কার্নিভাল বনাম কার্নিভালঃ ক্ষমতাদর্পী ও ক্ষমতালিপ্সুর লড়াই

কলকাতার সিবিআই দপ্তরের অভিমুখে মহিলাদের মিছিল। ১৭ অক্টোবর

এ বারেও ছবিটা অন্য রকম হল না।

কর্তব্যরত অবস্থায় আর জি কর হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রী ‘অভয়া’র নৃশংস হত্যার ঘটনায় গোটা দেশ বিক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তাল। ন্যায়বিচারের দাবিতে প্রতিদিন মিছিল-মিটিংয়ে সামিল হচ্ছেন রাজ্যের হাজার হাজার মানুষ। সহকর্মী-হত্যার যথাযথ কিনারা, দোষীদের শাস্তি সহ নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানা দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে রয়েছেন, দিনের পর দিন অনশন করছেন। জয়নগরের কাছে কৃপাখালীতে ছাত্রীর রক্তাক্ত মৃতদেহ মানুষকে যন্ত্রণায় দীর্ণ করেছে। সারা বছর প্রতীক্ষা থাকে যার, সেই শারদোৎসবেও মানুষ এ বার যেন তেমন আনন্দের সঙ্গে যোগ দিতে পারেনি। মুখ্যমন্ত্রী ধমক দিয়ে বলেছিলেন– অনেক হয়েছে, এবার উৎসবে ফিরুন। মানুষ তার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। বলেছিল– পুজো হোক, কিন্তু উৎসব নয়। বহু পুজো কমিটি সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই পরিবেশে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতি মানবিক মনোভাব আশা করেছিল মানুষ। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী নিজে একজন মহিলা হওয়ায়, অভয়ার এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে তাঁর কাছ থেকে সমব্যথী আচরণের প্রত্যাশা ছিল। তা ছাড়া কার্নিভাল তো পুজোর অঙ্গ নয়, ভোটের দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত এক আড়ম্বর মাত্র। কিন্তু চূড়ান্ত অসংবেদী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে এবারেও সরকারি রুটিনের ব্যতিক্রম হল না। অন্য বারের মতোই প্রবল জাঁকজমক সহযোগে পালিত হল পূজা-কার্নিভাল।

পাঁচ ঘণ্টা ধরে রেড রোডে দুর্গা প্রতিমার শোভাযাত্রা চলল। অন্যান্য বারের মতোই মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর সঙ্গী মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক সহ ফিল্ম জগতের তারকারা মহা-সমারোহে নাচে-গানে আসর মাতালেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিলেন হুল্লোড়ে। খোদ রাজধানী শহরের বুকে এমন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। সরকারি হাসপাতালের মতো জনাকীর্ণ একটি জায়গা নিজস্ব কর্মক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অভাবনীয় ভাবে সামান্য নিরাপত্তাটুকু পেলেন না চিকিৎসক-ছাত্রীটি– তাঁকে সেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হল রাজ্য প্রশাসন। অথচ তা নিয়ে সামান্যতম লজ্জার প্রকাশটুকুও দেখতে পাওয়া গেল না কার্নিভালে হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সহচরদের আচরণে। রাজ্যের শোকগ্রস্ত, বিক্ষুব্ধ মানুষের ধিক্কারের সামান্যতম পরোয়াও করলেন না তাঁরা। প্রমাণ করলেন, শাসন-ক্ষমতা দখলে এলে শাসকের বুকে জমে ওঠে শুধুই দম্ভ– সহনাগরিকের বেদনা-যন্ত্রণা সেখানে পৌঁছতে পারে না।

সরকারের এই চরম নির্লজ্জ আচরণের নিন্দায় মানুষ যখন ধিক্কারে ফেটে পড়ছে, ক্ষোভ জানাচ্ছে, যখন তারা মনে মনে চাইছে, মৃত্যুশোকের এই অন্ধকার সময়ে উৎসবের নিষ্ঠুর অট্টহাসি বন্ধ হোক, তখন তারই প্রতিবাদের নামে সিনিয়র চিকিৎসকদের একটি সংগঠন ও সিপিআই(এম) নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি মঞ্চ ডাক দিল পাল্টা একটি ‘কার্নিভালক্স-এর। মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখল, তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’! ইংরেজি ‘কার্নিভাল’ শব্দের অর্থ– আনন্দোৎসব, যেখানে উজ্জ্বল পোশাকে সেজে হৈ-হুল্লোড়ে মাতে মানুষ। চোখের সামনে যখন আমরা এক মেধাবী কন্যার সফল চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যেতে দেখলাম, সন্তানহারা মা-বাবার জীবনের সব আলো যখন নিভে গেল, রাজ্যের প্রতিটি মানুষের বুকে শোক যখন পাথরের মতো ভারী, আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা যখন না খেয়ে প্রতিবাদ করছেন– তখন অনশন-মঞ্চ থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ‘উৎসব’-এর ডাক দেওয়া মানবিক হল কি?

প্রতিবাদের নামে সেই উৎসব সে দিন কেমন ভাবে পালন করল রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের জমায়েত? ঢাকের পরে ঢাক বাজানো হল, তালে তালে উদ্দাম নৃত্য চলল, গান-হাসি-হুল্লোড়ে মাতল উপস্থিত জনতা। সঙ্গে অবশ্য প্রতিবাদী স্লোগানও ছিল– কিন্তু সেই স্লোগানের বড় অংশ জুড়ে, আন্দোলন তীব্রতর করে ন্যায়বিচার আদায়ের আহ্বান নয়, ছিল শাসক বদলের ডাক। রাত নামা পর্যন্ত চলল এই নাচ-গান-হুল্লোড়বাজি। জুনিয়র ডাক্তারদের আহ্বানে দিনের পর দিন পথে নেমে স্লোগান তুলেছেন যে আপামর জনসাধারণ, রাতের পর রাত জেগে ন্যায়বিচার চেয়ে সোচ্চার হয়েছেন যেসব মানুষ– মৃত্যুশোক জমাটবাঁধা তাঁদের বুকে প্রবল আঘাত করে গেল প্রতিবাদের নামে এই উৎকট-উৎসবের সোল্লাস চিৎকার।

স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন– এর নাম কি প্রতিবাদ? এই কি প্রতিবাদের সংস্কৃতি! তাঁদের জিজ্ঞাসা– প্রতিবাদের নামে যাঁরা উৎসবের ডাক দিলেন, তাঁরা সত্যিই ‘অভয়া’র ন্যায়বিচার চান তো? সত্যিই কি তাঁরা চান যে, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা দুর্নীতিচক্রের অবসান হোক? নাকি তাঁদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন? যে কোনও প্রকারে সরকারি ক্ষমতা দখল করাই তাঁদের পাখির চোখ নয় তো? কিন্তু ক্ষমতা দখলের কানাগলিতে এই মহৎ আন্দোলন হারিয়ে গেলে অতীতের মতোই অন্য কোনও দলের ছত্রছায়ায় জাঁকিয়ে বসবে দুষ্কৃতীরা, দুর্নীতি বা নারীর অবমাননা তাতে এক চুলও কমবে না।

জনশ্রুতি কিন্তু বলছে, সরকারি কার্নিভালের উত্তরে আরেকটি কার্নিভালের মত্ততায় দ্রোহের স্বর চাপা পড়ে গেছে। সরকারি ‘পূজা কার্নিভাল’ যদি হয় ক্ষমতাদর্পীর দাপটের প্রকাশ, তা হলে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ হয়ে গেছে নিছক ক্ষমতালিপ্সুর আস্ফালন।