সম্প্রতি মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে৷ উভয় পরীক্ষাতেই কিছু ছাত্র ভাল ফল করেছে৷ বেশ কয়েকদিন ধরে এই কৃতী ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বর, ছবি, স্কুলের নাম, অধ্যবসায় প্রভৃতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷ সরকারি তরফে কৃতীদের সাথে মিলিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বিভিন্ন আকর্ষণীয় পুরস্কার, নগদ টাকা তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন৷ ঠিকই, যে ছাত্ররা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে বা যারা বাংলায় নিরানব্বই, ইতিহাসে আটানব্বই নম্বর পেয়েছে, তারা আমাদের বুকে আশার সঞ্চার করে৷ এ বছর পাশের হারও বেড়েছে৷ কিন্তু এই ফলাফল দিয়ে কি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্রটি পাওয়া যাবে? এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে আট লক্ষ৷ এই ছাত্ররা ২০০৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়৷ পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এদের সংখ্যা ছিল আঠারো লক্ষ৷ ২০১৬ সালে মাধ্যমিকে সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে এগারো লক্ষ৷ আর ২০১৮ সালে উচ্চমাধ্যমিকের সংখ্যা আরও কমে হয় সাড়ে আট লক্ষ৷ এদের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে সাড়ে ছয় লক্ষ, দেড় লক্ষ ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ হতে পারেনি৷
অর্থাৎ ২০০৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া আঠারো লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ২০১৮ সালে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হল মাত্র সাড়ে ছয় লক্ষ৷ বাকি বারো লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী স্তরে স্তরে শিক্ষার আঙিনা থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হল৷ প্রত্যেক ছাত্র ভাল নম্বর পাবে, ভাল ফল করবে এটা আমাদের যুক্তি নয়৷ কিন্তু শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যাওয়া এই বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর হিসেব সরকারি নথিতে আছে কি? এবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে, বেশি বেশি নম্বর দিয়ে সকলকে পাশ করিয়ে দেওয়া হবে৷ আশা করা যায়, পর্যদগুলিও এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে৷
পাশ করিয়ে দেওয়ার বিপুল এই উদ্যোগের পরেও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, মিড–ডে মিল, সবুজ সাথী, কন্যাশ্রী প্রভৃতি নানা আকর্ষণীয় ঘোষণার পরেও চলার পথে অলক্ষেই তাদের অনেকে স্তরে স্তরে হারিয়ে যাচ্ছে৷ সকল অভিভাবকই চান তাঁর সন্তান শিক্ষিত হোক৷ তারা স্কুলে ভর্তিও হয়৷ অতঃপর একদিকে স্তরে স্তরে ক্রমবর্ধমান খরচের বোঝা, অন্যদিকে গরিব–নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অচিরেই ভঙ্গ হয় বাবা–মা বা ছেলেমেয়ের শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন৷ সরকার কিন্তু নির্বিকার৷ শিক্ষার ব্যয়ভার কমানো, কম খরচে সরকারি স্কুলে সকল ছাত্রছাত্রীর শিক্ষালাভের পরিবেশ গড়ে তোলার প্রশ্নে সরকারের কোনও ভূমিকাই নেই৷ অনুন্নত পরিকাঠামো, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, পাশ–ফেল না থাকা প্রভৃতি কারণে সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নগামী৷ অভিভাবকদের একটা বড় অংশ বাধ্য হচ্ছেন ঘটিবাটি বিক্রি করে হলেও ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করতে৷ আর বাকিদের ভবিষ্যৎ ডুবছে অন্ধকারে৷ সাইকেল, জামা, জুতো, সোয়েটার প্রভৃতি কোনও সরকারি খয়রাতিই এদের উদ্ধার করতে পারছে না৷
একদল ছাত্রছাত্রীর প্রচুর নম্বর পাওয়ার পিছনে একাধিক টিউশন বা কোচিং সেন্টারের ভূমিকাও সামনে এসেছে৷ যেখানে বছরে দেড়–দুই লক্ষ টাকা খরচ করে পড়তে হয়৷ ‘মক টেস্ট’ নিয়ে নিয়ে ছাত্রদের প্রকৃত পরীক্ষার আগেই তৈরি করে তারা৷ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলি ফলাও করে কৃতী ছাত্রদের ছবি প্রকাশ করছে তাদের প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের নজির হিসেবে৷ কিন্তু সমাজের কত সংখ্যক ছাত্র এই সুযোগ নিতে পারে? ফলে দেখা যাচ্ছে, অর্থবান পরিবারের ছাত্রছাত্রীরাই ভাল ফল করছে৷ দরিদ্র ঘরের সন্তানরা দূরে চলে যাচ্ছে৷ সরকারি স্তরে একটু ব্যবস্থা থাকলে তাদের এমন অসম প্রতিযোগিতায় নামতে হত না৷ দরিদ্র ঘরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ ভাল ফল করলে সেটা সংবাদমাধ্যমেই স্থান করে নিচ্ছে ব্যতিক্রম হিসাবে৷ আর এই ব্যতিক্রমকে দেখিয়ে সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে৷
কোনও একটি স্কুল বা জেলার কিছু ভাল নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীকে দেখিয়ে সেটাকেই সরকার সার্বিক চিত্র বলে তুলে ধরছে৷ কিন্তু যে অধিকাংশ বঞ্চিত থাকল, তারাও যাতে পড়াশোনার সমান সুযোগ পায়, ভাল ফল করে তার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকারি দায়িত্ব কোথায়? বহুদিন আগে এ দেশের নবজাগরণের মহান চরিত্র রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হলে সেটাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে না৷ তেমনি গোটা দেশকে রিক্ত করে, নিঃস্ব করে, বঞ্চিত করে অল্প কিছু মানুষের জন্য অনন্যসাধারণ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করাটাও কোনও সভ্য সমাজের রীতি নয়’৷
নবজাগরণের অপর আর এক মনীষী লালা লাজপত রাই বলেছিলেন, ‘শিক্ষাই হচ্ছে জাতির প্রথম প্রয়োজন এবং যাবতীয় রাজস্বের সিংহভাগই এই খাতে ব্যয়িত হওয়া উচিত’৷ কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কোনও সরকারই এই পথে হাঁটেনি৷ বরং মালিকদের মুনাফার স্বার্থে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ সকলেই উৎসাহিত করেছে এবং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে অকেজো করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষা খাতে সরকারি বাজেট ক্রমাগত হ্রাস করা হয়েছে৷ বাদ নেই মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাও৷ রিপোর্ট বলছে, টাকার অভাবে মেধা থাকা সত্ত্বেও বহু ছাত্রছাত্রী মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে পারে না৷ ফলে কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ভাল ফল করা বা ভাল নম্বর পাওয়া অবশ্যই আনন্দের ও গর্বের হলেও রাজ্যের যে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী শিক্ষার সুযোগ থেকে প্রতি বছর বঞ্চিত হচ্ছে তা ভুলে গেলে চলবে না৷ সমাজের সকল ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারটি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সকলকেই সংকল্পবদ্ধ হতে হবে৷
(৭০ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৩ জুলাই, ২০১৮)