে বিপ্লবী ধারাকে বহন করেছেন শুধু তাই নয়, অহিংস গান্ধীবাদীদের শ্রেণিচরিত্র বোঝার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চিন্তাশক্তিও একমাত্র তাঁরই ছিল। তিনি এই নেতৃত্বকে এ’পোজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘কলকারখানার মজুর আর খেতখামারের কৃষকরাই বিপ্লবী সংগ্রামের প্রকৃত সৈনিক।” নোট করুন, তিনি শ্রমিক-কৃষকদের বলছেন ‘প্রকৃত সৈনিক।’ তারপর বলছেন, ‘‘কিন্তু আমাদের বুর্জোয়া নেতারা’ অর্থাৎ গান্ধীবাদী নেতারা ‘‘শ্রমিক-কৃষকদের সংগ্রামে যুক্ত করতে চান না অথবা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে বলে ভয় পান। তারা ভয় পান, কারণ তারা ভাবেন, সুপ্ত সিংহকে যদি তারা একবার জাগিয়ে তোলেন তা হলে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।” কৃষক-শ্রমিকদের ক্ষমতার উপর তিনি কী অপরিসীম বিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন! ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ তাঁর ফাঁসি হয়। তার আগে ৩ ফেব্রুয়ারি সিপিআই থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশের যুবসম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন একটি মার্কসবাদী পার্টি গড়ে তোলার জন্য। হয়ত তিনি সিপিআই-এর ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি আবেদন করেছিলেন, ‘‘শ্রমিক ও কৃষকদের সমর্থন পাওয়া ও তাদের সংগঠিত করা প্রয়োজন। সেই দলের নাম হবে … একটি কমিউনিস্ট পার্টি। কঠোর শৃঙ্খলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আন্দোলন গড়ে তুলে পরিচালনা করতে হবে। …বিপ্লবের অর্থ হচ্ছে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। … সেটা হচ্ছে মার্কসবাদের ভিত্তিতে নূতন সমাজ গঠন করা” (যুব রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি)। সেই সময় অন্য কোনও নেতা এইভাবে ভাবতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর ঠিক আগে, পুলিশ অফিসার যখন তাঁকে ডাকতে এসেছে, তিনি বলেছিলেন, ‘‘আর একটু সময় আমাকে দাও, একজন মহান বিপ্লবীর সাথে আর একজন বিপ্লবীর সাক্ষাৎ চলছে।” সেই মহান বিপ্লবী কে? মহান লেনিন। ভগৎ সিং মৃত্যুর পূর্বে লেনিনের জীবনী পড়ছিলেন। ভগৎ সিং হচ্ছেন প্রথম বিপ্লবী যিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে সর্বপ্রথম ‘ইনকিলাব-জিন্দাবাদ’ স্লোগান তুলেছিলেন। একটি মার্কসবাদী পার্টি গড়ে তোলার জন্য ভগৎ সিং ১৯৩১ সালে আবেদন করেছিলেন। ভারতবর্ষের বুকে প্রথম এই বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠতে আরও ১৭ বছর সময় লেগে যায়। ১৯৪৮ সালে মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ সকল বীর বিপ্লবী, শহিদ ও ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎদের স্বপ্নকে সফল করার উদ্দেশ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে হাতিয়ার করে ভারতবর্ষের বুকে একমাত্র সাম্যবাদী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) গড়ে তোলেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব কী ভাবে দিতে হবে, কমরেড শিবদাস ঘোষের সেই শিক্ষা আমি এখন আপনাদের কাছে তুলে ধরব। তিনি বলছেন, ‘‘… বেকার সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন নিয়ে লড়াই হোক, মজুরদের মাইনে বৃদ্ধির লড়াই হোক, গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াই হোক, জিনিসপত্রের দাম কমাবার লড়াই হোক, সস্তা দরে চাল দেওয়ার জন্য লড়াই হোক, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুবদের যেকোনও দাবিতে যত লড়াই যেখানেই শুরু করুন, সেই লড়াইগুলিকে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল রাজনৈতিক লক্ষে্যর দিকে দৃষ্টি রেখে গড়ে তুলতে হবে। সেই লড়াইগুলোর শেষ লক্ষ্য হবে, অর্থাৎ লড়াইগুলোকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার সংঘর্ষের দিকে, বিপ্লবাত্মক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে দেশের অর্থনীতি, দেশের রাজনীতি, উৎপাদন, শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিক্ষা সমস্ত কিছুকে পুঁজিবাদী শোষণ ও জুুলুম থেকে মুক্ত করার জন্য। এই যদি সমস্ত আন্দোলনগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য বলে মনে করেন, তা হলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কার্যক্রম ছাড়া আর সব রাস্তা ভ্রান্ত।” ছাত্রযুবকদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘…প্রতিটি দেশে সমাজবিকাশের প্রতিটি স্তরে এই ছাত্র-যুবকরাই বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন, পরিপূর্ণ নিষ্ঠা নিয়ে জনগণের কাছে যান, হাজার হাজার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, সংগঠিত করেন, জনগণের রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে সাহায্য করেন। … জনসাধারণের কাছে যান, তাদের সংগঠিত করুন, তাদের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করুন, যাতে করে মেহনতি মানুষ একদিন নিজেরাই শক্তি অর্জন করে বুর্জোয়া শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে।”
মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে আমি আমাদের দলের সকল কর্মী-সমর্থক-দরদির কাছে আবেদন জানাব, এই কৃষক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনারা আপনাদের পূর্ণ শক্তি নিয়োজিত করুন। মনে রাখবেন, মানুষের ক্ষোভ স্ফুলিঙ্গের মতো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ প্রতিবাদ চাইছে, সংগ্রাম চাইছে। এটা আগে থেকে কখনই বোঝা সম্ভব নয় কখন এবং কোথায় শান্ত একটা পরিবেশের পরিবর্তে সংগ্রামের উত্তাল ঝড় আসবে। আমাদের সবসময় সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে এই ধরনের পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য, এই ধরনের সংগ্রামকে সংগঠিত ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। বর্তমানে সকল সংগ্রামে ও আন্দোলনে চাই মার্কসবাদী বিপ্লবী আদর্শ ও পুঁজিবাদবিরোধী সর্বহারা বিপ্লবী নেতৃত্ব যেটা শহিদ-ই-আজম ভগৎ সিং ও মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ ব্যক্ত করেছেন।
আমি আশা করি, এই বীরত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলন অবশ্যই জয়ী হবে এবং এই জয়ের দ্বারা আমাদের দেশে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি, হরিয়ানার কৃষকরা তাদের সরকারকে পরাস্ত করেছে। সরকারকে মাথা নিচু করে দাবি মানতে বাধ্য করেছে। একইভাবে এই আন্দোলনও জয়যুক্ত হবেই। সবাইকে লাল সেলাম জানিয়ে শেষ করছি।