একেবারে পথের পাশের মানুষের জীবন সংগ্রাম অনুসন্ধান করে, শ্রদ্ধা জানিয়ে, ভালোবেসে যিনি ঠাই দিয়েছেন তাঁর সাহিত্যে, অত্যন্ত যত্নের সাথে এক একটি চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকে কালজয়ী করে উপস্থাপিত করেছেন আমাদের কাছে অনুপ্রেরণার জন্য, মানুষ হবার উপাদান সংগ্রহের জন্য, তিনি আমাদের সকলের প্রিয় পার্থিব মানবতাবাদী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি জীবনকে কেন্দ্র করে যে ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি হয়, মানুষের সম্পর্কের মধ্যে যে জটিলতা গড়ে ওঠে, মানুষের মনে যে অনুভূতি এবং হৃদয়াবেগ জন্ম নেয়, তার উপরে ক্রিয়া করে সূক্ষ্ম রসের উপলব্ধি ঘটিয়ে এবং ব্যথা-বেদনা জাগিয়ে দিয়ে মানুষের মনে ভারী তত্ত্বগুলোকে গেঁথে দিতে চেয়েছেন।
একটি সাহিত্য সভায়় যোগ দেওয়ার আবেদন নিয়ে আসা এক ছাত্র তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার সাহিত্যে পতিতা স্থান পেয়েছে। এর কোনও বিশেষ কারণ আছে কি? এ কথা শোনার পর শরৎচন্দ্র আনমনা হয়ে পড়েন এবং তাকে বলেন, ‘বিশেষ কারণ যে কি তা আমি জানি না। তবে আমি অনেককে জানি, নিজের চোখেও দেখেছি, তাদের অনেকের মধ্যে এমন কিছু আছে যা অনেক বড় ও মহৎ লোকের মধ্যে নেই। ত্যাগ, ধর্ম, দয়া, মায়া, প্রেম, ভালোবাসা মানুষের যতগুলি ভালো গুণ আছে তার কোনওটারই অভাব তাদের চরিত্রে নেই। ভদ্রতার মোহে পড়ে একথা অস্বীকার করলে বড় অধর্ম হবে। কোনও মানুষের সবটাই কালো, নোংরা, শোধরাবার মতো কোনও বস্তুই তার কাছে নেই, তা হতে পারে না।’ প্রিয় বন্ধু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে একদিন বলেছিলেন, ‘আমি বেশি পড়াশোনা করিনি, আমার জ্ঞানবুদ্ধিও তেমন বিশেষ কিছু নেই। আমার লেখা অনেকে পড়তে ভালোবাসে তার কারণ বোধহয় এই যে, আমি যেটুকু লিখেছি তা আমার চোখে দেখা ও অনুভূতির রসে ভেজা।’ অত্যন্ত বিশ্বাসের সাথে বলতেন, ‘পূর্বের মতো রাজা-রাজড়া জমিদারের দুঃখ-দৈন্য-দ্বন্দ্বহীন জীবন ইতিহাস নিয়ে আধুনিক সাহিত্যসেবীর মন ভরে না। তা নিচের স্তরে নেমে গেছে। এটা আফসোসের কথা নয়। বরঞ্চ এই অভিশপ্ত অশেষ দুঃখের দেশে নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ-সাহিত্যের মতো যেদিন সে আরও সমাজের নিচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ, দুঃখ, বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন এই সাহিত্য সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।’
দারিদ্রের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছেন। লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারেননি, কিন্তু জীবনের পাঠশালায় অভিজ্ঞতার ঝোলাটি তিনি এমনভাবে ভরে তুলেছিলেন তা দিয়ে মানুষকে চেনবার, বোঝবার অপরিসীম ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন। মানুষকে তিনি যতটা চিনতেন তার চেয়ে অনেকগুণ তাদের তিনি ভালবাসতে পারতেন। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসার স্রোতধারা এমনি করেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকেও প্রভাবিত করেছিল। সেই সময়ে দেশবন্ধুকে কংগ্রেসের মধ্যেই নানাভাবে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একটি মঞ্চে সভার সভাপতি শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীকে দেশবন্ধু রুলিং সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে শ্যামবাবু অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন , “I won’t hear that man.”দেশবন্ধুর চোখ দুটো অভিমানে জ্বলে উঠলো। শরৎচন্দ্র রেগে গিয়ে বললেন, ‘শ্যামবাবু আপনি দেশবন্ধুকে ‘That man ‘ বললেন, ‘That gentleman’ পর্যন্ত বলতে পারলেন না?’ শ্যামবাবু তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত হয়ে শরৎচন্দ্রকে বললেন,”I can’t stand your face.” শরৎচন্দ্র অপমান সহ্য করতে পারলেন না। রাগে গরগর করতে করতে তিনি সভা ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলেন। বাসায় ফিরে এসে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে দারুণ ক্রোধের সাথে দেশবন্ধুকে বললেন, ‘যে রাজনীতি ভদ্রলোককে এমন ভাবে অপমান করে তাতে আমি আর নেই।’ দেশবন্ধু শরৎচন্দ্রের একটি হাত নিজের হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাই করুন শরৎবাবু, এবারে আপনি ছেড়ে দিন। আপনি সাহিত্যিক, শিল্পী মানুষ আপনার অনুভূতি বড় ডেলিকেট। এত ব্যথা আর অপমান আপনার সহ্য হবে না।….. আপনি কংগ্রেস আর পলিটি’ একেবারে ছেড়ে দিন।’ শরৎচন্দ্র একটি চেয়ারে বসলেন। বুকের ভেতর থেকে এক গভীর ব্যথা অনুভব করে তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনার এই অসহায় অবস্থা, চারিদিকে এই বাধা বিদ্রুপের বেড়াজাল, এর মধ্যে আপনাকে বিসর্জন দিয়ে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করি কী করে? আমাদের ব্যথা তো নিতান্তই সামান্য, কিন্তু আপনি যে দুঃখের মহার্ণব হয়ে রয়েছেন। না, আপনাকে ছেড়ে পালাতে পারবো না।’
এই ভাবেই এই মহান শিল্পী শুধু সাহিত্যে নয়, বাস্তব জীবনেও মানুষকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে পেরেছেন এবং আমাদেরকেও সেই পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। আর দিয়ে গেছেন মানুষকে চিনবার, বোঝবার এক অনন্য বিচারধারা। এই মহান শিল্পীর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
গৌতম দাস , মালদা