রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে এখন থেকে বসবেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়েছে এই সিদ্ধান্ত। তিনি হবেন উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ প্রশাসক। তিনিই সরাসরি উপাচার্যদেরও নির্বাচন করবেন। উচ্চশিক্ষার নীতি নির্ধারণে তিনিই হবেন প্রথম ও শেষ কথা। বলা যেতে পারে শিক্ষাক্ষেত্রের একেবারে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসবেন তিনি।
এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষক, অধ্যাপক অধ্যক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সকলের ক্ষেত্রেই অ্যাকাডেমিক বিষয় সহ কোনও ব্যাপারে স্বাধীন মত প্রকাশ কিংবা অবাধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের রাস্তায় নতুন করে বাধা তৈরি হবে। একই সাথে শিক্ষাক্ষেত্রের গণতান্ত্রিক বডিগুলোকে সরকারের ইচ্ছাতেই চালানো এবং পরিচালনায় সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিপদ বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের যেটুকু ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট আছে, এর ফলে তাও সম্পূর্ণ লুপ্ত হবে। উপাচার্য থেকে অধ্যাপক, পরিণত হবেন সরকারের আজ্ঞাবহ কর্মচারীর স্তরে। একই সাথে বিনষ্ট হবে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা এই কাজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী যদি পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হন, রাজ্যপাল যদি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়ি ঘোরাতে পারেন, তা হলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? যে কোনও বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বোঝেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালনের একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি হতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন এবং পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোনও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাজ্যপাল শিক্ষাবিদদের মাথায় বসে ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করলে রাজ্য সরকারকেও সেটাই করতে হবে, এটা আর যাই হোক, সু-যুক্তি হতে পারে না। যে কথা সাধারণ মানুষ বোঝেন তা সরকারের বড় বড় নেতা-মন্ত্রীরা বোঝেন না, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! আসলে রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব কিছু বুঝেই– যাতে পাঠ্যসূচি তৈরি থেকে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, এক কথায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত প্রশ্নে এখন সরকারের মন্ত্রী এবং আমলাদের নির্দেশই শিরধার্য বলে গ্রহণ করতে শিক্ষাবিদরা বাধ্য হন।
কী ক্ষতি এতে? ক্ষতি অনেক গভীরে। শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্র কায়েম হলে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং মানুষ তৈরি হওয়ার পরিবেশটাই ধ্বংস হয়। শিক্ষার স্বাধিকারের প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ শিক্ষা যদি স্বাধীন হতে না শেখায়, প্রশ্ন তুলতে না শেখায়, বরং শাসকের ধামাধরা হতে শেখায় তা হলে তাকে শিক্ষা বলা চলে না। জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থাকে শাসকের দ্বারা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়েছেন এ দেশের এবং সব দেশের নবজাগরণের পথিকৃৎ মনীষীরা। তাঁদের দীর্ঘ প্রচেষ্টা ছিল শিক্ষায় সরকার আর্থিক দায়িত্ব নেবে, কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে অ্যাকাডেমিক কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। সেই চিন্তাকে আজ নস্যাৎ করা হচ্ছে।
এস ইউ সি আই (সি) দলের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে দলের রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপাল নয়, আচার্য পদে শিক্ষাবিদদের বসাতে হবে।’ এ রাজ্যে বারবার দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্তই হোক, কিংবা স্কুলের বদলে পাড়ায় শিক্ষালয়ের উদ্ভট ঘোষণা হোক, শিক্ষার বিষয়ে কোনও শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অধ্যাপক, উপাচার্য, অভিভাবক ছাত্র সহ শিক্ষার সাথে যুক্ত কোনও স্তরের মানুষেরই মতামত নেওয়ার তোয়াক্কা রাজ্য সরকার করেনি। বিষয়টা এত নগ্ন যে শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত বলে থাকেন–সবই মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা! ফলে শিক্ষার প্রতিটি সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁকে চারপাশে ঘিরে থাকা আমলাদের মাথা নাড়ার উপরই যেন নির্ভর করছে। শিক্ষাদপ্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের কাজ এখন শুধু নবান্নের ঘোষণার পর তাতে স্ট্যাম্প মারা!
গত ২৭ এপ্রিল হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তাপপ্রবাহের কারণে ২ মে থেকে স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হবে। সাধারণ পরিবারের ছাত্রদের স্কুলে আসার অভ্যাসে আবারও ছেদ পড়ল। ছুটির দাবি কিন্তু কেউ তোলেনি। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছিল, মে মাসের শুরুতে বৃষ্টি হবে। অথচ স্কুল ছুটি দেওয়া হল ৪৫ দিন। প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠন বিপিটিএ এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছে। বোঝাই যায় এই শিক্ষকদের সামান্য মতটুকুও সরকার নেয়নি। আশার কথা কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের এসব তুঘলকি পরামর্শে কান না দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয়, উত্তরবঙ্গে ওই সময় প্রবল বৃষ্টি। খবরের কাগজে ছবি বেরোল জলপাইগুড়িতে ছাত্রছাত্রীরা সোয়েটার পরে স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা দপ্তরের কোনও হেলদোল নেই। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী-আমলাদের নেই। এর ফলে শিক্ষার হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার উত্তর কে দেবে? শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং অবশ্যই মেরুদণ্ড-যুক্ত মানুষরা সঠিকভাবেই বলেছেন, এটা আসলে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ছাত্রদের অনীহা তৈরি করে তাদের বেসরকারি এবং অনলাইন শিক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়ার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। অভিভাবকরা শঙ্কিত– আগামী দিনে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে তো? শিক্ষক নিয়োগ আদৌ হবে তো, নাকি ছাত্র নেই এই অজুহাতে অনেক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হবে। যেমন ইতিমধ্যে বহু স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শিল্পপতিদের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব ছাড়ার পরিকল্পনা করছে রাজ্য সরকার তা রাজ্যবাসী জেনেছে।
সম্প্রতি দেখা গেল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও পুরোপুরি অনলাইনে ঠেলে দেওয়ার জন্য সরকারের বকলমে দায়িত্ব নিয়েছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। তাঁরা অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কিছু জায়গায় উপাচার্যদের উপর চাপ সৃষ্টি করে অনলাইন পরীক্ষার নোটিস করতে বাধ্য করেছে। অধ্যাপকরা বিরক্ত হলেও অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের দাপটের অসহায়। যে পদ্ধতিতে ছাত্রদের পড়াশোনা করার দরকার হয় না, শুধু বই খুলে লিখে প্রচুর নম্বর পাওয়া যায়, প্রয়োজনে শিক্ষকদের চাপ সৃষ্টি করে বেশি নম্বর আদায় করা যায়, তার নাম পরীক্ষা? শিক্ষকরা বলছেন, অনলাইন পদ্ধতিতে কোনও ভাবেই সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এর ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে, পড়াশোনার আগ্রহ কমছে। কিন্তু এসব নিয়ে ভেবে দেখার কোনও সদিচ্ছা সরকারের নেই। কী পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হবে তা নিয়ে শিক্ষকদের বলার যেন কিছু নেই! শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের মদতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোথাও ভাঙচুর, কোথাও ঘেরাও-অবরোধ, কোথাও উপাচার্যের দরজায় লাথি পড়লেও সরকার নীরব দর্শক। প্রচ্ছন্ন সরকারি মদতে এই বিশৃঙ্খলা রাজ্যবাসীকে হজম করতে হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের অধ্যাপক সংগঠন ওয়েবকুপাও অনলাইন পরীক্ষার পক্ষে সওয়াল করেছে। পরীক্ষার নামে এই প্রহসনের পুনরাবৃত্তির জন্য শাসক দলের চক্রান্ত দেখতে দেখতে সাধারণ ছাত্ররাও বিভ্রান্ত। উপাচার্য থেকে আধিকারিকরা বিস্ময়ে বিমূঢ়। এখন তাঁদের অধিকাংশের অবস্থা দাঁড়িয়েছে কেবল উপরতলার নির্দেশকে মান্যতা দেওয়া। এই উপরতলা বলতে কী বোঝায় তা প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা অধ্যাপকরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। না হলে হয়তো আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হতে হবে। এই ভয়ের কারণে তাঁরা শাসকদলের অনুগত ছাত্রদের ইচ্ছানুযায়ী অবলীলাক্রমে আত্মপ্রবঞ্চনা করে যাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী নীরব দর্শক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন নির্বাচিত ছাত্র-সংসদ নেই। সিনেট-সিন্ডিকেট নির্বাচন বন্ধ। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলগুলোকে কাজ করতে না দিয়ে সবই হয় নবান্ন, নয় বিকাশ ভবন নির্দেশ দিয়ে চালাচ্ছে। যদিও আশার কথা, সব শিক্ষক, অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় এখনও পুরোপুরি এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি।
দলতন্ত্র কংগ্রেস ও সিপিএম শাসনে
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষায় স্বাধিকার বিলোপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে কংগ্রেস সরকারের আমলেই। সে দিনের আগুনখোর কিছু কংগ্রেসী ছাত্র নেতা (পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী) গণটোকাটুকির অধিকারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়ে ছিলেন। ১৯৭৭-এ সিপিএম সরকার ক্ষমতায় এসেই শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্ত নির্বাচিত বডি ভেঙে দিয়েছিল। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগে তৈরি করেছিল নিরঙ্কুশ দলীয় নিয়ন্ত্রণ। সরকারি দলের কথা না মানায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেন পোদ্দারের হেনস্থার ছবি এ রাজ্য দেখেছে। সেদিন তাই শিক্ষায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ, স্বাধিকার ফিরিয়ে আনার দাবি তুলে ধরে শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা গড়েছিলেন ‘শিক্ষা সংকোচনবিরোধী স্বাধিকার রক্ষা কমিটি’। পথে নেমেছিলেন অরবিন্দনাথ বসু, সুকুমার সেন, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, নীহাররঞ্জন রায়, প্রমথনাথ বিশী, মনোজ বসু প্রতুল গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা।
গৈরিক দলতন্ত্র
শিক্ষাকে সমস্ত দিক থেকে বিপন্ন করে তোলার পদক্ষেপ শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রও একইভাবে নিয়ে চলেছে। কেন্দ্রের মোদি সরকার গণতান্ত্রিক সমস্ত পদ্ধতিগুলোকে নস্যাৎ করে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ কার্যকর করেছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষাকে চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের লক্ষে্য এবং উচ্চশিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ইউজিসিকে দিয়ে প্রতিনিয়ত একের পর এক সার্কুলার জারি করে চলেছে। কার ক্ষমতা বেশি, কে কত বেশি নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দেশের ছাত্রদের আরএসএস নির্দেশিত শিক্ষা গেলানো হবে, নাকি রাজ্যের শাসকদের অঙ্গুলিহেলনে শিক্ষা চলবে তারই মহড়া চলছে। শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষকদের মতামত ব্রাত্য।
এই সরকারগুলির পরামর্শদাতা কারা? দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিরা। তাই শিক্ষায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ তথা শাসক দলের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করার প্রবণতা কেবল একটি ঝোঁক নয়, ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কে ছড়ি ঘোরাবে, কে শিক্ষাকে দখল করবে, তা নিয়ে শাসকদলগুলির মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে।
শিক্ষাব্যবসায়ী একচেটিয়া পুঁজিমালিকরা তাদের অর্থ লোলুপতা নিয়ে নামছে শিক্ষার পরিসরকে দখল করতে। এর ফলে শিক্ষাক্ষেত্র যেন একদল ধান্দাবাজ অর্থলোলুপ দুর্নীতিগ্রস্তদের খোলা ময়দান হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার মর্মবস্তুকে মেরে দিয়ে তাকে বাণিজ্যে পরিণত করার লক্ষ্যে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তাকে প্রতিহত করতে শিক্ষানুরাগী মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।