করোনা ত্রাণের আর্থিক প্যাকেজের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর ছেড়ে যাওয়া ব্যাটন হাতে দীর্ঘ দৌড় দেখাতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের ব্যবস্থা করেছেন৷ যার ফলে সারা দেশের কৃষকদের অধিকাংশই এখন থেকে কৃষি পণ্যের কর্পোরেট কোম্পানিগুলির দাদন নিয়ে ঠিকা প্রথায় চাষ করবেন৷ কেন্দ্রীয় সরকার বলে দিয়েছে এতেই নাকি চাষি স্বাধীন হল, যেখানে বেশি দাম পাবে তারা সেখানেই ফসল বেচবে৷ কিষান মাণ্ডি কিংবা সরকারি বাজারে আর তাদের যাওয়ারই দরকার নেই৷ কৃষিপণ্যের নিয়ন্ত্রিত বাজার কমিটিগুলিরও কৃষকের হয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে আর কোনও দরাদরির ভূমিকা থাকল না৷ বহুজাতিক কোম্পানিই কৃষকদের কাছে গিয়ে জানাবে তারা কোন ফসল চায়, কৃষক চুক্তিবদ্ধ হবেন, চাষ করে ফসল তাদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ট্যাঁকে টাকা গুঁজতে গুঁজতে বাড়ি চলে যাবেন এর পরেই কেন্দ্রীয় অর্ডিন্যান্সের জোরে বাতিল হয়েছে অত্যাবশকীয় পণ্য আইন৷ যার মধ্য দিয়ে অত্যাবশকীয় পণ্য, কৃষিপণ্য যথেচ্ছ মজুত, যত খুশি রপ্তানি ইত্যাদির ছাড়পত্রও পেয়ে গেল বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি৷ ফসলের ক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য গুদাম, হিমঘর ইত্যাদির ব্যবস্থা হবে মাণ্ডিতেই৷ ‘অপারেশন গ্রিন’ প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার নাবার্ডের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা দিচ্ছে৷ তার সাহায্যে আলু, পেঁয়াজ, টমেটো ইত্যাদি ফসল পরিবহণ এবং হিমঘরে মজুতের খরচে পঞ্চাশ শতাংশ ভরতুকি দেওয়া হবে৷ মাণ্ডিতে চাষি ফসল নিয়ে গেলে যে ব্যবসায়ীদের তা কিনতেই হবে, তার কোনও বাধ্যবাধকতা আর থাকল না৷ এই নীতির ফলে সরকারেরও দায় থাকল না ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা এবং তা চাষি যাতে পায় তা দেখার বন্দোবস্ত করার৷ একই সাথে ধান, গম, পাট, আলু, তৈলবীজ, পেঁয়াজ, সবজি ইত্যাদি সরকার যতটুকু সংগ্রহ করত, তাও আর করবে না৷ ফসল বিক্রির জন্য পুরোপুরি চাষিকে নির্ভর করতে হবে বেসরকারি পুঁজির দাক্ষিণ্যের উপর৷ বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের যে ধরনের কারখানা বানাবে তার সাথে সঙ্গতি রেখেই চাষ করতে হবে ফসল৷ এর পরেও চাষি ভাল দাম পাবে কী করে?
নাবার্ডের টাকায় গড়া পরিকাঠামো ভোগ করবে কারা? চাষিরা, নাকি কৃষিপণ্যের বৃহৎ কারবারি কোম্পানিগুলি? ফসল যখন ওঠে সেই সময় বাজারে ফসলের দাম থাকে সবচেয়ে কম৷ সেই ফসল ব্যবসায়ীদের গুদামজাত হয়ে গেলে খোলা বাজারে তার দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে৷ চাষির পক্ষে দীর্ঘদিন সেই ফসল ধরে রেখে দাম বাড়ার জন্য অপেক্ষা করা কি সম্ভব? কারণ চাষি চাষ করে ঋণ নিয়ে৷ সেই ঋণের বেশিরভাগটাই আসে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারের সুদে৷ ফসল ওঠামাত্রই তা বিক্রি করে দিতে না পারলে তাদের সর্বনাশ৷ তা হলে ঋণের ফাঁদ আরও চেপে বসবে৷ অন্যদিকে বহুজাতিক কর্পোরেশন যখন আগাম দাদন দিয়ে চাষ করাবে, তারাও দাম ঠিক করবে ফসল ওঠার সময়কার সম্ভাব্য দামকে ধরেই৷ তাদের পুঁজির জোর আছে ফলে কম দামে কেনা সেই ফসল তারা মজুত করতে পারবে যত খুশি৷ গুদাম, হিমঘরের পরিকাঠামো কাজে লাগবে আসলে এই সব বহুজাতিক এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদেরই৷
কেন্দ্রীয় সরকার চাষিদের ব্যাঙ্কের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করবে বলেছিল৷ পিএম কিষান স্কিমে ১৪.৫ কোটি কৃষককে সাহায্য করার কথা বলেছিল৷ দেখা যাচ্ছে পিএম কিষানের মাত্র ৬ হাজার টাকা সেটাও পায়নি বেশিরভাগই৷ দেড় বছরে মাত্র ৯ কোটি কৃষক পরিবারকে সরকার নাকি খুঁজে পেয়েছে৷ তাদের অর্ধেকের কিছু বেশি বাস্তবে টাকা পেয়েছেন, বাকিদের তাও জোটেনি (দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন, ২১.০১.২০২০)৷ অথচ ২০১১–র সেন্সাস এবং ২০১৫–র এগ্রিকালচারাল সেন্সাস দেখাচ্ছে ভারতে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কৃষির উপর নির্ভরশীল৷ দেশের মোট কৃষিঋণের ১৫ শতাংশের বেশি ব্যাঙ্ক থেকে আসে না৷ সেটাও পায় বৃহৎ জমির মালিকরাই৷ কারণ কিষাণ ক্রেডিট কার্ড, বা অন্য পথে ব্যঙ্কের ঋণ পাওয়ার যা হ্যাপা সামলে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা নেই বেশিরভাগ কৃষকেরই৷ সমস্ত রাজ্যেই যত নথিভুক্ত কৃষক আছেন তার ৫০ শতাংশের কম ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন৷ ভূমিহীন চাষি, বর্গাদার, ভাগচাষিদের বেশিরভাগকেই ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় না৷ অথচ তাঁরাই সংখ্যায় বেশি৷ সরকারি বা ব্যাঙ্কের ঋণ পাওয়ার জন্য যারা বিবেচিত হয়েছেন তাঁরা সরকারি খাতায় জমি মালিক হিসাবে নথিভুক্ত থাকা কৃষকের সংখ্যার তুলনাতেও নগন্য৷ পশ্চিমবঙ্গে ৭০ লক্ষ নথিভুক্ত কৃষকের মধ্যে ৩৫ লক্ষ, বিহারে ১ কোটি ৬৪ লক্ষের মধ্যে ৫২.৫ লক্ষ, মহারাষ্ট্রের দেড় কোটির মধ্যে ৮৬ লক্ষ, মধ্য প্রদেশের ১ কোটির মধ্যে ৫৫ লক্ষ কৃষক কিছু ঋণ বা সরকারি সাহায্য পাওয়ার জন্য নথিভুক্ত হয়েছেন৷ আর নথিভুক্ত নন এরকম ভূমিহীন, ভাগচাষির প্রকৃত সংখ্যা সরকার কোনও দিন জানায়নি (দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন,২১.০১.২০২০)
বিজেপি সরকারের কৃষক দরদের আর একটি নমুনা হল ব্যাঙ্কের কৃষি ঋণের পরিমাণ৷ ২০১৭–১৮ সালে ব্যাঙ্কগুলি মোট ঋণ দিয়েছিল ৭৭ লক্ষ কোটি টাকা৷ তার মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে দিয়েছিল মাত্র ১০ লক্ষ কোটি টাকা৷ অথচ মাত্র ১০ জন শিল্পপতি পেয়েছিলেন ৭ লক্ষ কোটি টাকা (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ জুন ২০২০)৷ যদিও ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিল্পপতিদের অবদান৷ সেখানে কৃষি ক্ষেত্রের অনাদায়ী ঋণ ১০ শতাংশেরও কম (ওই)৷ অর্থাৎ কৃষককে টাকা দিয়ে বেশিটাই ফেরত পেয়েছে ব্যাঙ্ক৷ কিন্তু তাদের টাকা না দিয়ে সরকারি ব্যঙ্কগুলি তাদের কোষাগার খুলে দিয়েছে লুঠেরা শিল্পপতিদের কাছে৷
দেশের কৃষকদের বাঁচানোর জন্য যখন দরকার ছিল, সামান্য বা বিনা সুদে সরকারি ঋণ, বিশেষত করোনা মহামারি জনিত পরিস্থিতিতে আরও দরকার ছিল কৃষককে সরাসরি অর্থ সাহায্য৷ সরকার এর কোনও পথেই গেল না৷ কৃষককে ফসলের লাভজনক দাম পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে, অন্য দিকে সাধারণ মানুষকে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কোপ থেকে বাঁচাতে দরকার ছিল সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য৷ যার মাধ্যমে বন্ধ হত কৃষিপণ্য নিয়ে একদিকে চাষির আত্মহত্যার মিছিল৷ কিন্তু বিজেপি সরকার ঠিক উল্টোপথে হেঁটে চাষ থেকে কৃষিপণ্য বিক্রির পুরো ব্যবস্থাটাই তুলে দিল কর্পোরেট পুঁজির হাতে৷ কৃষকের বাঁচার স্বার্থেই এর মোকাবিলা করা দরকার৷