ভোটের বাজারে নানা সূত্র ধরে বেরিয়ে আসছে স্বঘোষিত দেশসেবকদের রকমারি কীর্তিকলাপ৷ নানা গণমাধ্যমের কেউ শাসক দলের সাংসদ–মন্ত্রী–নেতাদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিবৃদ্ধির তথ্য ফাঁস করছেন, তো কেউ সরকারি দুর্নীতির গোপন দলিল সামনে আনছেন৷ আবার কেউ স্টিং–পারেশন চালিয়ে প্রকাশ করছেন ভোট–মাফিয়াদের স্বরূপ৷ আর সাধারণ মানুষ বলছে, আর কত দেখব কত শুনব এবার তো ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে বাস্তবেই, ভোটবাজ দলগুলোর নেতাদের কাজ–কারবার দেখে মানুষ আর শুধু হতবাক বা হতাশ নয়, তাদের সব হিসাবপত্র গুলিয়ে যেতে বসেছে৷ বাজারে আলু–সব্জি–চাল–ডালে দাম আকাশছোঁয়া৷ নিম্নবিত্ত এমনকী মধ্যবিত্তের বৃহদংশও দুটো পয়সা বেশি রোজগারের জন্য হা–পিত্যেশ করছে৷ আর সরকারি গদির স্বপ্নে মশগুল নেতারা ভোট কেনার জন্য হরিলুটের বাতাসার মতো টাকা–মদ ইত্যাদি ছড়াচ্ছে৷ ভোট প্রার্থীরা নিজেরাই বলছেন, একটা এমপি সিট জিততে নাকি তাঁরা ৫ থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেন এবং এবারে সেটা দাঁড়াবে আরও বেশি৷ একটি টিভি চ্যানেলের করা স্টিং অপারেশনের গোপন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে, বিজেপি–র এক সাংসদ বলছেন, বড় নেতার মিটিং করতে এক কোটি টাকার উপরে খরচ হয়৷ আরেকজন সাংসদ নির্বিকারে বলছেন, কালো টাকা ছাড়া ভোট লড়া যায় না৷ বিজেপি প্রার্থী মধ্যপ্রদেশের নেতা ফগ্গন সিং কুলস্তে জানিয়েছেন, ‘তিনি গতবার ১২ কোটি টাকা খরচ করেছেন৷ এ বার ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা খরচ করতেও তৈরি৷ বিহারের সমস্তিপুরের সাংসদ রামচন্দ্র পাসোয়ানও জানিয়েছেন, তিনি গতবার পাঁচ কোটি খরচ করেছেন৷ ছয় সাংসদের জন্য দল ৫০ কোটির মতো খরচ করেছে৷ সপা’র সাংসদ মিথিলেশ কুমারের আসন এবার বসপা’য় চলে গিয়েছে৷ তিনি ৬ কোটি টাকা দিয়ে আসন কিনেছেন বলে স্বীকার করেছেন৷
টাকা খরচের কার্যকলাপে দলে–দলে আদতে কোনও ভেদাভেদ নেই৷ সমস্ত পদ্ধতি হুবহু এক৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেশের শ্রমিক–কৃষক যখন ধুঁকছে–মরছে, দেশের কোটি কোটি যুবক যখন কর্মহীন, যেখানে অধিকাংশ ঘরে অর্ধাহার–নাহার, সেখানে নেতারা এই বিশাল পরিমাণ টাকা পায় কোথা থেকে? ধীরে ধীরে মানুষ বুঝে গেছে যে, ওই সব টাকার প্রায় নব্বই ভাগই কালোটাকা৷ এর জোগান দেয় মূলত বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা৷ এসব থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, দেশে কালো টাকা বহাল তবিয়তে বিরাজমান এবং নোটবন্দি ছিল নির্ভেজাল ধাপ্পা৷
ভোটবাজ নেতারা দেদার কালো টাকা নিয়ে দেশের বেকার বাহিনীর একাংশকে কেনে৷ তাদের বাইক–মোবাইল ফোন–মদ এবং নগদ টাকাও দেয়৷ বিনিময়ে তাদের দিয়ে ভোট নিয়ন্ত্রণ করায়৷ পাশাপাশি টিভিতে–কাগজে সর্বত্র লোকঠকানো বিজ্ঞাপন দেয়৷ এই ভাবে ভোট প্রক্রিয়ার উপর যে নেতা যত নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে, সে–ই জেতে৷ জেতার পর যে বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন তাদের নানা সরকারি সুযোগ–সুবিধা, কোটি কোটি টাকার টেন্ডার ইত্যাদি কারচুপি করে পাইয়ে দেয়, যাতে ভোটের আগে দেওয়া টাকার দশ–বিশ–পঞ্চাশ গুণ বেশি তারা তুলে নিতে পারে৷ এছাড়াও তারা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে টাকা তুলে নেয়৷ সরকার তাদের ট্যাক্স ছাড় দেয়৷ এই সবই চলে৷
এই কারণেই, ইদানীং বহু চোরডাকাত–মাফিয়া থোক টাকা দিয়ে এমএলএ–এমপি এমনকী কাউন্সিলার–পঞ্চায়েত প্রতিনিধির সিটও কিনে নেয়৷ ২০১৯–এর লোকসভা ভোট কোন জাদুতে তার ব্যতিক্রম হবে? ফলে, যে সাংবাদিক যখন যা খোঁজ পাচ্ছেন সেগুলোর কিছু কিছু প্রকাশিত হচ্ছে৷ মানুষ জানে, সেগুলি হিমশৈলের চূড়ার মতোই৷ ভোটবাজারের রাঘববোয়ালদের যাবতীয় জালিয়াতি প্রকাশ্যে কখনই আনতে পারে না তথাকথিত মিডিয়াগুলি৷ কেন না সেগুলিও কোনও না কোনও ভাবে চলে কর্পোরেট মদতেই৷ তারা ততটুকুই প্রকাশ করে যতটুকু তার বাজার ধরার জন্য প্রয়োজন৷
তাহলে কি এটাই ভবিতব্য? না৷ যথার্থ ভাবে কালোটাকার প্রসার, তা দিয়ে গণতন্ত্রকে, নির্বাচনকে স্রেফ প্রহসনে পরিণত করার শয়তানি শুধু প্রকাশ করা নয়, পুরোপুরি আটকেও দিতে পারে একমাত্র জনগণ৷ সচেতন, ঐক্যবদ্ধ এবং মর্যাদাসম্পন্ন জনগণের আন্দোলন।