১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব সংবাদপত্রের প্রথম দু-পাতা জুড়ে ছাপা হয়েছে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিজের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞাপন। শিরোনাম ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’।
নিজেকেই নিজে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করে তিনি লিখেছেন, ‘… আমি শিক্ষা থেকে চাকরি, স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে আবাসন এবং খাদ্য থেকে সামাজিক সুরক্ষা– এই সবক’টি ক্ষেত্রেই এমন কিছু প্রকল্প তৈরি করেছি যা আপনার জীবনকে একটি সামগ্রিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখবে, তা হল আমার ‘সুরক্ষা কবচ’। তারপর রাজ্যবাসীর সুরক্ষা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি বা আপনার পরিবার আমার সুরক্ষা কবচের আওতায় যে সদা সুরক্ষিত আছেন তা নিশ্চিত করার জন্য আমি আমার বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে আমার দূত আপনার বাড়িতে প্রেরণ করছি। … আমি পূর্ণ আশ্বাস দিচ্ছি যে আপনার সমস্ত অভাব-অভিযোগ আমি ব্যক্তিগত স্তরে শুনব এবং তা সমাধান করব।’
ইতিমধ্যেই ‘দিদির দূত’রা গ্রামে গ্রামে, বাড়ি বাড়ি যাতায়াত শুরু করে দিয়েছেন। তাঁরা যে ক্ষোভের সামনে পড়ছেন, তার সংবাদও খবরের কাগাজের প্রথম পাতায় রোজই ঠাঁই নিচ্ছে। এই সুরক্ষা কবচ কী? তা হল, রাজ্য সরকারের ১৫টি প্রকল্প। সেই প্রকল্পগুলির কয়েকটি– লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কৃষক বন্ধু, বিধবা ভাতা, মানবিক পেনশন, জয় বাংলা, যুবশ্রী, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, স্বাস্থ্যসাথী, আবাস যোজনা ইত্যাদি।
এখন দেখা যাক, তাঁর নানা ‘সুরক্ষা কবচ’ জনগণকে কেমন সুরক্ষা দিচ্ছে। দিদির সুরক্ষার আওতায় ‘শিক্ষা থেকে চাকরি’র কথা বলা হলেও এই প্রকল্পগুলিতে কোথাও চাকরির কোনও প্রকল্পই খুঁজে পাওয়া গেল না। চাকরিই নেই, তার আবার সুরক্ষা!
কন্যাশ্রী, ঐক্যশ্রী, শিক্ষাশ্রী– এই তিনটিই শিক্ষা সংক্রান্ত। অথচ ঠিক এই সময়েই শিক্ষকের অভাবে গ্রামে গ্রামে সরকারি স্কুলগুলি উঠে যাওয়ার অবস্থায়। শহরেও সরকারি স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ নেই। গরম-ঠাণ্ডা-করোনা-উৎসব ইত্যাদি নানা কারণে স্কুল ছুটি দিয়ে দিদি বড়ই আনন্দ পান। হয় কথায় নয় কথায় সরকারি স্কুল ছুটি করে দেওয়ায় বেসরকারি স্কুলের দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা। সরকারি স্কুলগুলি ছাত্রাভাবে ধুঁকছে। শিক্ষার সুরক্ষা তো বহু দূর, রাজ্যে স্কুলগুলিরই সুরক্ষা। এই কার্ড যে ছাত্রদের পড়ার খরচ পরিবারগুলির বইতে না পারাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সে খেয়াল নেই। তাঁর সাধের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড-এর মন্ত্র হল– পড়াশোনা করতে হলে ঋণ করো। স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে না হয় গরিব ছাত্ররা পড়াশোনা করবে, কিন্তু পড়ার শেষে চাকরি পাবে কি? না পেলে সুদ সহ ঋণের টাকা শোধ দেবে কী করে? সেই উত্তর দিদির সুরক্ষা কবচে নেই। কেন্দ্র রাজ্য দুই সরকারেরই নীতি হল– শিক্ষা পাবে, যদি তা কেনার মতো পয়সা পকেটে থাকে। আসলে এ হল কর্পোরেট মালিকদের শিক্ষা ব্যবসায় কবচ বাঁধা, তাদের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি নামক দোকান থেকে সার্টিফিকেট কিনবার খদ্দের জোগানো। এর সাথে জনস্বার্থের কী সম্পর্ক?
স্বাস্থ্যসাথীতে যে টাকা খরচ করছে দিদির সরকার, সেই টাকা যদি রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায়, সরকারি হাসপাতালগুলির উন্নতি সাধনে এবং ওষুধ সরবরাহে খরচ করত তা হলে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসার রমরমা অনেকটাই কমানো যেত। সেই পথে না হেঁটে দিদি বিমাভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করলেন স্বাস্থ্যসাথীর নামে। অসুস্থ হয়ে সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাওয়ার সুরক্ষা বাতিল করে দিদির সরকার বলছে– অসুস্থ হলেই চিকিৎসা পাবে না, পাবে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকলে। খোলা বাজারের মূল্যে কিনতে হবে পরিবারের সকলের জন্য বছরে মোট ৫ লক্ষ টাকা মূল্যের চিকিৎসা। আর সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থার ফলে সকলকেই শরণ নিতে হবে বেসরকারি হাসপাতালের। সেখানে চলবে স্বাস্থ্য-ডাকাতি। হয়ত পরিবারের বয়স্ক একজনের চিকিৎসাতেই ৫ লক্ষ টাকা শেষ। তারপর পরিবারের বাকি সদস্যদের কেউ অসুস্থ হলে? ‘কড়ি ফেলে চিকিৎসা করাও’। সকলের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা তবে রইলো কোথায়?
বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা (দিদির ভাষায় ‘মানবিক পেনশন’) দিদি সরকারে আসার আগে থেকেই চালু থাকলেও তিনি দাবি করেছেন– তাঁর স্বপ্নই নাকি এ সব প্রকল্প আনতে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিধবা ভাতার ক্ষেত্রে দিদির বক্তব্য হল, যাদের পারিবারিক আয় ১ হাজার টাকার কম, তাদের মাসে ১ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান। তফসিলি জাতি ও উপজাতির প্রবীণদেরও মাসে ১ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া। চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এ কেমন সুরক্ষা?
পশ্চিমবাংলার মাত্র এক লক্ষ বেকার যুবক যুবতীকে তিনি যুবশ্রী প্রকল্পের আওতায় এনে এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত করার দাবি করেছেন। তাদের এমপ্লয়মেন্ট কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী তাদের মাসে দেড় হাজার টাকা ভাতা দেবেন। এই সামান্য টাকায় তাদের কী হবে? এছাড়া বাকি প্রায় এক কোটি বেকারেরই বা ভবিষ্যৎ কী? তাদের জন্যে কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা তিনি করেছেন?
সুরক্ষার অন্যতম প্রকল্প আবাস যোজনার দুর্নীতি নিয়ে দিদির দল এখন একেবারে ল্যাজে-গোবরে অবস্থায়। পঞ্চায়েতের প্রধান দোতলা বাড়ির মালিকের নাম আবাস যোজনার তালিকায়, অথচ গৃহহীনেরা বঞ্চিত– এই ঘটনা তো অসংখ্য। কেন্দ্রীয় প্রকল্প হলেও রূপায়ণের দায়িত্বে রয়েছে রাজ্য সরকার। তাতে এমন কাণ্ড যে, যাঁরা যথার্থ গরিব বলেই ঘর পাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকেও ‘দূত’রা কাটমানি খায়!
এই প্রকল্পগুলি সবই চলছে সরকারি টাকায়। সরকারের প্রধান দিদি নিজেই। কিন্তু সরকারি প্রকল্পের কাজ নিয়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে কি না তা দেখভাল করবার জন্য সরকারি আধিকারিকদের না পাঠিয়ে তিনি তাঁর দলের ‘বিশ্বস্ত’ প্রতিনিধিদের ‘দূত’ হিসেবে পাঠাচ্ছেন কেন? হতে পারে– যাঁদের তিনি পাঠাচ্ছেন তারা তাঁর বিশ্বস্ত। কিন্তু তাঁরা জনগণের বিশ্বস্ত কি? ক’দিন আগের দিদির বিশ্বস্ত, তাঁর চারদিকে ঘোরাফেরা করা লোকগুলো অনেকেই আজ জেলের গরাদের ওপারে। অনেকে জামিন পেয়ে বেরিয়ে এলেও মামলা চলছে। অনেকেই তদন্তের ফাঁস থেকে বাঁচতে দল ছেড়ে ভিড়েছেন বিজেপিতে। তাঁরা জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাই দিদির বিশ্বস্ত হলেও তাঁরা কোনও ভাবেই জনগণের বিশ্বস্ত নন।
আসলে, যখন শিক্ষক নিয়োগে দিদির বিশ্বস্তরা চরম দুর্নীতি করেছে, আমফান সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি করেছে, আবাস যোজনা নিয়ে দুর্নীতি করেছে, ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি করেছে, যে কোনও সরকারি প্রকল্পে কাটমানি খেয়েছে এবং এই বিশ্বস্তদের কাণ্ডকারখানায় দিদির দল যখন পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে তখন শিয়রে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাই জনগণের কাছে যে কোনও উপায়ে যাওয়াটা তাঁর কাছে এখন বিরাট বাধ্যবাধকতা। তিনি জানেন, মানুষ তাঁর দলের এই ‘বিশ্বস্ত’দের কী রকম ঘৃণা করেন। আদ্যোপান্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই দলকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি তাই মরিয়া। তাঁর দূতদের জনগণ শুধু মনে মনে অভিশাপ দেবেন না, প্রকাশ্যে বহু জায়গায় তাদের গালিগালাজও শুনতে হবে, বাধা পেতে হবে। এই ‘দূত’দের সুরক্ষা দিতে দিদি আজ এই বিজ্ঞাপনকে আশ্রয় করছেন।
এই বিজ্ঞাপনে তিনি আজব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদি সত্যিই সাধারণ মানুষ তাঁদের অভাব-অভিযোগ জানাতে পারেন, তা হলে সারা পশ্চিমবাংলায় দিদির দূতেরা ঘুরে কত লক্ষ লক্ষ অভিযোগ পেতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। তা সত্বেও তিনি বলেছেন, ‘আমি পূর্ণ আশ্বাস দিচ্ছি যে আপনার সমস্ত অভাব অভিযোগ আমি ব্যক্তিগত স্তরে শুনব এবং তা সমাধান করব।’ কী করে তিনি এই লক্ষ লক্ষ অভাব অভিযোগ ব্যক্তিগত স্তরে শুনবেন? মাঝে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচিতেও যেমন সাধারণ মানুষ কিছুই বলতে পারেননি– এটাও আর একটা বিরাট ধাপ্পা নয় কি!
যে প্রকল্প নিয়ে দিদির সুরক্ষা কবচ, সেই প্রকল্পগুলি সম্পর্কে একটা বিষয় আমাদের গভীর ভাবে ভাবতে হবে। তা হল, বিভিন্ন রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার সামাজিক সুরক্ষার নামে এই প্রকল্পগুলি চালু করছে কেন? এর উত্তর খুঁজতে হলে সাম্প্রতিক অতীতের কিছু ঘটনার দিকে নজর দিতে হবে। অনেকেরই মনে পড়বে, কয়েক বছর আগে আমেরিকায় ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের কথা। যাঁরা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন কারখানার ও অফিসের ছাঁটাই শ্রমিক, কর্মচারী, বেকার কর্মহীন মানুষজন। বেঁচে থাকার কোনও উপায়ই তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না এবং সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলিও তাঁদের দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করছিল না। অসংগঠিত এই মানুষগুলি মূলত সোসাল মিডিয়ার দ্বারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে মার্কিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিটে হাজির হয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন করেছেন, ‘পুঁজিবাদ ধবংস হোক’ আওয়াজ তুলেছেন। স্লোগান তুলেছেন– ওয়াল স্ট্রিটের পরিচালকরা এক শতাংশ এবং বাকি জনসাধারণ ৯৯ শতাংশ, তাদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা দিতে হবে। আমেরিকার পুঁজিপতি, শিল্পপতিদের কাছে এ এক অশনি সংকেত। তাই সবহারা এই মানুষগুলিকে শান্ত করতে তাদের দেশের বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা প্রস্তাব আনল ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’-এর। অর্থাৎ যাদের কিছু নেই, তাদের বাঁচার জন্য কিছু টাকা ধরিয়ে দাও।
শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতেও এই দাবিতে তীব্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে। সেই দেশগুলোও আজ কর্মহীন মানুষগুলির জন্য ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম-এর নামে কিছু প্রকল্প চালু করছে। ভারত সহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও বেকারি বাড়ছে, অভাব দারিদ্র বাড়ছে, অভাবের কারণে আত্মহত্যা বাড়ছে ভয়াবহ হারে। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে দেশের রাষ্ট্রপতিকে দেশছাড়া করে জনগণ রাষ্ট্রপতি ভবনটাই ক’দিন দখল করে বসে রইল। বিক্ষোভের চাপা আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে ভারতের মানুষের মধ্যেও। যে কোনও একটা বিষয় নিয়েই মাঝে মাঝে আন্দোলন আছড়ে পড়ছে– তা সে নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ড নিয়েই হোক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না হাজারের আন্দোলনে সামিল হওয়া নিয়েই হোক বা তিনটি কৃষি আইন নিয়েই হোক। এসব আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি এ দেশের শাসক শ্রেণির নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না। তারাও প্রমাদ গুনছে। তাই ভারতের লোকসভাতে ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে ৪০ পৃষ্ঠার ইকনমিক সার্ভে রিপোর্টেও ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। তখন বা তার কিছুটা আগে থেকেই বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার সামাজিক সুরক্ষার নামে এই ধরনের কিছু প্রকল্প চালু করেছে।
ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের জন্য সরকারের অর্থের যোগান হবে কী করে– সেই পরামর্শ আমাদের দেশের বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা সরকারকে দিয়ে রেখেছে। তাদের পরামর্শ হল– জনগণের জন্য ভর্তুকি ছাঁটাই কর, পেনশন বন্ধ কর, পুরানো স্থায়ী সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে বাতিল কর। জনগণকে দেওয়া সুরক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে সেখান থেকে যা সাশ্রয় হবে তার থেকে কিছু টাকা ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম-এর নামে দরিদ্র জনগণের দিকে ছুঁড়ে দাও। তাই বিদ্যুতে, গ্যাসের দামে, ডিজেল-পেট্রলে, সারে, রেশনে, খাদ্যে ভর্তুকি ক্রমাগত কমছে। তার সাথে ট্যাক্স বাড়িয়ে বিপুল অর্থ এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তারই সামান্য অংশ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, আবাস যোজনা, বিধবা ভাতা ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষার নামে দেওয়া হচ্ছে। তাই এ রাজ্যে শুনতে পাওয়া যায়– ‘যাই হোক না কেন, দিদি কিছু তো দিচ্ছে’। এই প্রতারণাটা অনেকেই ধরতে পারছেন না। দিদি যে চাকরি না দিয়ে, কৃষকের ফসলের ন্যায্য নাম দাম না দিয়ে, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি পাওয়ার উপায় না করে এক একটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ব্যাপক ঢাক পিটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনুসারী নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার নানা পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন তার কারণ এখানেই। এই অভাবী মানুষগুলোকে তিনি অধিকার সচেতন হতে না দিয়ে, আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে এনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, মান-অভিমান মনের মধ্যে চেপে রেখে সামান্য কিছু পাওয়ার আশায় নেতাদের দুয়ারে হাত কচলানো উমেদারের স্তরে নামিয়ে আনতে সফল হচ্ছেন।
এই ধরনের প্রকল্পের পরিধি যত বাড়ে, বুঝতে হবে সে দেশের মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ তত কমছে। আজকের সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গণবিক্ষোভ থেকে বাঁচাতে এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা ছাড়া বুর্জোয়া সরকারগুলির আর কোনও উপায় নেই। তাই জনগণকে বুঝতে হবে, সরকার এই ধরনের প্রকল্প যা-ই চালু করুক না কেন, তা আসলে মানুষকে মর্যাদা নিয়ে নিজের শ্রমের ভিত্তিতে উপার্জন করে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পরিবর্তে অন্যের অনুকম্পায় কোনও রকমে টিকে থাকার দিকেই ঠেলে দেওয়া। সত্যিকারের মানুষের মতো মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে হলে চাই সকলের জন্য কর্মসংস্থান– যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দিতে পারে না। সে জন্য বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা আজ জরুরি প্রয়োজন।
তাই দিদির সুরক্ষা কবচ নয়, সুরক্ষা কবচের তদারকিতে দিদির দূত নয়, চাই সকলের জন্য উপযুক্ত বেতন সহ কর্মসংস্থান। এই কর্মসংস্থান যদি সকলের জন্য হয়, তা হলে আর কোনও সুরক্ষা কবচ বা মাদুলি কাউকে ঝোলাতে হবে না। এই দাবিতেই সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে সামিল হতে হবে।