শিক্ষাঋণে তাদের কড়া অবস্থানের কথা ঘোষণা করল ব্যাঙ্ক কর্তাদের সংগঠন ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কস অ্যাসোসিয়েশন (আইবিএ)৷ কারিগরি ও পেশাদারি শিক্ষায় পাঠরত বা পড়তে ইচ্ছুক যোগ্য ছাত্রছাত্রীকে ব্যাঙ্কগুলি যে ঋণ দিত তা বন্ধ হতে চলেছে৷ আই বি এ–র বক্তব্য, শিক্ষাঋণে অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধির কারণেই তাদের এই পদক্ষেপ৷
প্রতি বছর যে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা ঋণ পায়, পড়াশোনার শেষে তাদের বেশির ভাগই চাকরি পায় না বা পেলেও তাদের বেতন এতই কম যে ঋণের টাকা তারা পরিশোধ করতে পারে না৷ ব্যাঙ্ক কর্তাদের দাবি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্টের মতো কারিগরি ও পেশাদারি পাঠক্রমে এই সমস্যা সব থেকে বেশি৷
সেন্ট্রাল সাবসিডি স্কিমে যে সকল পরিবারের মোট আয় বছরে সাড়ে চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত, তাঁরা শিক্ষাঋণে ভর্তুকি পেয়ে থাকেন৷ এ ক্ষেত্রে পড়া শেষ হওয়ার ১ বছর পর থেকে মাসিক কিস্তি দেওয়া শুরু হয়৷ কিন্তু সুদের হিসেব হয় ঋণ পাওয়ার পর থেকে৷ কিস্তি শুরু হওয়া পর্যন্ত ব্যাঙ্কগুলি সুদ বাবদ যে টাকা পায়, সেটাই ভর্তুকি দেওয়া হয়৷ আই বি এ জানিয়েছে, ভর্তুকির সুবিধা পেতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (ন্যাক) অথবা ন্যাশনাল বোর্ড অব অ্যাক্রেডিটেশন (এন বি এ–এর) ছাড়পত্র থাকতে হবে৷ শুধুমাত্র এ ই আই সি টি বা ইউ জি সি–র অনুমোদন থাকলেই চলবে না৷ বছরে ৪.৫ লক্ষ টাকা অর্থাৎ মাসে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা আয় থাকতে হবে৷ আমাদের দেশের কটা পরিবারের তা আছে?
সরকারি তথ্য বলছে, দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষ দৈনিক ২০ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারে না৷ এই পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাঋণে ভর্তুকি পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷ দ্বিতীয়ত, ন্যাক বা এন বি এ–র অনুমোদন দেশের সামান্য পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই রয়েছে৷ এর বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্রছাত্রীরাও ভর্তুকি পাবে না৷ এরা পড়াশোনা শুরুর সময়ে যে ঋণ নেবে, সেই টাকা সুদে–আসলে নিজেদেরই পরিশোধ করতে হবে৷ ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ গরিব ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের সামনে শিক্ষাঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই৷ আবার উপযুক্ত অনুমোদন দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের না থাকায়, সেখানে পাঠরত ছাত্রছাত্রীরাও শিক্ষাঋণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত৷
পূর্বতন কংগ্রেসের মতো বর্তমানে কেন্দ্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজেপি তাদের শিক্ষানীতিতে ফলাও করে শিক্ষাঋণ দেওয়ার কথা বারে বারে ঘোষণা করে থাকে৷ এমনকী গরিব ছাত্রছাত্রীদের সরকারি ভর্তুকি দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে৷ এদের সকলেরই প্রতিশ্রুতি টাকার অভাবে দেশের কোনও ছাত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে না৷
কিন্তু এখন ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে৷ কংগ্রেস–বিজেপি প্রভৃতি মালিকদের বিশ্বস্ত দলগুলি সমস্ত পরিষেবা ক্ষেত্রে খোলাখুলি বেসরকারিকরণের নীতি নিয়ে চলছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে মালিকরা বিনিয়োগ করুক, এটা তাদের ঘোষিত নীতি৷ মালিকরা ছাত্রের অভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগে যাতে নিরুৎসাহিত না হয় তার জন্যই সরকার বারে বারে শিক্ষাঋণ ও ভর্তুকির কথা ঘোষণা করেছিল৷ কিন্তু এই ঘোষণা বর্তমান মালিকি ব্যবস্থাকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আর জোগাতে পারছে না৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অমোঘ নিয়মেই নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া তো দূরের কথা পুরনো কল–কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিগত চার বছরে দেশের মানুষের কাছে ডাহা মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়ে গেছে৷ ফলে, দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং–ম্যানেজ সহ বিভিন্ন কারিগরি ও পেশাদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের সামনে থাকছে না চাকরির কোনও সুযোগ৷ যারাও বা কাজ পাচ্ছেন, তারা কম বেতনে বিভিন্ন ঠিকা কাজ ও চুক্তির ভিত্তিতে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন৷ স্বাভাবিকভাবেই এদের পক্ষে ঋণ ও তার সুদের বিপুল অঙ্কের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়৷ দেশের বর্তমান শিক্ষানীতিতে একদিকে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ পাওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে শিক্ষান্তে চাকরি না পেয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে সর্বস্বান্ত হওয়ার চক্রব্যুহ চলছে৷
(৭১ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)