দেনার দায়ে আবার আত্মহত্যা করলেন একজন ভাগচাষি৷ পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা–১ নং ব্লকের বাখনাপাড়ার মাধব মাঝি বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এবং স্ত্রী– পুত্রবধূর গয়না বন্ধক রেখে এ বছর আলু চাষ করেছিলেন৷ মোট চার বিঘা ভাগ চাষের মধ্যে আড়াই বিঘাতে আলু ও দেড় বিঘাতে বোরো চাষ করেন তিনি৷
এই মরসুমে আলুর ফলন ভাল হলেও, আলু ওঠার মুখে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাঁর ৭০ শতাংশ আলু নষ্ট হয়৷ বাকি ৩০ শতাংশ আলু ১২০–১৩০ টাকা বস্তা অর্থাৎ মাত্র ২ টাকা থেকে ২.৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি৷ চাষের জন্য যে বিপুল পরিমাণ টাকা মাধব মাঝি ঋণ করেছিলেন তা আলু বক্রি করে পাওয়া সামান্য টাকায় পরিশোধ করা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি৷
মূলত ঋণের দায়েই আত্মহত্যা করেছেন বাবা– বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর ছেলে অজিত মাঝি৷ অথচ স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই রাজ্য সরকার মৃত্যুর কারণ ‘পরিষ্কার নয়’ বলে জানিয়েছে৷ আসলে এই মৃত্যুর দায় ভোটের মুখে স্বীকার করতে নারাজ সরকার ও প্রশাসন৷
স্বীকার করবেই বা কেন? কিছু দিন আগেই তো ১০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু কৃষকদের কাছ থেকে ৫.৫০ টাকা কেজি দরে সরাসরি কেনার কথা ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী৷ শুধু তাই নয়, কৃষকদের হাতে নগদ ৫ হাজার টাকা করে পৌঁছে দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেন তিনি৷ তার পরেও এই মৃত্যু? ভোটের মুখে তৃণমূলের পক্ষে এই মৃত্যু প্রকাশ্যে আনা কী সম্ভব?
বিচার করলেই বোঝা যায়, এ রাজ্যে চাষিদের পাশে দাঁড়ানোর নামে সরকার যা যা নীতি গ্রহণ করেছে সেগুলি সবই ভাঁওতা৷ ভোটের দিকে তাকিয়ে চাষিদের ঠকানো হয়েছে৷ চাষির হাতে নগদ টাকা গুঁজে দেওয়া বা এ বছর উৎপাদিত ২ কোটি ৭০ লক্ষ মেট্রিক টন আলুর মধ্যে মাত্র ১০ লক্ষ মেট্রিক টন কিনলে চাষির সমস্যার যথার্থ কোনও সমাধান যে সম্ভব নয়, তা সরকার জানে৷ কিন্তু ভোটের মুখে এই ধরনের ঘোষণা যে তৃণমূলের ঝুলিতে কিছু বাড়তি ভোট এনে দিতে পারে, সেটাও তারা ভালই জানে৷
ফলে কৃষি নীতির কোনও পরিবর্তন না করে, লম্বা–চওড়া প্রকল্প ঘোষণাতেই তাদের বেশি মনোযোগ৷ আবার যে প্রকল্পের ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী করছেন তাতে, ভাগচাষিদের বিশেষ সুবিধা হওয়ার কথা নয়৷ যে চাষির নিজের নামে জমি রয়েছে এবং কাগজপত্র রয়েছে তাঁরাই এই সুযোগ পাবেন৷ বাকিদের অধিকার অনিশ্চিতই থেকে যাবে৷ ভাগচাষি বা প্রান্তিক চাষিদের চাষের জন্য গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই৷ আবার সরকারি সহায়ক মূল্যেও এরা ফসল বিক্রি করতে পারবে না৷ ফলে ফসল বিক্রি করতে হবে গ্রামীণ ফড়ে বা আড়তদারদের কাছে– তাদের বেঁধে দেওয়া দামে, যা থেকে ঋণ পরিশোধ করা তো দূরের কথা চাষের খরচটুকুও ওঠা সম্ভব নয়৷
ফলত চাষির আত্মহত্যা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই৷ বিগত সাত বছরে এ রাজ্যে প্রায় ২০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন৷ সিপিএম জমানাতেও এই জিনিস ঘটেছিল৷ অন্য রাজ্যগুলিতে একই দূরাবস্থা৷ দেশজুড়েই চলছে কৃষক আত্মহত্যার মিছিল৷ বিজেপি–কংগ্রেস বা এ রাজ্যের তৃণমূল ও পূর্বতন সিপিএম সহ সমস্ত ভোটবাজ দলগুলির করপোরেট কোম্পানির স্বার্থবাহী কৃষিনীতির বেড়াজাল ছিন্ন করতে চাই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন৷ একমাত্র এই রাস্তাতেই এ রাজ্যে তথা দেশের লক্ষ লক্ষ চাষির আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা বন্ধ হতে পারে৷