৫ আগস্টের ব্রিগেড যে কানায় কানায় ভরে উঠল, বাস্তবে সব হিসাবকে ছাপিয়ে গেল, তা সম্ভব হল কী করে? এই বিরাট সমাবেশের জন্য যে কয়েক মাস ধরে টানা প্রচার, কর্মী-সমর্থক-দরদিদের জন্য আসার ব্যবস্থা করা, যাঁরা সমাবেশের দু’দিন তিন দিন আগে পৌঁছেছেন তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, ব্রিগেড এবং গোটা কলকাতা শহরকে লাল পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন, উদ্ধৃতি, দেওয়াল লিখনে সাজিয়ে তোলা– এর জন্য যে বিপুল খরচ তা-ই বা উঠল কী করে? দলের বাইরেও যে বিরাট অংশের মানুষ সমাবেশে এসেছিলেন, বড় সমাবেশের ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্যে পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাঁরা কর্তব্যরত ছিলেন, তাঁরা সকলে যে একবাক্যে বলেছেন– এমন শৃঙ্খলা আমরা অন্য কোনও দলের সমাবেশে দেখিনি, তা সম্ভব হল কী করে? দলের বাইরের যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ফিরে গিয়ে যে বলছেন, এখন থেকে আমরা আপনাদের দলের সঙ্গেই থাকব, এটা ঘটতে পারল কী করে?
এই সব কিছুই ঘটতে পেরেছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলটির সঠিক বামপন্থী রাজনীতি এবং নীতি-আদর্শ-সংস্কৃতির প্রভাবে– যা সারা বছর ধরে সাধারণ মানুষ লক্ষ করেন। এই দলের আন্দোলনে, কর্মীদের আচরণে যে মানুষ আকৃষ্ট হয়, তার় মূল আধার দলের প্রতিষ্ঠাতা, এ যুগের অন্যতম মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তা। বিগত চার-পাঁচ মাস ধরে দলের কর্মীরা ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার করতে গিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের এই বিপ্লবী চিন্তাকেই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। শুরু থেকে পার্টি যে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে বিরামহীন ভাবে গণআন্দোলন চালিয়ে আসছে তার মধ্যে দিয়েও এই বিপ্লবী চিন্তার মূল সুরটি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই সুরটিকে তাঁদের একান্ত আপন তথা নিজেদের জীবনের সুর বলেই মনে হয়েছে। বাস্তবিক, দলের সংগ্রামী বামপন্থী রাজনীতিই তাঁদের আকৃষ্ট করেছে।
সমাবেশের দীর্ঘ প্রচার কাজে এবং গণআন্দোলনগুলিতে জনসাধারণ লক্ষ করেছেন দল কী ভাবে তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলির প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে লড়াইগুলি গড়ে তুলেছে। এই ভূমিকাই দলের প্রতি তাঁদের সহানুভূতিশীল করে তুলেছে এবং এ প্রত্যয় আজ অনেকখানিই দৃঢ় হয়েছে যে দলটা আসলে তাঁদেরই। তাই অন্য সমস্ত কর্মসূচির মতো ব্রিগেড সমাবেশ সফল করতেও তাঁরা সাহায্যের দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সমাবেশের খরচ জোগাতে যেমন অর্থ সাহায্য করেছেন তেমনই নানা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দিয়েছেন। এস ইউ সি আই (সি) একার উদ্যোগে ব্রিগেড ভরিয়ে তুলতে পারবে কি না, তার জন্যও আন্তরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন– যে উদ্বেগের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সমাবেশের সাফল্যের আকুতি।
কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, যে-কোনও যুগে যে-কোনও বিপ্লবী তত্ত্ব ও মতাদর্শের আসল মর্মবস্তু ও প্রাণসত্ত্বা নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিগত ও নৈতিক ধারণার মধ্যে। এই উন্নত সংস্কৃতি ও নৈতিক ধারণাই তার প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলির মধ্যে উন্নত নৈতিক বল এবং নৈতিক চরিত্রের জন্ম দেয়। তাদের মধ্যে উন্নত সংস্কৃতিগত মান গড়ে তোলে।
মার্ক্সবাদী বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন, কী ভাবে সমাজ জীবনে পুরনো ধর্মীয় মূল্যবোধের আবেদন অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদী মূল্যবোধও প্রায় নিঃশেষিত। এই অবস্থায় গোটা সমাজ জুড়ে আদর্শ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে এক ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা কী দিয়ে পূরণ হবে? মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, যাকে কমরেড শিবদাস ঘোষ আরও বিকশিত ও উন্নত করেছেন, যা আজকের যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ, পূরণ হবে তা-ই দিয়ে। একমাত্র এই বিপ্লবী তত্ত্বই বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের পঙ্গুতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে এক দিকে আদর্শ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রের এই শূন্যতাকে পূর্ণ করতে পারে, অন্য দিকে পুরনো পচে যাওয়া পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে শোষণহীন শ্রেণিহীন উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রচারের মধ্যে আন্দোলনের মধ্যে দলের কর্মীরা যখন এই তত্ত্বকে জনসাধারণের মধ্যে নিয়ে গেছেন, তখন তা জনগণকে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। এই আদর্শকে জানার জন্য নতুন আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। সেই আগ্রহের কথাই বললেন ঝাড়খণ্ড থেকে আসা এক শিক্ষক। বললেন, আমি যখন এ কথা শুনলাম যে, ভোটের দ্বারা বার বার সরকার পরিবর্তন করে জনগণের দুরবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না, তা ঘটতে পারে একমাত্র শোষিত জনগণের সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমেই– তখন তা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন মনে হল। এই সঠিক বক্তব্যের টানেই আমি ব্রিগেডে এসেছি। দেশের বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া দলগুলির বিপরীতে এই সমাবেশের যে শৃঙ্খলা জনসাধারণের মধ্যে, প্রশাসনের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে, আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে, তার জন্ম হয়েছে দলের উন্নত বিপ্লবী চিন্তার সংস্পর্শে এসেই।
রাজনীতিটা যদি পুরনো জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে পাল্টে সকলের বাসোপযোগী নতুন সমাজ তৈরির বিপ্লবী রাজনীতি হয় তবে সেই বিপ্লবী রাজনীতির সংস্পর্শে আসা মানুষগুলিও তার ছোঁয়ায় একটু একটু করে বদলে যান। সেই জিনিসই দেখা গেল, দলের কর্মীদের সঙ্গে একই বাসে আসা খাবারের দোকানের মালিকের মন্তব্যে, যখন তিনি বললেন, ‘আজ সমাবেশের মানুষের আচরণ, প্রভাসবাবুর বক্তব্য শুনে আমি আপনাদের লোক হয়ে গেছি।’ কিংবা সেই পুলিশকর্মী যিনি বললেন, ‘এই দলটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা শাসক দলগুলির ব্রিগেড মিটিংয়ে আসা যুবকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাই। তাদের মাতলামি, অসভ্যতা দেখে মনে হয় পিটিয়ে জেলে ভরে দিই। সেখানে এই বিশাল সমাবেশেও আমাদের কোনও কাজই যেন নেই! এঁরা নিজেরা যেমন সুশৃঙ্খল, তেমনই সমাবেশের শৃঙ্খলা নিজেরাই রক্ষা করছে।’ মনে পড়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের কথা– ‘সর্বহারা বিপ্লবী সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ সমস্ত ক্ষেত্রে বুর্জোয়া সংস্কৃতির থেকে অনেক উন্নত। আর উন্নত বলেই তা বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে ভাঙতে সক্ষম। তিনি বলেছেন, শুধু রাজনৈতিক ভাবে নয়, স্লোগানে নয়– আচার-আচরণে, নীতি-নৈতিকতা, সংস্কৃতি-রুচিতে বুর্জোয়া অপসংস্কৃতির কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত করে নিজের মধ্যে বিপ্লবী নেতৃত্বের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে যে প্রলেতারিয়েত, সেই একমাত্র দুনিয়াকে পরিবর্তিত করতে পারে।’
অসংখ্য বামপন্থী মানুষ, যাঁরা পূর্বতন শাসক বামপন্থী দলের নেতাদের নীতিহীন আচরণ দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ, হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর গণআন্দোলনগুলিকে লক্ষ করছিলেন এবং অপেক্ষা করছিলেন কিছুটা শক্তিবৃদ্ধির জন্য। এ বারের ব্রিগেড সমাবেশের জন্য কর্মীদের নিরলস, অক্লান্ত প্রচার তাঁদের মধ্যে প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছে, আস্থার জন্ম দিয়েছে। তাঁরা ব্রিগেডে এসেছিলেন একটা বড় সংখ্যায়। তৃণমূলের সৎ কর্মী-সমর্থকরা, যাঁরা নেতৃত্বের আকণ্ঠ দুর্নীতিতে বীতশ্রদ্ধ, যাঁরা চান একটা সুস্থ রাজনীতির চর্চা, তাঁরা এসেছিলেন ব্রিগেডে। ঠিক তেমনই বিজেপির নীতিহীন ভোটসর্বস্ব এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যাঁরা উদ্বিগ্ন, তেমন একটা বড় সংখ্যক মানুষও এসেছিলেন ব্রিগেডে। সে দিন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ এবং অন্য নেতৃবৃন্দের বক্তব্য তাঁদের সকলের মধ্যেই বিপ্লবী দলের রাজনীতির প্রতি গভীর আগ্রহের জন্ম দিয়েছে।
কমরেড শিবদাস ঘোষ একদিন বলেছিলেন, সমাজ একটা নতুন আদর্শের জন্ম দেওয়ার যন্ত্রণায় কাঁপছে। কী সেই আদর্শ, যা এই জগদ্দল পাথরের শৃঙ্খলকে ভাঙতে পারে? তা হল সাম্যবাদের আদর্শ, সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ, সর্বহারা বিপ্লবের আদর্শ, পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবের আদর্শ। এই আদর্শে যদি দেশের মানুষকে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত করতে পারি, সংগ্রামকে গড়ে তুলতে পারি তা হলে দেখব আবার দেশের মধ্যে সেই নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। আবার মানুষের মধ্যে সেই ক্ষুদিরামের তেজ, সেই ভগৎ সিংয়ের তেজ ফিরে এসেছে। বাস্তবিক এ বার ব্রিগেড সমাবেশের সাফল্যের পর একটা বড় অংশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে খুশির ভাব সর্বত্র দেখা গেছে, বাসে-ট্রেনে, অফিস-আদালতে, চায়ের দোকানে-পাড়ার মোড়ে– সর্বত্র যে তা আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সেই প্রাণচাঞ্চল্যেরই লক্ষণ।