কারা শত্রু, কারা বীর গুলিয়ে দিচ্ছে গেরুয়া শিবির

সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডে দুই অভিযুক্ত– পরশুরাম ওয়াঘমারে ও মনোহর যাদভে সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ বিজয়পুরায় নিজেদের এলাকায় ফেরার পরই মালা ও উত্তরীয় পরিয়ে তাদের বরণ করতে স্থানীয় আরএসএস-বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তারা এদের ‘বীর’ বলে আখ্যা দেয়।

আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগে– কারা বীর? বীরগাথা লেখা হয় কাদের জন্য? যাঁরা দেশের জন্য, দেশের লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার শর্তে হাসতে হাসতে নিজের জীবন বাজি রাখতে জানেন, প্রকৃত বীর তাঁরাই। কিন্তু আমরা দেখলাম দেশের সেই সাধারণ মানুষের কেউ নয়, সাম্প্রদায়িক উগ্রতাকে ভিত্তি করে বিজেপি-আরএসএস এদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা কয়েকটি সংগঠন সাংবাদিক হত্যায় অভিযুক্তদের বীরের সম্মান দিল। কেন দিল? ২০১৭-র ৫ সেপ্টেম্বর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দুই কর্মী সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করে। রাজ্য সরকার গঠিত সিট ২০১৮-তে জানিয়েছিল ওয়াঘমারে হত্যার কথা কবুল করেছে। তার কাছ থেকে হত্যার অস্ত্রও উদ্ধার করেছিল পুলিশের বিশেষ অনুসন্ধানী দল। গৌরী লঙ্কেশ এক স্বাধীন সাংবাদিক, যিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদের সমালোচক ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতে তথাকথিত নিম্নবর্গদের অধিকার, নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে নানান ধর্মীয় কুপ্রথার সমালোচনা করতেন। বিজেপির উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ভাষ্যের সঙ্গে এটা আলাদা। কিন্তু মতের সঙ্গে না মিললে বা কেউ সমালোচনা করলেই কি তাকে হত্যা করা যায়? এর জবাব হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে দিতে হবে। কী করে সেই হত্যাকারীরা বীর হয়?

এদের বীরত্ব নির্ধারিত হচ্ছে কি বিজেপির ভোটের লাভ থেকে? না হলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই ওই দু-জনকে মহারাষ্ট্রে বিজেপি জোটের শরিক একনাথ শিন্দের নেতৃত্বে চলা শিব সেনায় ঘটা করে যোগ দেওয়ানো হল কেন? বিজেপি যখন বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সংবর্ধনা দিয়েছিল তার অল্প দিনের মধ্যেই ছিল গুজরাট বিধানসভার নির্বাচন। কাঠুয়ায় আট বছরের শিশুর ধর্ষক এবং খুনিদের পক্ষেও তারা আওয়াজ তুলেছিল ওই বছর ছত্তিশগড়, কর্ণাটকে নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদের হাওয়া তোলার স্বার্থে। এই ভোট রাজনীতির লাভের হিসাবে থেকেই বিজেপি মারাত্মক খুনিদের বীর সাজিয়েছে। আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস ভোট হারানোর ভয়ে সব দেখেও চুপ! আরএসএস-বিজেপি ও গেরুয়া শিবিরের কাছে শত্রু কারা? যদি আপনি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেন আর আরএসএস-বিজেপি ও গেরুয়া শিবিরের তা না-পসন্দ হয়, তবে আপনি তাদের শত্রু হয়ে যেতে পারেন। যেমন করে তারা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল মহারাষ্ট্রের চিকিৎসক-সমাজসেবী-যুক্তিবাদী ও কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের নেতা, লেখক নরেন্দ্র দাভোলকরকে, তেমন করেই শত্রু বলে প্রতিপন্ন করেছে কন্নড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের মধ্যে আমূল সংস্কারপন্থী এম এম কালবুর্গীকে, বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও লেখক গোবিন্দ পানসারেকে। বছরের পর বছর কেটে গেলেও কোনও হত্যাকারীর শাস্তি হয়নি।

আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা গোলওয়ালকরের মতে, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সেনানীরা যেহেতু মুসলিমদের পরিবর্তে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করেছেন, তাই তাঁরা বিশ্বাসঘাতক। হবে নাই বা কেন। একদিন হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশের ভারত আগমণকে প্রশস্তি করে বলেছিল ‘ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আর্য জাতির গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা যা সুদূর অতীতে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, আবার এক হতে পেরেছে। এক জাতি অপরটিকে রাজনৈতিক পথনির্দেশ ও সুরক্ষা প্রদান করছে। যে সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যায় না, তার প্রজা হিসেবে আমরা গর্বিত এবং এই প্রাপ্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রমাণ করতে আমরা সর্বদাই সচেষ্ট।’ একই দর্শন নিয়ে চলা হিন্দু মহাসভা, আরএসএস তাই কখনওই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি, অংশগ্রহণ তো দূরের কথা। আর সে কারণেই তাদের চোখে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীর সেনানী ক্ষুদিরাম বসু-বিনয়-বাদল-দীনেশ-মাস্টারদা সূর্য সেন-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-রামপ্রসাদ বিসমিল-আসফাকুল্লারা দেশদ্রোহী-বিশ্বাসঘাতক। এই হিন্দু মহাসভা, আরএসএস এর উত্তরসূরী বিজেপি ও গেরুয়া শিবির ভারতের সত্য ইতিহাসকে অস্বীকার করে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহান মানুষেরা নয়, ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া, তাদের সমস্ত রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিনায়ক দামোদর সাভারকর এদের কাছে বীর। আর দেশপ্রেমিক কারা? গোলওয়ালকর বলেছেন, ‘আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এ কথাই বলে যে, সমস্ত কিছু করেছে একমাত্র হিন্দুরা।’ এই যুক্তির ভিত্তিতে যে হিন্দুরা অহিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে, দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছে তারা দেশপ্রেমিক। কোন অন্ধকার, পুতিগন্ধময় চিন্তার দ্বারা এরা নিয়ন্ত্রিত ভাবতে পারেন! আমার আপনার কাছে যা ইতিহাস, যা দেশকে ভালোবাসা, যা বীরত্ব, যা মূল্যবোধের উৎস সে সবকিছুকেই নস্যাৎ করতে চায় আরএসএস-বিজেপি ও গেরুয়া শিবির। মানবতার ঘৃণ্য শত্রুদের বীরের তারা সম্মান দেয়। ফলে এটা স্বাভাবিক যে, এদের চোখে গৌরী লঙ্কেশ হত্যায় অভিযুক্তরাই বীর বলে গণ্য হবে। আবার একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, হত্যা ও ধর্ষণে অভিযুক্তদের এই সংবর্ধনার পিছনে, অন্য কিছু নয়, আসলে রয়েছে হিন্দু ভোট একজোট করে নির্বাচনী ফয়দা লোটারই পরিকল্পনা। সাধারণ মানুষ যত দ্রুত এদের স্বরূপ চিনতে পারে ততই মঙ্গল।