70 Year 29 Issue 9 March 2018
ডেভিড রিকার্ডো তাঁর মহাগ্রন্থ ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যান্ড ট্যাক্সেশন’–এর সূচনায় বলেছেন, ‘কোনও পণ্যের মূল্য কিংবা যার সঙ্গে তার বিনিময় ঘটবে সেই পণ্যের পরিমাণ, তার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রমের আপেক্ষিক পরিমাণের উপর নির্ভর করে, সেই শ্রমের জন্য কম বা বেশি পরিমাণে দেয় ক্ষতিপূরণের উপর নির্ভর করে না৷’ মূল্যের যে ‘একটি মাত্র’ প্রকৃত পরিমাণ আছে, যেটা হল শ্রম, রিকার্ডোর এই বিরাট আবিষ্কার, মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’–এর সূচনাপর্ব রচনা করেছে৷ রিকার্ডোর মূল্যতত্ত্ব মার্কস কীভাবে পূর্ণাঙ্গ করেছেন এবং কিছুটা সংশোধনও করেছেন, এবং তার থেকে মুদ্রা ব্যবস্থার মতো এক তুমুল বিতর্কিত বিষয়ে প্রাঞ্জল, সহজ, যুক্তির শক্তিতে বলিষ্ঠ এক তত্ত্ব রচনা করেছেন সাধারণ বুদ্ধির অনেক রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদের কাছে যা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে আপাতত আমি তার আলোচনায় যেতে চাই না৷ যে মূল্য তত্ত্বের ভিত্তিতে মার্কস পুঁজির উৎস ও তার অবিরাম সঞ্চয় প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন, যা কেবল একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির হাতে জমে উঠেছে আমি কেবল সেই তাত্ত্বিক পদ্ধতির আলোচনায় নিজেকে সীমিত রাখব৷
ধরা যাক, সমস্ত পণ্যের বিনিময় খুবই ন্যায্যভাবে হচ্ছে৷ ধরা যাক, প্রতিটি ক্রেতা তার টাকার বদলে পণ্যে তার পুরো মূল্য পায় এবং প্রতিটি বিক্রেতা তার দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমের পুরো মূল্য টাকায় পেয়ে যায়৷ সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের অভ্যস্ত অনুমান অনুসারে প্রতিটি উৎপাদনকারী সেই দ্রব্য বিক্রয় করবে যার জন্য তার নিজের কোনও চাহিদা নেই এবং এর থেকে পাওয়া টাকায় কেবল সেই দ্রব্য কিনবে যা সে নিজে উৎপাদন করে না৷ এই রকম একটা অর্থনৈতিক দুনিয়ায় সবই চলবে খুব ভাল করে৷ কিন্তু প্রচলিত অর্থে যেমন বোঝায় সেইভাবে পুঁজির গঠনও চলতে থাকবে যথারীতি৷ একজন লোক টাকা জমাতে পারে, মালপত্র মজুত করে রাখতে পারে, কিন্তু সেটাকে তখনও সে পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে না৷ যদি না অবশ্য সেই টাকা কাউকে সুদের বিনিময়ে ধার দেয়৷ কিন্তু সেটা বহুকালের পুরনো রীতি হলেও আসলে একটা অত্যন্ত নিম্নস্তরের আদিম ধরনের পুঁজি মাত্র৷ এই ধারণার ভিত্তিতে মুনাফা অর্জন করার চিন্তা করাও অসম্ভব৷
কীভাবে মুনাফার উদ্ভব
কিন্তু আমরা দেখছি প্রতিদিনই মুনাফা হচ্ছে এবং কিছু লোক বিরাট মুনাফা করছে৷ তার কারণ ব্যাখ্যার জন্য যে লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফার উদ্ভব, তার ‘কাঠামো’র দিকে নজর দেওয়া দরকার৷ আমরা উপরে যাদের কথা বলেছি তারা হল স্বাধীন উৎপাদনকারী, যারা সামাজিক শ্রম বিভাজনের এক বিশেষ ব্যবস্থায় সেই দ্রব্য বিক্রয় করে যার জন্য তাদের কোনও চাহিদা নেই এবং সেইসব দ্রব্য নিজেদের ব্যবহারের জন্য কেনে যা তারা উৎপাদন করে না৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উৎপাদনকারী হল এমন একজন মানুষ যে বাজারে যায় পণ্য নিয়ে নয়, টাকা নিয়ে এবং যা তার দরকার তা না কিনে এমন সব দ্রব্য সে কেনে যা তার নিজের ব্যবহারের জন্য দরকার নেই৷ এক কথায় সে সেইসব দ্রব্য কেনে যা সে পুনরায় বিক্রয় করতে পারবে৷ কিন্তু ১০০ পাউন্ড দিয়ে ২০ টন লৌহপিণ্ড কিংবা ১০০ গাঁইট তুলা কিনে আবার ১০০ পাউন্ডে সেটা বিক্রয় করা নিতান্ত অসম্ভব৷ আমাদের ব্যবসায়ীদের সেইরকম কোনও অবাস্তব কাজ করতে দেখা যায় না৷ সে পণ্য কেনে ধরা যাক ১০০ পাউন্ডে, তারপর সেটা বিক্রয় করে ধরা যাক ১১০ পাউন্ডে৷ কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব হবে? আমরা এখনও অনুমান করছি যে, সমস্ত পণ্যের কেনা–বেচা হয় তাদের পূর্ণ শ্রম–মূল্যে৷ তা হলে এই ধরনের সমস্ত কেনা–বেচায়কোনও মুনাফা হতে পারে না৷ ক্রীত এবং বিক্রীত পণ্যের মূল্যে কোনও পরিবর্তন ঘটলে, যেমন তুলার দাম আমেরিকার গৃহযুদ্ধে চড়ে যাওয়ায়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কেন মুনাফা হয় তার অসংলগ্ন ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু পণ্যের মূল্যে সাধারণত কোনও বৃদ্ধি ঘটে না৷ তাদের গড় মূল্য ও দামের সাধারণত ওঠানামা ঘটতে থাকে৷ ফলে একবার যা লাভ হল পরের বার সেটা ক্ষতিতে দাঁড়ায়৷ সম মূল্যে বিনিময়ের যে অনুমান থেকে আমরা শুরু করেছি সেখানে মুনাফা অসম্ভব৷
বেশ, এবার ধরা যাক, বিনিময় সমান নয়৷ ধরা যাক প্রতিটি বিক্রেতা তার দ্রব্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশিতে বিক্রয় করতে পারে৷ তা হলে কোনও লোক বিক্রেতা হিসেবে যা লাভ করছে ক্রেতা হিসাবে সেটা আবার খোয়ায়৷ আবার দেখা যাক প্রতিটি ক্রেতা তার কেনা জিনিসের প্রকৃত মূল্যের ১০ শতাংশ কমে কিনতে পারে৷ তা হলে ক্রেতা হিসেবে সে যেটা লাভ করে বিক্রেতা হিসাবে সেটা তার হাতছাড়া হয়ে যায়৷
শেষপর্যন্ত ধরা যাক লোক ঠকিয়েই কেবল মুনাফা হয়৷ আমি ৫ পাউন্ডে যে এক টন লোহা বিক্রয় করলাম ধরা যাক তার আসল দাম ৩ পাউন্ডের বেশি নয়৷ সে ক্ষেত্রে আমি ২ পাউন্ডে ধনী আর আপনি ২ পাউন্ডে গরিব হয়ে গেলেন৷ কেনা–বেচার আগে আপনার ৫ পাউন্ড আর আমার লোহার মূল্য স্বরূপ ৩ পাউন্ড ছিল– দু’জনের মোট ছিল ৮ পাউন্ড৷ ব্যবসার পরে আপনার হাতে গেল ৩ পাউন্ড মূল্যের লোহা আর আমার হাতে ৫ পাউন্ড৷ কিন্তু যোগফল এবারেও সেই ৮ পাউন্ড৷ এখানে মূল্য কেবল হস্তান্তরিত হয়েছে, নতুন মূল্য সৃষ্টি হয়নি৷ কিন্তু মুনাফা প্রকৃতই হতে গেলে নতুন মূল্য সৃষ্টি করতে হবে৷ এটা সহজেই অনুমেয় যে কোনও দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি, শ্রেণি হিসাবে নিজেকে ঠকাতে পারে না৷
তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, সমান দ্রব্যের বিনিময় ঘটলে মুনাফা অসম্ভব, আবার যদি অসম দ্রব্যের বিনিময় ঘটে তাহলেও মুনাফা সমভাবেই অসম্ভব৷ কিন্তু তবু মুনাফা হয়৷ তা হলে এই অর্থনৈতিক রহস্যের সমাধান কীভাবে হবে?
মুনাফা প্রকৃতই হতে গেলে নতুন মূল্য সৃষ্টি করতে হবে
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পুণর্বিক্রয়ে যে মূল্যবৃদ্ধি মুনাফা হিসাবে আসে এবং যা টাকাকে পুঁজিতে রূপান্তরিত করে, তার উদ্ভব সেই টাকা থেকে হতে পারে না৷ কারণ, ক্রয় ও বিক্রয়ে টাকা এখানে ক্রীত ও বিক্রীত পণ্যের মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে (এখানে আমরা ধরে নিচ্ছি যে সমস্ত বিনিময় ঘটছে সমান জিনিসের মধ্যে)৷ একইভাবে কোনও পণ্যের মূল্য থেকেও মুনাফার উদ্ভব হতে পারে না, যা পূর্ণ মূল্যে কেনা–বেচা করা হয়েছে, কম বা বেশি কিছুতে নয়৷ সুতরাং আলোচ্য পণ্যের ‘প্রকৃত ব্যবহার’ থেকেই কেবল মূল্য বৃদ্ধি ঘটতে পারে৷ কিন্তু পণ্যের ব্যবহার অর্থাৎ ভোগ থেকে কীভাবে নতুন মূল্যের উদ্ভব ঘটবে? আমাদের উল্লিখিত ব্যবসায়ীর যদি কপাল ভাল হয় তা হলে বাজারে সে অবশ্য দেখতে পাবে এমন কোনও পণ্য আছে যার কোনও বিশেষ গুণের জন্য ভোগের মাধ্যমেই নতুন মূল্য সৃষ্টি হয়ে থাকে৷
বাজারে সেই রকম পণ্য অবশ্যই আছে৷ অর্থনীতিবিদরা সেই পণ্যকে বলেন ‘শ্রম’৷ কিন্তু মার্কস আরও সঠিকভাবে তাকে বলেছেন ‘শ্রম–শক্তি’৷ আমি এখানে এই শ্রম–শক্তি শব্দটিই ব্যবহার করব৷
বাজারে পণ্য হিসাবে শ্রম–শক্তির অস্তিত্বের পিছনে ধারণা হল যে তার মালিক সেটি বিক্রয় করেছে৷ সুতরাং সেই মালিক একজন স্বাধীন এজেন্ট, যে তার শ্রম–শক্তি আর একজন স্বাধীন এজেন্টের কাছে বিক্রয় করেছে৷ তারা দু’জনে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, সমতার ভিত্তিতে এই কেনা–বেচা করেছে৷ আরও অনুমিত হয়েছে যে, এই বিক্রয় ঘটেছে একটা সীমিত সময়ের জন্য, অন্যথায় বিক্রেতা একজন স্বাধীন এজেন্ট থেকে ক্রীতদাসে পরিণত হবে৷ এবং সর্বশেষ অনুমান হল, শ্রম–শক্তির মালিক, ভবিষ্যৎ শ্রমিক, অন্য কোনও পণ্য তার শ্রমের ফসল বিক্রয় করতে পারে না৷ সে পরিবর্তে কেবল নিজের শ্রমের সামর্থ্য বিক্রয় করে থাকে৷ সুতরাং আমাদের ব্যবসায়ীটি এমন একটা সমাজে বাস করে যেখানে বাজারে স্বাধীন শ্রমিক পাওয়া যায়, যে কেবল তার শ্রম–শক্তি বিক্রয় করার মতোই স্বাধীনতা ভোগ করে, কিন্তু এমন কোনও উপকরণের দখল তার হাতে নেই যাতে সে স্বাধীন ভাবে নিজের শ্রম–শক্তিকে প্রকৃত শ্রম, অর্থাৎ কাজে রূপান্তরিত করতে পারে৷ সুতরাং সে এমন একজন মুক্ত মানুষ, যার দুয়েকটি সস্তা সাদামাটা ধরনের উপকরণ ছাড়া, খাদ্যদ্রব্য, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নিজের বলতে কিছুই নেই৷
আমাদের এই দুই স্বাধীন এজেন্ট বাজারে যে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, সেটা নিশ্চয়ই সরল প্রাকৃতিক কারণে ঘটে না৷ এটা হল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল, সমাজে আগেকার বহু বিপ্লব যা সম্ভব করেছে৷ এবং বাস্তবিক পক্ষে পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধ থেকে দেখতে পাই যে বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্রমেই নিজের শ্রম–শক্তির এই ধরনের ‘স্বাধীন’ বিক্রেতায় পরিণত হয়েছে৷
শ্রমশক্তি এমন এক পণ্য যা মূল্য সৃষ্টি করতে পারে
এই শ্রম–শক্তি একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য৷ তার মূল্য আছে এবং যে কোনও পণ্যের মতো দাম আছে৷ অন্যান্য সব বিষয়ের মতো এটির মূল্যও তার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের উপর নির্ভরশীল৷ সুতরাং তারও পুনরুৎপাদন ঘটে৷ শ্রম–শক্তির মূল্য হল শ্রমিককে তার কাজের উপযোগী সামর্থ্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য যে সব আবশ্যিক দ্রব্য ব্যবহার করতে হয় তাদের মূল্যের এবং যেহেতু প্রাকৃতিক কারণে তার ক্ষয় ও মৃত্যু ঘটে তাই শ্রম–শক্তি বিক্রয়কারীদের ধারা অব্যাহত রাখতে বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা বজায় রাখার মূল্যের সমান৷ এই সব আবশ্যিক দ্রব্যের উপকরণ ও বৈচিত্র্য বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন কালে বিভিন্ন৷ কিন্তু কোনও একটি দেশে এবং নির্দিষ্ট কালপর্বে সেগুলি মোটামুটি অপরিবর্তনীয় ও নির্দিষ্ট৷ শ্রমিক শ্রেণির জীবনমান সেই নির্দিষ্টতার মাত্রা স্থির করে থাকে৷
এখন দেখা যাক আমাদের এই ব্যবসায়ীটি যে শ্রম–শক্তি কিনেছে সেটা কীভাবে ভোগ বা ব্যবহার করে৷ ধরা যাক কাজটি হল সূতাকাটা৷ ভাড়া করা শ্রমিককে কারখানায় নিয়ে যাওয়া হল যেখানে সে তার কাজের জন্য দরকারি সব উপকরণ পেল৷ অর্থাৎ তুলো এমন একটা অবস্থায় রয়েছে যার থেকে সুতো তৈরি করা যাবে, তার সব যন্ত্রপাতিও মজুত আছে৷ ধরা যাক, একজন সুতো কাটনির প্রতি ঘন্টায় স্বাভাবিক উৎপাদন হল ১২/৩ পাউন্ড সুতো, তার জন্য ১২/৩ পাউন্ড তুলো লাগে, (অনিবার্য অপচয় এখানে হিসাবে ধরা হচ্ছে না)৷ ছয় ঘন্টা কাজ করলে একজন কাটনি ১০ পাউন্ড তুলো থেকে ১০ পাউন্ড সুতো কাটবে৷ যদি প্রতি পাউন্ড তুলোর মূল্য ১ শিলিং হয়, তা হলে ১০ পাউন্ড সুতো ১০ শিলিং মূল্যের তুলোর প্রতিনিধিত্ব করবে৷ ধরা যাক এই ছয় ঘন্টায় যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি, তেল কয়লা বাবদ আরও ২ শিলিংয়ের মতো মূল্য ব্যয়িত হয়েছে৷ তা হলে সুতোর মূল্য দাঁড়াবে এখন ১২ শিলিং৷ কাটনির শ্রমের জন্য এই মূল্যে আর কতটা বৃদ্ধি ঘটবে সেটাই এবার আমাদের জানতে হবে৷
শ্রমশক্তির চেয়ে শ্রম বেশি মূল্য সৃষ্টি করে
ধরা যাক শ্রম–শক্তির একদিনের মূল্য, অর্থাৎ শ্রমিককে একদিন কর্মক্ষম রাখার জন্য আবশ্যিক দ্রব্যাদির মূল্য হল ৩ শিলিং৷ আরও ধরা যাক যে আবশ্যিক দ্রব্যাদির যোগফল অথবা টাকায় যা হল ৩ শিলিং সেটি একজন শ্রমিকের ছয় ঘন্টা শ্রমের মূর্তরূপ বা তার সমান৷ সুতরাং এই কাটনি ছয় ঘন্টা কাজ করার পরে সুতোয় আরও ৩ শিলিং মূল্য যোগ করেছে৷ ফলে তার মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৫ শিলিং৷ আমাদের ব্যবসায়ী একজন পাকাপোক্ত সুতো উৎপাদনকারী৷ সে তার লগ্নি করা টাকার সমান মূল্য পেয়ে গেছে সুতোর মধ্যে ১০ শিলিং সুতো, ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ২ শিলিং এবং নিয়োজিত শ্রম–শক্তির জন্য ৩ শিলিং– মোট ১৫ শিলিং৷ প্রতিটি কড়ি যা সে আগাম খরচ করেছে সুতোর মূল্যে সেই টাকা তার ফেরত এসেছে৷ কিন্তু এখানে মুনাফার কোনও বাড়তি টাকা নেই৷ আমাদের সেই ঝানু ব্যবসায়ী বা আগামী দিনে পুঁজিপতি এখনই বলবে সে তার ব্যবসা মোটেই এই রকম করে বোঝে না৷ যদি ছয় ঘন্টা কাজ করে একজন শ্রমিক সারাদিনের অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মতো কর্মক্ষমতা বজায় রাখার মতো রসদ পায়, তা হলে সেই শ্রমিক কেন সারাদিন কাজ করবে না তার কোনও যুক্তি নেই৷ লগ্নিকর্তা শ্রমিককে অর্থাৎ তার শ্রম–শক্তি সারাদিনের জন্যই ভাড়া করেছে৷ সুতরাং সারাদিনের শ্রমই তার প্রাপ্য৷ শ্রম–শক্তির মূল্য, আর যে শ্রম করতে পারে তার মূল্য, দুটো হল স্বতন্ত্র জিনিস৷ তাই যদি হয় তা হলে শ্রমিকের প্রাপ্য হল প্রথমটি আর দ্বিতীয়টি পাবে নিয়োগ কর্তা৷ শ্রম কেবল সম্পদ ও মূল্যের উৎস নয়, শ্রম করার জন্য যে শ্রম–শক্তি দরকার তার চেয়েও বেশি মূল্য উৎপাদনকারী৷ ঠিক সেই কারণেই নিয়োগ কর্তা শ্রমিক নিয়োগ করেছে৷
সুতরাং ছয় ঘন্টা কাজের পর শ্রমিককে ছুটি দেওয়ার বদলে সে তাকে আরও ছয় ঘন্টা কাজ করায়৷ অর্থাৎ শ্রমিক মোট ১২ ঘন্টা কাজ করে৷ আলোচনা সহজ করার জন্য এখানে আমরা কারখানা আইনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি না৷ তা হলে ১২ ঘন্টা কাজের পর আমরা নিচের সারণী অনুসারে দেখতে পাব –
প্রতি পাউন্ড ১ শিলিং হারে ২০ পাউন্ড তুলো – ১ পাউন্ড
১২ ঘন্টার জন্য ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ২ শিলিংX ২ – ৪ শিলিং
১২ ঘন্টার জন্য শ্রমের ফলে যুক্ত – ৬ শিলিং
———————————————————–
২০ পাউন্ড সূতার মূল্য – ১ পাউন্ড ১০ শিলিং
নিয়োগ কর্তার লগ্নি
২০ পাউন্ড সূতা (উপরের হিসাবে) – ১ পাউন্ড
ক্ষয়ক্ষতি (উপরের হিসাবে) – ৪ শিলিং
কাটনিকে প্রদত্ত মজুরি – ৩ শিলিং
———————————————————-
১ পাউন্ড ৭ শিলিং
মুনাফার মার্জিন – ৩ শিলিং
এই ব্যাখ্যায় মুনাফার সম্ভাবনার রহস্য উন্মেচিত হল৷ টাকা পরিণত হল পুঁজিতে৷ নিয়োগ কর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে এই সহজ সরল লেনদেন কেবল পুঁজির উৎস ব্যাখ্যা করে না, এই লেনদেনের ভিত্তিতে যে আমাদের সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে সেটিকেও প্রকট করে তোলে, যাকে মার্কস বলেছেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন৷ মার্কসের গ্রন্থের এটাই হল মর্মবস্তু এবং বর্তমানে ইউরোপ মহাদেশের বিশেষত জার্মানি ও রাশিয়ার সমাজতন্ত্রীরা এই তত্ত্ব পরিষ্কার বোঝেন৷
আমি এই ৩ শিলিংকে মুনাফা না বলে মুনাফার মার্জিন বলছি৷ পুঁজিপতির পকেটে এই যে টাকাটা গেল, মার্কস তাকে বলছেন, ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’৷ এর সবটাই মুনাফা নয়, কিন্তু নিয়োগ কর্তার মুনাফা এর মধ্যে রয়েছে৷ এটা তাকে অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়৷ যেমন সরকারকে কিছু দিতে হয় কর বাবদ, জমির মালিককে খাজনা, দোকানদার ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কিছু কিছু অংশ৷ এই বিভাজন কোন নিয়মে ঘটে সেটা ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের তৃতীয় বিভাগে (২য় খণ্ড) ব্যাখ্যা করা হবে৷ গ্রন্থকার তার পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন৷ জার্মান ভাষায় এই গ্রন্থ যথাসম্ভব দ্রুত প্রকাশ করা হবে৷
এইভাবে সমাজের সমস্ত শ্রেণি, যারা প্রকৃত অর্থে এবং প্রত্যক্ষভাবে সম্পদ উৎপাদন করে না, রাজা–রানি থেকে শুরু করে সংগৃহীত পরিচালক ও কাঁচা সব্জির দোকান পর্যন্ত সমস্ত শ্রেণি, এই উদ্বৃত্ত মূল্যের থেকে নিজের অংশ নিয়ে বেঁচে থাকে৷ অন্যভাবে বলা যায় তারা উদ্বৃত্ত শ্রমের নিট উৎপাদনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে জীবন ধারণ করে৷ সেই নিট উৎপাদন পুঁজিপতি আদায় করে নেয় তার শ্রমিকদের কাছ থেকে কিন্তু তার জন্য সে কোনও পয়সা খরচ করে না৷
সরাসরি উৎপাদনকারী নয়– সমাজের এমন প্রতিটি মানুষের কাছে উদ্বৃত্ত–শ্রমের অংশ কোনও পার্লামেন্টারি আইনের দান হিসাবে কর রাজস্ব থেকে আসছে কিংবা অনুৎপাদনশীল কোনও কাজ থেকে আসছে, সেটা মোটেই বড় কথা নয়৷ প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীরা অর্থাৎ শ্রমিক কোনও পয়সা না পেয়ে যে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে তার মোট পরিমাণ থেকে যে তহবিল গড়ে ওঠে, তার থেকেই এইসব ভাগাভাগি হয়ে থাকে৷
(এলিওনর মার্কস : মহান দার্শনিক কার্ল মার্কসের কন্যা, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী, কার্ল মার্কসের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনার অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন তিনি৷ এই লেখার সাব হেডিং আমাদের)
4 comments
Pingback: viagra 25 mg online
Pingback: zithromax tablets for sale
Pingback: buy plaquenil from canada
Pingback: viagra doses 200 mg