
কেমন আছেন কাশ্মীরের আপেল, চেরি, ন্যাসপাতি, আঙুর চাষিরা? কেমন আছেন কাশ্মীরের মেষপালকরা? গত আগস্ট মাস থেকে সেনা ব্যূহে অবরুদ্ধ কাশ্মীর৷ প্রথম দু’মাস টেলিফোন ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি বন্ধ৷ এখন কিছুটা শিথিল হলেও ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়নি৷ ভূস্বর্গ এখন পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের কব্জায়৷ গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে অবশিষ্ট কিছু নেই৷ বিরোধী নেতারা গৃহবন্দি৷ সাংবাদিকদের পায়েও নানা নিষেধের বেড়ি৷
অবরুদ্ধ এই কাশ্মীরে কেমন চলছে কৃষিপণ্যের বিক্রিবাটা? কী অবস্থা পশুপালন ও কৃষিপণ্য নির্ভর ছোট ব্যবসার? ৭ নভেম্বর অকালে ভারি তুষারপাতে কী অবস্থাই বা সেখানকার চাষিদের? বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো–র্ডিনেশন কমিটির এক প্রতিনিধি দল কাশ্মীরে যান৷ সারা দেশের ২৫০টি কৃষক সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ এটি৷ এই মঞ্চের অন্যতম শরিক অল ইন্ডিয়া কিষান খেতমজদুর সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি তথা এসইউসিআই(সি) পলিটবুরো সদস্য কমরেড সত্যবান প্রতিনিধিদলে ছিলেন৷
৭ সদস্যের এই প্রতিনিধিদল ৩ দিন কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে যান৷ তাঁরা ফলচাষিদের বিভিন্ন সংগঠন এবং কাশ্মীরের বণিক সভার সঙ্গে বৈঠক করেন৷ কুলগামে তাঁরা বিভিন্ন কৃষক ও ফার্ম লিডারদের নিয়ে গণশুনানির ব্যবস্থাও করেন৷ গান্দারবাল, পামপোল, পুলওয়ামা, কুলগাম এবং অনন্তনাগে চাষিদের খামারগুলি ঘুরে দেখে তাঁদের উপলব্ধি, চাষিদের অবস্থা শোচনীয়৷
হর্টিকালচার অর্থাৎ ফল–ফুল–শাকসব্জি উৎপাদন কাশ্মীরের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড৷ গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন মার খেয়েছে৷ এবার ভাল ফলন হওয়ায় চাষিরা আশা করেছিলেন ক্ষতি পুষিয়ে যাবে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু–কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা কেড়ে নিয়ে, ৩৭০ ধারা বাতিল করে, কাশ্মীরবাসীকে সামরিক ঘেরাটোপে বন্দি করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাতে কৃষি বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে৷ আগস্ট মাসে যখন আঙুর–ন্যাসপাতি–চেরি ফল বাজারে ওঠে, ঠিক সেই সময় কাশ্মীরকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল গোটা ভারত থেকে৷ ব্যবসায়ীরা বাগানে যেতে পারলেন না ফল কেনার জন্য, কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফল বাজারে আনতে পারলেন না৷ সবই পচে নষ্ট হল চোখের সামনে৷ মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়লেন কৃষকরা৷
সেপ্টেম্বর মাস আপেল তোলার সময়৷ কিন্তু চাষিরা খামারে যেতে পারলেন না আপেল তোলার জন্য৷ একদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী, অন্যদিকে জঙ্গিদের অত্যাচার৷ কোণঠাসা কৃষকরা৷ এর মধ্যেও যতটুকু তুলতে পেরেছেন বিক্রি করতে পারেননি৷ সেনাবাহিনী চাষিদের খামারে ট্রাক নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছে৷ ফলে ক্ষুব্ধ কৃষকরা রাস্তায় আপেল ডাঁই করে ফেলে রেখে, কপাল চাপড়াচ্ছেন৷ ফল পরিবহণের জন্য কোথাও কোথাও ট্রাক মিললেও ভাড়া এত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে তা চাষিদের পক্ষে নেওয়া মুশকিল৷ অনেক ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া দিয়ে ট্রাক নেওয়া হলেও রাস্তা অবরোধের কারণে ট্রাকের মধ্যেই ফল নষ্ট হয়ে গেছে৷
এই অবস্থায় ৭ নভেম্বর গোটা উপত্যকা জুড়ে ভারি তুষারপাত, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে৷ তুষারপাতে আপেল গাছের এত ক্ষতি হয়েছে যে, আগামী ৩–৪ বছর ভাল ফলন হবে না৷ অর্কিড ফুলেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে৷ জাফরান গাছের এত ক্ষতি হয়েছে যে চাষিরা বলছেন, উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশও হবে না৷ এত ক্ষয়–ক্ষতি সত্ত্বেও কাশ্মীরকে দুর্যোগ কবলিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি৷ এমনকি ক্ষতির কোনও সমীক্ষাও করা হয়নি৷ শুধু কৃষক নন, পশুপালকরাও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন৷ এ বছর উপত্যকা জুড়ে কার্যত শোকের ছায়া৷ শ্মশানের মতো নিঃস্তব্ধতা৷ শান্তি নেই৷ আনন্দ নেই৷ এবার বকরঈদ মানুষ নমো নমো করে সেরেছেন৷ ফলে ছাগল–ভেড়ার বিপণনও মার খেয়েছে৷ সব মিলিয়ে কাশ্মীরের অর্থনীতি বিপন্ন৷
কাশ্মীর সফর করে প্রতিনিধিবৃন্দ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানান– কাশ্মীরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত ঘোষণা করে জাতীয় বিপর্যয় রিলিফ তহবিল থেকে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, হর্টিকালচার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ক্ষয়–ক্ষতির সমীক্ষা করতে হবে৷ প্রতিনিধিবৃন্দ জম্মু–কাশ্মীরের কৃষকদের এই দুর্দশায় তাঁদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন৷ তাঁরা বলেন, অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কো–র্ডিনেশন কমিটি দেশব্যাপী যে আন্দোলন করছে, সেই আন্দোলনে কাশ্মীরের কৃষকরাও সামিল হোন৷ প্রতিনিধি দলে ছিলেন কমিটির কনভেনর– ভিএম সিং, রাজু সেট্টি (স্বাভিমানী খেতকারী সংগঠক), যোগেন্দ্র যাদব (জয় কিষান আন্দোলন), কৃষ্ণ প্রসাদ (এআইকেএস), প্রেম সিং গেহলট (অল ইন্ডিয়া কিষান মহাসভা), সত্যবান (অল ইন্ডিয়া কিষান খেতমজদুর সংগঠন), স্বস্তিক (স্বাভিমানি খেতকারী সংগঠন)৷